বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ডাহুকের ডাক : প্রকৃত প্রেমের প্রেরণায়

মুহাম্মাদ হাবীবুল্লাহ হাসসান : পুষ্পশোভিত ও পাখির কলরবমুখরিত সবুজ দেশের কবিতায় পাখির উপস্থিতি একটি স্বাভাবিক ও স্বয়ংপ্রকাশ বিষয়। বাংলা কবিতায় পাখি এসেছে নানা অর্থে-বর্ণে, নানা উপমায়-ভঙ্গিমায়। কবিতায় প্রতীক হিসেবে যখন পাখির কথা আসে, তখন সে পাখি আর হুবহু বনের পাখি থাকে না, অন্য পাখিতে রূপান্তরিত হয়। কবিদের কবিতায়, এমনকি পাঠকদের ভাবনায়, পাখি তখন অন্য রূপ ধারণ করে, ব্যঞ্জিত হয় ভিন্ন অর্থে। কবিরা বনের আকাশে যেমন উড়তে দেখেন পাখিদের, তেমনি মনের আকাশেও উড়তে দেখেন, উড়াতে চান।
পাখির উপমা-উপমান, পাখির প্রতীকী অর্থ কবিদের কথায় পেয়েছে নানা মাত্রা, পেয়েছে অন্যরকম অর্থব্যঞ্জনা। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের কবিতায় ঘুরে-ফিরে এসেছে ঝাঁক-ঝাঁক পাখি। নজরুলের কবিতা ও গানে অসংখ্য পাখির উপস্থিতি। লালন ফকিরের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’র প্রসঙ্গটি আধ্যাত্মিক প্রতীক হিসেবে এসেছে। কিন্তু একটি পাখি যার নাম তেমন গুরুত্ব পায় নি আগেকার বাংলা কবিতায় তাকেও চিরভাস্বর করে রেখেছেন দু’জন কবি : জীবননান্দ ও ফররুখ। সে পাখিটির নাম ‘ডাহুক’। ফররুখ আহমদের ডাহুক কবিতাটি প্রকাশিত হয় মাসিক সওগাতের ১৩৫১ বাংলা সালের কার্তিক সংখ্যায়। পরে গ্রন্থভুক্ত হয় ‘সাত সাগরের মাঝি’-তে (১৯৪৪)।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জীবনানন্দের ‘ডাহুকী’ ও ফররুখ আহমদের ‘ডাহুক’ যদিও একই পাখি ডাহুককে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে কিন্তু উভয় কবিতার পটভূমি বহুভিন্ন। সেই সাথে রোমান্টিক কবি-কল্পনায় স্নাত পাখিটি উভয় কবিতায় ভিন্ন ভিন্ন অর্থদ্যোতনায় মহীয়ান। উভয় কবিতার তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে কবিতার সমঝদার পাঠকদের কাছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠবে।
২॥
ফররুখ ছিলেন কাব্য-বিশ্বাসের কবি ও শিল্পী। তিনি ছিলেন আদর্শ ও কাব্য-বিশ্বাসের সেবক ও পৃষ্ঠপোষকও। তাই তিনি সূফী সাধকের মতো একান্ত আধ্যাত্মিক অনুভূতির প্রেরণায় নিজেকে আর নিজের কবিতাকে গেঁথেছেন একই রজ্জুতে। সূফীদের চিত্তধর্ম হচ্ছে : আল্লাহর অস্তিত্ব ছাড়া আর সবই মিথ্যে, সৃষ্টির সব কিছু থেকে, পাখিদের ডাক ও কলরব থেকেও উৎসারিত হয় আল্লাহ-প্রেমে অবারিত ঝরনা।
