বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

শেখ আবুল কাশেম মিঠুন

আব্দুর রাজ্জাক রানা : যে মানুষটি এক সময় স্বপ্ন দেখতেন, একদিন অভিনয় দিয়ে বাংলাদেশের রূপালি জগৎ কাঁপাবেন; কাঁপিয়েছেনও তিনি। সেই মানুষটিই হঠাৎ একদিন রূপালি জগৎ ছেড়ে দিয়ে হয়ে গেলেন অন্য ভুবনের মানুষ। তিনি বেছে নিলেন ইসলামী সংস্কৃতি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই ধারাতেই অবিচল ছিলেন তিনি। তিনি আর কেউ নন, আমাদের সকলের প্রিয় শেখ আবুল কাশেম মিঠুন। সবাই তাঁকে এক নামে চেনেন নায়ক ‘মিঠুন’ বলেই। পিতৃ-মাতৃ প্রদত্ত নাম শেখ আবুল কাশেম। কিন্তু বাবা-মা তাকে আদর করে ডাকতেন ‘মিঠু’ বলে। চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করে ‘মিঠু’ হয়ে যান ‘নায়ক মিঠুন’।
 শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ভারতের কোটারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৫ সালের ২৪ মে দিবাগত রাত ২টার দিকে ইন্তেকাল করেন। আজ ২০১৬ সালের ২৪ মে তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ সংস্কৃতিকেন্দ্র, খুলনা সংস্কৃতিকেন্দ্র ও মরহুমের পরিবারের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কমৃসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-বুলেটিন প্রকাশ, কুরআনখানি, আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল।
শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ১৯৫১ সালের ১৮ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলার সুন্দরবন ঘেঁষা আশাশুনি উপজেলার দরগাঁহপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম শেখ আবুল হোসেন ও মা হাফেজা খাতুন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সকলের বড়। শেখ আবুল কাশেম মিঠুন সঙ্গীতা ও তরী নামের দুই কন্যা সন্তানের জনক।
১৯৭২ সালে জগৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার পিসি রায় প্রতিষ্ঠিত পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলির আরকেবিকেএইচসি ইনস্টিটিউট হতে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি চলে আসেন খুলনায়। এখানে এসে তিনি ফুফাতো ভাই খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা শেখ আব্দুল জলিল এবং বংশের বড় বোন হাজেরা জলিলের বাসায় ওঠেন। এইচএসসিতে ভর্তি হন খুলনা সিটি কলেজে। এখান থেকে ১৯৭৪ সালে পাস করে একই কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হন। এ সময় তিনি সাহিত্য ও সাংস্কৃতি অঙ্গনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৮ সালে নূর মোহাম্মদ টেনা সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক কালান্তর’ পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি ‘কালান্তর’ এর কার্যনির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ বেতার খুলনা কেন্দ্রের স্ক্রিপ্ট রাইটার ও গীতিকার হিসেবেও কাজ করেন। সংস্কৃতিমনা শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ১৯৮০ সালে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। তার প্রথম অভিনীত ছবি ‘তরুলতা’। প্রথম ছবিটিতেই তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। তাঁর আরো অনেকগুলো জনপ্রিয় সিনেমা রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ঈদ মোবারক’, ‘ভেজা চোখ’, ‘নিকাহ’, ‘কুসুমকলি’, ‘প্রেম প্রতিজ্ঞা’, ‘বেদের মেয়ে জোছনা’, ‘নিঃস্বার্থ’, ‘সাক্ষাৎ’, ‘স্বর্গনরক’, ‘ত্যাগ’, ‘চাকর’, ‘জিদ’, ‘চাঁদের হাসি’, ‘নরম-গরম’, ‘গৃহলক্ষ্মী’, ‘এ জীবন তোমার আমার’, ‘খোঁজ-খবর’, ‘ছোবল’, ‘কসম’, ‘দিদার’, ‘পরিচয়’ ‘মাসুম’, ‘কুসুমকলি’, ‘দস্যু রাণী ফুলন দেবী’, ‘জেলহাজত’, ‘ত্যাজ্যপুত্র’, ‘সর্দার’, ‘অন্ধবধূ’, অনন্য, চ্যালেঞ্জ, চন্দনা, ডাকু, স্যারেন্ডার, বাবা কেন চাকর প্রভৃতি। নায়ক ছাড়াও তিনি সিনেমার পার্শ্ব চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। এছাড়াও তিনি অসংখ্য সিনেমার চিত্রনাট্য রচনা করেছেন। ২০০০ সালে তিনি সিনেমার অভিনয় থেকে সরে আসেন। তারপরও তিনি স্ক্রিপ্ট রাইটার ও গীতিকার হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করেছেন। শিশুদের নিয়ে দিগন্ত টেলিভিশনে করা তার অনুষ্ঠানটিও ছিল জনপ্রিয়।