পুরো মুসলিম জগতের উক্ত চিত্তধর্মের শৈল্পিক প্রতিষ্ঠাতা ও প্রচারক বিশ্বকবি জালালুদ্দীন রুমী তাঁর বিখ্যাত ‘মসনবী’ গ্রন্থে বিভিন্ন রূপক ও প্রতীকের মাধ্যমে এ প্রেরণাকেই আশ্রয় করেছেন। সূফী কবিদের সত্যপ্রিয়তা, আত্মজিজ্ঞাসা, চিরায়ত জীবনানুভূতি ও বিশ্বচেতনা এই প্রেরণার সাথে মিশেই একাকার হয় এবং তখনই মানুষের ভেতর হাহাকার তুলে প্রকৃত প্রেম। আল্লাহকে প্রেমের অনুভূতিতে হৃদয়স্থ করার ধারণা ও এর মাধ্যমে কাব্যসৌন্দর্য সৃষ্টি করার কৌশল বাংলা সাহিত্যে মসনবীর আগে ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন গবেষকগণ। ফররুখ আহমদের কবিতায় এ সৌন্দর্য শৈল্পিক সুষমায় প্রযুক্ত হয়েছে লক্ষণীয়ভাবে। এ সৌন্দর্য উৎসারিত হয় সূফীশোভন রোমান্টিকতা থেকে। সূফীশোভন রোমান্টিকতার কেন্দ্র ও প্রতীক হলো প্রধানত সুরা ও সাকী এবং প্রাসঙ্গিকভাবে বংশী-বিলাপ, পাখীদের ডাক ও কলরব, প্রকৃতির শোভা  ইত্যাদি। এসবে গভীরভাবে চিন্তামগ্ন হলে যে অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তার নাম আধ্যাত্মিক প্রেরণা। আর এ প্রেরণা থেকে সৃষ্টি হয় প্রকৃত প্রেম তথা আল্লাহ-প্রেম।
ব্যক্তি ফররুখ আহমদ ছিলেন সত্যিকার অর্থে আল্লাহপ্রেমে উজ্জীবিত একজন বুজর্গ কবি। ধর্ম ও স্রষ্টাচেতনা শুধু তাঁর কল্পনায় ও কবিতায় ছিল না, ছিল তাঁর বাস্তব জীবনেও। কিন্তু ধর্ম ও স্রষ্টাচেতনা তাঁর আধুনিক ও রোমান্টিক মন ও মানসকে কখনো  আড়াল করেনি। গতিচঞ্চল রোমান্টিক কল্পনা ও অনুভূতি ফররুখ আহমদের বহু কবিতায় ছড়িয়ে আছে রূপক ও প্রতীকের আদলে। ওইসব কবিতার অন্যতম হলো ‘ডাহুক’। সমকালস্পন্দিত স্রষ্টাচেতনায় কবি সম্পূর্ণ সমর্পিত ছিলেন বলেই শিল্পী মনের মাধুরী মিশিয়ে তিনি সেই আধ্যাত্মিক চেতনাকে পুরে দিতে পেরেছেন কবিতার শব্দে-ছন্দে। সুতরাং ডাহুক অসাধারণ একটি আধ্যাত্মিক কবিতা, তবে রসরূপহীন সেকেলে আধ্যাত্মিক কবিতা নয়; বরং রোমান্টিকতায় রঙিন ও রসালো আধ্যাত্মিক কবিতা।
‘ডাহুক’ প্রকাশিত হওয়ার পর হৈ চৈ পড়ে যায় সমকালীন কাব্যাঙ্গনে। নানাজন নানা মন্তব্য ছুঁড়তে শুরু করে। আদৌ কি এটি মৌলিক কবিতা, নাকি শেলীর ‘ওড টু স্কাইলার্ক’ এবং কীটসের ‘ওড টু নাইটিঙ্গেল’ কবিতার নকল কিংবা ভাবানুকরণে রচিত ইত্যাদি মন্তব্যের ঘোড়ারডিম পাড়তে থাকে কেউ কেউ। এ খবর পৌঁছায় কবির কানে। কালচক্রে একদিন এক বৈঠকী আলোচনায় আখতার-উল আলমকে সম্বোধন করে কবি বললেন,
শোন, আমার ‘ডাহুক’ কবিতা নিয়ে দিগ্গজেরা তো মহা চিন্তায় পড়ে গেল। ‘ওড টু স্কাইলার্ক’ ‘ওড টু নাইটিঙ্গেল’- কোনটার সাথেই মেলাতে পারে না। কিন্তু ওরা তো কথার বেপারী। তালে-গোলে মিলিয়ে দিয়ে সাব্যস্ত করে ছাড়ল যে, ‘ডাহুক’ আদৌ মৌলিক কবিতা নয়। ঠিক নকল না হলেও ভাবানুকরণ ইত্যাদি। আরে, ওরা কোথা থেকে জানবে, বল্? ওরা তো খালি বইয়ের পাতায় জীবনের মানে খুঁজে বেড়ায় - ভুল মানেকে সঠিক মানে ভেবে নিয়ে বগল বাজায়।
(যুগ-প্রবর্তক কবি, আখতার-উল-আলম, ফররুখ আহমদ : কবি ও ব্যক্তি, শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত, পৃ. ১৯৮)
কেমন আধ্যাত্মিক প্রেরণার প্রেক্ষাপটে তিনি এ কবিতা রচনা করেছেন, সেটা স্বয়ং কবির জবানিতেই শুনি। কবির উপর-উদ্ধৃত বক্তব্যের পর আরেকটু এগিয়ে কবি আখতার-উল-আলমকে বললেন,
“তুই তো জানিস, মুজাদ্দিদী তরিকায় জিকির কি জিনিস। ‘ডাহুক’ রাত ভর ডেকে ডেকে গলায় রক্ত ওঠায়। মুজাদ্দিদী সাধকও তেমনি রাতভর ‘আল্লাহু’ ‘আল্লাহু’ জিকির করে নিজেকে ফানা করে দেন। গভীর রাতে নীরব নির্জন কোন গ্রাম্য মসজিদে মুজাদ্দিদী তরিকার কোন সাধক যখন ‘আল্লাহু’ ‘আল্লাহু’ জিকির করতে থাকেন, তখন মনে হয় অবিকল যেন একটা ডাহুক একমনে ডেকে চলেছে। আমার ‘ডাহুক’ কবিতা এই ধরনের মুজাদ্দিদী সাধকের জিকির নিয়েই রচিত। স্কাইলার্ক কিংবা নাইটিঙ্গেলের সাথে তার মিল থাকবে কোত্থেকে?
(যুগ-প্রবর্তক কবি, আখতার-উল-আলম, ফররুখ আহমদ : কবি ও ব্যক্তি, শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত, পৃ. ১৯৮)
আবদুল আহাদ যিনি ফররুখ আহমদের মনকে প্রেমিকের মন বলেছেন এবং ফররুখকে দিয়ে প্রেমের গান লিখিয়েছেন তিনি বলেছেন, ‘এই ফররুখের হাত থেকেই একদিন ‘ডাহুক’ কবিতা বেরিয়েছে।’ উদ্ধৃতি থেকে বোঝা গেল, আবদুল আহাদের মতে ‘ডাহুক’ প্রেমের কবিতা। কারণ, তিনি প্রেমের গান প্রসঙ্গেই কথাটি উল্লেখ করেছেন। সত্যি, ডাহুক প্রেমের কবিতা - আধ্যাত্মিক প্রেমের উচ্চমার্গীয় কবিতা। প্রকৃত প্রেমের প্রেরণায় স্নাত হয়ে কবি রচনা করেছেন কবিতাটি।
আধ্যাত্মিকতায় উচ্চমার্গীয় কবিতার যে প্রধানতম প্রতীকের কথা উপরে বলা হয়েছে, সে সুরা ও সাকী আশ্চর্য এক ভঙ্গিমায় বাঙময় হয়ে ওঠেছে ডাহুক কবিতায়। সৃষ্টির কেউ-ই পার্থিব জগতে আল্লাহকে ভালো করে চিনতে ও বুঝতে পারে না। অস্পর্শ্য-অদৃশ্য-অনায়ত্ত এক সত্তা তিনি। আল্লাহকে চিনতে হলে সৃষ্টির ভেতরই চিনতে হয়। জগতে ছিটিয়ে-ছড়িয়ে থাকা নিদর্শনাবলির মাধ্যমেই আল্লাহকে বুঝতে হয়। পাখিদের কলরবে, পানির খলখল ধ্বনিতে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের গণিতে, সঙ্গীতের সুরে, সাকীর শরাবে আল্লাহকে বোঝা ও চেনা যায়। অদৃশ্য সত্তার অনুভবযোগ্য প্রেমকে তাই কবিরা সুরা-সাকীর মাধ্যমেই বেশি আস্বাদন করেছেন এবং অন্যদেরও বুঝিয়েছেন। ফলত খৈয়াম-রুমী-হাফিজের কবিতায় সুরা-সাকীর উল্লেখপ্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। ফররুখ আহমদ ডাহুকের ডাকে খুঁজে পেয়েছেন আল্লাহপ্রেমের মৌচাক। ডাহুককে কখনো সুরাবাহী, কখনো পাত্রভরা সাকী, কখনোবা অচেনা শরাবের জাম সম্বোধন করে আল্লাহপ্রেমকে প্রতীকায়িত করেছেন আশ্চর্য এক ভঙ্গিতে,
 