অভিনয় থেকে সরে আসলেও শেখ আবুল কাশেম মিঠুন আজীবন সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার। ২০১০ সালের ১১ আগস্ট (প্রথম রমযানের সেহরীর সময়) বাংলাদেশ সংস্কৃতিকেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক কবি ও গীতিকার, ইসলামী সাহিত্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ মতিউর রহমান মল্লিক ইন্তিকাল করেন। কবি মতিউর রহমান মল্লিকেরই নিরলস প্রচেষ্টায় সারাদেশে নতুন ধারার ইসলামী সঙ্গীত চর্চা শুরু হয় এবং এর বিস্তৃতি ঘটে। খ্যাতিমান এই কবির মৃত্যুর পর শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ‘বাংলাদেশ সংস্কৃতিকেন্দ্র’র হাল ধরেন। তিনি ছিলেন এই সংগঠনের উপ-পরিচালক।
শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ২০১৪ সালের মার্চে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নেন। একটু সুস্থবোধ করলেই তিনি আবার শুরু করেন সংস্কৃতি চর্চা। রাজধানী ছেড়ে ছুটে বেড়ান দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সর্বশেষ তিনি ২০১৫ সালের মার্চের শেষ দিকে আসেন। তিনি যে কঠিন রোগে আক্রান্ত ছিলেন তার কথাবার্তায় তা কখনো ফুটে ওঠেনি। তার প্রাণোচ্ছল আচরণের কারণে আমরা তা কখনো টেরও পাইনি।
শেখ আবুল কাশেম মিঠুন কিডনি, লিভার, হার্ট ও লান্সের সমস্যায় ভুগছিলেন। অসুস্থ অবস্থাতেই ২০১৫ সালের ১১ মে তিনি তাঁর অসুস্থ মা হাফেজা খাতুনকে দেখতে খুলনায় আসেন। অসুস্থ মাকে দেখতে এসে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর শরীরের অবস্থার অবনতি হলে ১৪ মে বিকেলে স্থানীয় ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখানে ১৮ মে পর্যন্ত তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। অবস্থার আরো অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৯ মে সকালে তাকে বেনাপোল সীমান্ত পথে ভারতের কোলকাতায় পাঠানো হয়। সেখানে তিনি বিশিষ্ট কার্ডিয়াক সার্জন প্রফেসর ডা. পিবি শুকলা এবং কোটারী হাসপাতালের বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ শামীমুল হকের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় কোটারী হাসপাতালে ২৪ মে দিবাগত রাত ২টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।
শেখ আবুল কাশেম মিঠুনের কফিন ভারত থেকে আনতে স্বজনদের পড়তে হয়েছে নিয়ম-কানুনের নামে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। ২৪ মে রাতে মারা গেলেও ২৫ মে সারাদিন তার সাথে থাকা ছোট ভাই ফারুক হোসেন ও বোন পুতুল পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিরামহীনভাবে ছোটাছুটি করতে হয়েছে। তারপরও ঘাটে ঘাটে হয়রানি ও বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে। অবশেষে ২৬ মে সন্ধ্যা ৭টায় পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে লাশ দেশে পৌঁছে। সেখান থেকে এ্যাম্বুলেন্সে রাত ১০টায় লাশ দরগাঁহপুর গ্রামে আনা হয়। এখানের মাটি ও মানুষের হৃদয়ে তার অবস্থান ছিল শক্ত। ওই রাতেই হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি ও বুক ফাটা কান্নাই তার প্রমাণ মেলে। মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে সাতক্ষীরাসহ যশোর, খুলনা, ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তার আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী, বন্ধু ও হাজারো ভক্ত দরগাঁহপুর গ্রামে ছুটে আসেন।