মনে হয় তুমি শুধু সেই সুরাবাহী
পাত্র ভরা সাকী ।
উজাড় করিছ একা সুরে ভরা শারাব-সুরাহি
বনপ্রান্তে নিভৃত একাকী ।

হে অচেনা শারাবের ‘জাম’!
যে সুরার পিপাসায় উন্মুখ, অধীর অবিশ্রাম
জাগতিক প্রতীকের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহকে চিনতে ও বুঝতে চায় বলেই, সে কখনো মনে করে, আল্লাহর সত্তাকে চিনেছে, পরক্ষণে বলে ওঠে, না, না, আমি তো তাকে চিনিনি। দ্বন্দ্ব ও সিদ্ধান্তের দোলাচলে সে নিজেকে প্রবোধ দেয় কোনোরকম। ডাহুকের প্রতীকায়নে কবি আল্লাহকেই যেন বলছেন, আমি তোমাকে চিনিনি। আবার বলছেন, মনে হয়, আমি তোমাকে চিনি। চিনি বিচিত্র তুলির সুকুমার বর্ণে আঁকা সত্তা হিসেবে। কী কুরআনে, কী হাদীসে, কী কবি-সাহিত্যিকদের বাণীতে, কী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রঙ-তুলিতে তুমি চিরপ্রকাশ্য, চিরবাঙময়, চিরঝলমলে সুন্দর। যেন আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি প্রেমের স্বচ্ছ দর্পণে। তাই কবির চেনা-না-চেনার দ্বৈত আকুতি,
হে পাখি! হে সুরাপাত্র! আজো আমি
চিনিনি তোমাকে ।

হয়তো তোমাকে চিনি, চিনি ঐ চিত্রিত তনুকা,
বিচিত্র তুলিতে আঁকা
বর্ণ সুকুমার ।
৩॥
এবার কবিতাটির মূল প্রেক্ষাপটের দিকে যাই। ওই যে কবি বলেছিলেন, মুজাদ্দিদী তরিকার জিকির ‘আল্লাহু আল্লাহু’র প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন ডাহুক পাখির স্বরে ও সুরে, সে কথা অনুধাবন করতে পারলে আমার শিরোনামের সার্থকতা স্পষ্ট হবে। আল্লাহর ধ্যানে অশরীরমন মগ্ন একজন সূফী সাধকের জিকিরকে কবির মনে হয়েছে যেন একটি ডাহুক নিয়ত ডেকে চলছে। সাধকরা জীবনের সবকিছুকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেন, নিজেদের ফানা করে দেন আল্লাহর সত্তায়। এরকম সর্বতোসমর্পণের একটি যথাযথ চিত্র হলো একাগ্রচিত্তে আল্লাহর জিকির করে চলা। জিকিররত অবস্থায় একজন সাধককে মনে হয় যেন তিনি এখন অন্য জগতের মানুষ। উপরন্তু তা যদি হয় গভীর রাতে নির্জন কোনো গ্রাম্য ঘরে, মসজিদে কিংবা কোনো খানকায়, তখন ডাহুকের সাথে সাধকের সাদৃশ্য যথাযথভাবে সান্দ্রীভূত হয়। সঙ্গত কারণেই কবিতার সূচনা হয় অনুরূপ এক যুতসই চিত্র এঁকে,
রাত্রিভর ডাহুকের ডাক...
এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধ দীঘি অতল সুপ্তির।
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি ।
ছলনার পাশা খেলা আজ পড়ে থাক,
ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি,
কান পেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক ।
তা হলে এ জিকিরের মধ্যে কী এমন শক্তি, কিংবা জাদু ও মধু আছে, যার মাধ্যমে একজন সাধক নিজেকে বিলীন করে দেন আল্লাহর প্রেমে ও সত্তায়, যা উপমায়িত হতে পারে ডাহুকের ডাকের সাথে যে ডাহুক কিনা রাতভর ডেকে ডেকে গলায় রক্ত ওঠায়। অবশ্যি এরকম একটি দুর্দান্ত শক্তি রয়েছে জিকিরের ভেতর। আল্লাহর জিকিরে একই সঙ্গে জাদুও আছে, মধুও। জাদু মূলত শক্তির প্রতীক। আর মধু হলো স্বাদের প্রতীক। জাদুুর প্রতাপ ও শক্তি যেমন স্বীকৃত, মধুর মিষ্টতাও তেমনি সনদপ্রাপ্ত। জাদুর শক্তি ও মধুর স্বাদ যেখানে সমন্বিত হয়, তার প্রভাব ও প্রতাপ যে অপ্রতিরোধ্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আল্লাহর জিকিরের এমন শক্তি আছে, যা পৃথিবীতে অন্য কোনো জিনিসের নেই। আবার এমন স্বাদও তার আছে, যে স্বাদ পৃথিবীর কোনো জিনিসে নেই। স্বাদে-শক্তিতে একাকার হয়ে আল্লাহর জিকির পৃথিবীর বুকে যেসব কর্ম সম্পাদন করেছে, তা অন্য  কোনো শক্তি করতে পারেনি। জিকিরের তাকবীর ধ্বনিতে ফেঁটে খান খান হয়েছে পৃথিবীর পরাশক্তিগুলোর তখত-তাউস। প্রভাব-শক্তিতে জাগিয়ে তোলা এবং স্বাদে-রসে রসিয়ে তোলার মতো কোনো একক বাক্য পৃথিবীতে থাকলে, সেটা হলো আল্লাহর জিকির তথা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।
উপরন্তু জিকির যদি সাধকদের সান্নিধ্যে থেকে হয়, যাঁরা আল্লাহর প্রেমের পেয়ালায় চুমুক দিয়েছেন এবং জিকিরের প্রশিক্ষণ যদি নেওয়া হয় প্রকৃত প্রেমিকদের কাছে, যাঁরা প্রেমের লীলা-খেলা ভালোভাবে বুঝেছেন, তা হলে তো আর কথাই নেই। কারণ, প্রেম-শরাবের স্বাদ বুঝতে হলে, শরাবীদের কাছে যেতে হবে। কবি বলেন,
প্রেম-শরাবের স্বাদ কভীবে বোঝাব তোমাকে হে দুর্ভাগা!