২৬ মে বিকেলে দরগাঁহপুর, শ্রীধরপুর, রামনগর, কাইটপাড়া, বাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মাইকে ভেসে আসে চিত্রনায়ক শেখ আবুল কাশেম মিঠুনের জানাযার সংবাদ। রাত ১০ টার কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ করে মাইকে ঘোষণা দেয়া হয় কিছুক্ষণের মধ্যে সকলের প্রিয় আবুল কাশেম মিঠুনের কফিন দরগাঁহপুর পৌঁছাবে। এ সময় প্রিয় মানুষটির মুখ এক নজর দেখার জন্য মানুষের সে কি আকুলতা। যেন কতদিন পরে আসছেন তাদের ‘প্রিয়জন’।
অবশ্যই এর আগেই দরগাঁহপুর আর কে বি কে কলেজিয়েট স্কুল মাঠে শেখ আবুল কাশেম মিঠুনের জানাযাপূর্ব স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তারা বলেন, মিঠুনের মৃত্যুতে শুধু সাতক্ষীরা অঞ্চলেরই নয়, সারাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনেরই ক্ষতি হয়েছে। তিনি ছিলেন ইসলামী সংস্কৃতি অঙ্গনের একজন প্রাণ পুরুষ। তিনি তাঁর যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্রকে পরিচালনা করেছেন। তিনি বুঝতেই দেননি কবি মতিউর রহমান মল্লিক ভাইয়ের অনুপস্থিতি। আমাদের প্রিয় মল্লিক ভাইও আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। খুলনা সংস্কৃতিকেন্দ্রের সভাপতি সাংবাদিক বেলাল ভাইও আজ নেই। ঘাতকের নির্মম বোমা তাঁকে আমাদের মাঝ থেকে কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু তাঁদের চিন্তা-চেতনা আদর্শ আমাদের মাঝে আছে। এই আদর্শ ধরেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এ সময় বক্তারা মিঠুন ভাইয়ের নামে ‘শেখ আবুল কাশেম মিঠুন ফাউন্ডেশন’ গঠন করার দাবি জানান।
অপেক্ষার প্রহর শেষে রাত ১০ টায় পৌঁছায়। এসময় সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। স্ত্রী, সন্তান, স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীদের কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে মাইকে জানাজার ঘোষণা করা হয়। গোসল শেষ করে মিঠুন ভাইয়ের কফিন স্কুল মাঠে নেয়া হয়। রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। গভীর রাতেও জানাযায় ছিল মানুষের ঢল। জানাযায় ইমামতি করেন মাওলানা জাহিদুল বাশার। জানাযা শেষে নারকেলবিথি ও গাছ-গাছালিতে ভরা পারিবারিক কবরস্থানে শেখ আবুল কাশেম মিঠুনকে দাফন করা হয়। তিনি যে এলাকার মানুষের ভালবাসায় বেড়ে উঠেছিলেন, যে মাটি ও বাতাসে বড় হয়েছিলেন সে মাটিতেই তিনি এখন চির নিদ্রায় শায়িত। দুঃখজনক হলেও সত্যি মিঠুন ভাইয়ের জানাযার ইমাম সাহেব মাওলানা জাহিদুল বাশার ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। আমরা তার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া কামনা করি।
শেখ আবুল কাশেম মিঠুন, মতিউর রহমান মল্লিক, শেখ বেলাল উদ্দিন ছিলেন ইসলামী সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম নায়ক। আজ তাঁরা নেই। কিন্তু আমরা আছি; তাঁদের দেখানো পথেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। মৃত্যু অবশম্ভাবী সত্য। তাই বলে ইসলামী সংস্কৃতি চর্চায় কোন বাধা থাকতে পারে না। যত বাধা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিরোধিতাই আসুক না কেন ইসলামী সংস্কৃতি চর্চা থেমে থাকবে না। সব বাধা ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে আমরা মিঠুন ভাই, মল্লিক ভাই ও বেলাল ভাইয়ের রেখে যাওয়া কাজকে সম্পূর্ণ করবো-ইনশাআল্লাহ।
-লেখক : সাংবাদিক

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