তুমি তো সেই শরাবে চুমুকও দাও নি কোনো দিন।
গভীর রজনীর নিবিড় নির্জনতায় সকলে যখন ঘুমায়, তারার দীপ যখন স্বপ্নাচ্ছন্ন আকাশে ঝিমায়, গুলে-বকৌলির নীল আকাশ যখন হয়ে আসে নিসাড় নিঝুম, তারার বন্দর ছেড়ে চাঁদ চলে রাত্রির সাগরে, বেতস বনের ফাঁকে ক্ষয়ে আসে চাঁদ, তখন সাধকের ডাকের সাড়া দেওয়ার জন্য সজাগ প্রহরীর মতো জেগে থাকেন এক সত্তা। ঠিক তখনই জিকিরকারী প্রেমিকের কৌতূহলী মন গেয়ে ওঠে,
তুমি কি এখনো জেগে আছ?
তুমি কি শুনছ পেতে কান?
তুমি কি শুনছ সেই নভঃগামী শব্দের উজান?
এই যে নভোগামী শব্দের জোয়ার, সেটা জিকির, দোয়া ও সাধাকের আকুতি ছাড়া আর কিছু হতে পারে?
আধ্যাত্মিক কবিতার অন্যতম লক্ষণ হলো, কবি নিজেকে দুর্বল-অক্ষম ভেবে বিনয় প্রকাশ করেন এবং এ কারণেই কবি হয় সরাসরি পরম প্রিয়ের কাছেই অক্ষমতা প্রকাশ করেন মন ভরে, বিনয় ভরে, কিংবা অক্ষম আকুতি প্রকাশ করেন কবিতায় আশ্রিত প্রতীককে সম্বোধন করে। এখানে দেখা যাচ্ছে, কবি স্বয়ং ডাহুক পাখিকে একজন সর্বতোসমর্পিত সাধকের স্থানে বসিয়েছেন। ডাহুককে, ডাহুকের সুরকে, ডাহুকের কষ্টোচ্চারিত শব্দকে কবির মনে হচ্ছে পবিত্রতায় পেলবিত জিকির ও আকুতি এবং কবি নিজেকে মনে করছেন অপবিত্র, কদর্য এবং গোনাহের শৃঙ্খলে আবদ্ধ আর ডাহুককে মনে করছেন শৃঙ্খলমুক্ত, মুক্তপক্ষ, নিভৃত অথচ স্রষ্টার জিকিরে প্রাণোচ্ছ্বল। এ জন্যে কবি নিজের বুককে কখনো পূর্ণ করছেন প্রত্যাশায়, কখনো রিক্ত করছেন অভিমানে, দৌর্বল্যচেতনায়। দেখা যাক কবির কেমন বিনয়োজ্জ্বল ও অভিমানোচ্ছ্বল অভিব্যক্তি,
এই ম্লান কদর্যের দলে তুমি নও,
তুমি বও
তোমার শৃঙ্খল-মুক্ত পূর্ণ চিত্তে জীবনমৃত্যুর
পরিপূর্ণ সুর ।

তাই তুমি মুক্তপক্ষ নিভৃত ডাহুক,
পূর্ণ করি বুক
রিক্ত করি বুক
অমন ডাকিতে পারো। আমরা পারি না ।
বেদনা-বিহ্বলতা যা সাধারণত ফররুখ আহমদের কবিতাকে তেমন আচ্ছন্ন করে নি, তাও কমবেশি এসেছে ডাহুক কবিতায়। এক অস্পষ্ট বেদনার ছায়াচ্ছন্নতা একটা আবেশ সৃষ্টি করে আছে এ কবিতায়। মধ্যরাতের নীরবতায় ঘন বনের অভ্যন্তর থেকে ভেসে আসছে এক বেদনার্ত সুর। কবিতায় কবি ভাবছেন জীবনের বন্দিত্ব ও তার বিষাক্ততার কথা। এ বেদনা-বিহ্বলতাও মূলত এসেছে আধ্যাত্মিক ও মরমী আবহ থেকে। কারণ পৃথিবীর তাবৎ আধ্যাত্মিক ও মরমী কবিতা বা সাহিত্যের একটি প্রধানতম সুর হলো বিরহ-বেদনা। বিরহী গানে সুরছন্দ দিয়েই মরমী কবিতার কাঠামো নির্মিত হয়।
কিছু কিছু আধ্যাত্মিক কবিতায় এক প্রকার ঘনীভূত বেদনার সুর অনুরণিত হয়। কী সে বেদনা? এ বেদনার ব্যাখ্যা আছে, আবার ব্যাখ্যা নেই, আছে শুধু মধুর আবেদন। এ আবেদন যুগে-যুগে সংক্রমিত হয়ে আসছে জনে জনান্তরে, মনে মনান্তরে। নশ্বর জীবনের অনিত্যতা, বিশ্বসংসারের কপট মায়ার অসারতা, সবকিছুর প্রতি ক্ষণিকের প্রবল আকর্ষণ, অবশেষে হতাশার অচ্ছেদ্য কুহকÑ এসব কিছু কবিদের ভাবনার জগৎ নির্মাণ করে ভিন্ন মোড়কে। তখনই সচকিত হয়ে তাদের দৃষ্টি  ও অন্তর্দৃষ্টি প্রসারিত হয় সুদূর অদৃশ্যলোকের পানে, যেখানে এক পরম সত্তা আছেন, যিনি গভীর কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছেন সাধকদের দিকে। মরমী ও আধ্যাত্মিক কবিদের সকল সাধনা ও আরাধনা, সকল পিপাসা ও জিজ্ঞাসা, সৃষ্টি ও কৃষ্টি, আবেদন ও সমর্পণ সেই পরম সত্তার সন্ধানেই নিবেদিত। তাই মর্মে-মূলে-মেজাজে পরম আধ্যাত্মিক কবিতা ডাহুকের সমাপ্তি হচ্ছে অনুরূপ এক বেদনাঘন পরিবেশ ফুটিয়ে,
বেতস লতার তারে থেকে থেকে বাজে আজ বাতাসের বীণা,
ক্রমে তাও থেমে যায়;
প্রাচীন অরণ্যতীরে চাঁদ নেমে যায়
গাঢ়তর হল অন্ধকার ।
মুখোমুখি বসে আছি সব বেদনার
ছায়াচ্ছন্ন গভীর প্রহরে ।
রাত্রি ঝরে পড়ে

পাতার শিশিরে...
জীবনের তীরে তীরে...
মরণের তীরে তীরে...
বেদনা নির্বাক ।

সে নিবিড় আচ্ছন্ন তিমিরে
বুক চিরে, কোন্ ক্লান্ত কণ্ঠ ঘিরে দূর বনে ওঠে শুধু
তৃষাদীর্ণ ডাহুকের ডাক।
ডাহুক কবিতার সাথে কবির কেমন আত্মিক বেগ ও আবেগের প্রগাঢ় প্রেম ছিল সেটা কবিকে নিয়ে লিখিত বিভিন্ন স্মৃতিচারণ থেকে বোঝা যায়। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ’ পালিত হয়। সেখানে ফররুখ আহমদের ডাহুক কবিতাটি আবৃত্তি করেন রফীকুল ইসলাম (পরে ডক্টর রফীকুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক)। অনুষ্ঠানের দর্শকদের মধ্যে কবিও ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে আবৃত্তিকারকে কবি কী-রকম স্নেহোষ্ণ আবেগের সাথে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, সেটা খোদ আবৃত্তিকারের স্মৃতিচারণ থেকে জেনে নিই,
“উনিশ শ’ তেষট্টি সালের দিকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ’ পালন করি। ঐ অনুষ্ঠান এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে এবং মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগায়। ঐ সপ্তাহে বাংলা কবিতার বিবর্তন প্রদর্শনী এবং আবৃত্তির মাধ্যমে দৃশ্যমান করে তোলা হয়েছিল। চর্যাপদ বা কাহ্নপাদ থেকে ফররুখ আহমদ পর্যন্ত আমরা প্রদর্শনী ও আবৃত্তির অন্তর্ভুক্ত রেখেছিলাম। আবৃত্তি ও পাঠের আসরে ফররুখ ভাইয়ের ‘ডাহুক’ কবিতাটি আমি আবৃত্তি করেছিলাম। আমি জানতাম না যে, সেদিন পাবলিক লাইব্রেরী মিলনায়তনের বাইরে হাজার হাজার দর্শকের মধ্যে ফররুখ ভাইও ছিলেন। আবৃত্তি আমি কেমন করেছিলাম জানি না, কারণ ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ’ আয়োজনের জন্যে এক মাস কাল ধরে আমাদের কয়েকজনকে দিবারাত্রি পরিশ্রম করতে হয়েছিল। প্রতিদিন সকাল থেকে প্রদর্শনী, সেমিনার ইত্যাদির পরে রাতে অনুষ্ঠানের সময় আমাদের আর কোন শক্তি অবশিষ্ট থাকত না, তবুও ফররুখ ভাই আমাকে আবেগের সঙ্গে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। ফররুখ ভাই তখন আবেগে টগবগ করছিলেন। আমি তাঁর বুকের দ্রুত স্পন্দন অনুভব করতে পারছিলাম। অদ্যাবধি আমি ফররুখ ভাইয়ের সেই উষ্ণ আবেগ ও হৃৎস্পন্দন অনুভব করতে পারি। তার আগে আমি অনেক আবৃত্তি করেছি কিন্তু অমন পুরস্কার কখনো পাই নি।” (অনন্য পুরস্কার, রফীকুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ : কবি ও ব্যক্তি, শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত, পৃ. ১৫২।)
৪॥
বক্ষমাণ প্রবন্ধে ডাহুক কবিতার কাঠামোগত ও মর্মগত সৌন্দর্য, সার্থকতা ও শ্রেষ্ঠত্বের আলোচনায় আমি মোটেও প্রবেশ করি নি। কবিতাটির বিষয়বস্তু, উপস্থাপনা, প্রয়োগ, চিত্রকল্প ও প্রতীকের নিপুণ ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা আমার উদ্দীষ্ট নয়। সে এক দীর্ঘ প্রসঙ্গ। আমি শুধু কবিতাটির রচনাপ্রেক্ষাপট (খোদ কবি বর্ণিত) এবং আধ্যাত্মিক দিকটার আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছি। তার কারণ, ডাহুক কবিতার পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ প্রায় সব আলোচনা-পর্যালোনায় এ দিকটি দৃষ্টিকটুভাবে বিস্মৃত হয়েছে। স্বতন্ত্র আলোচনার মধ্যে আমি পড়েছি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান ও ড. সদরুদ্দীন আহমেদের আলোচনা। প্রসঙ্গক্রমিক আলোচনাও পড়েছি অনেকের। সকলে আলোচনা করেছেন কবিতাটির আঙ্গিকগত ও বিষয়গত সৌন্দর্য ও মানোত্তীর্ণতা নিয়ে। আলোচিত হয়েছে জীবনান্দের ‘ডাহুকী’র সাথে মিলিয়ে উভয় কবিতার সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের কথা। এছাড়াও যারা একটু বিলাসী আলোচনা করেছেন, তারা কীটসের ‘নাইটিঙ্গেল’ এবং শেলীর ‘স্কাইলার্ক’ কবিতার সাথে মিলিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। স্বীকার করি, এসব আলোচনাও জরুরি। তবে কবিকথিত প্রেক্ষাপট ও রচনার মূল উদ্দেশ্যকে আলোচনায় গুরুত্ব না দেওয়ার কোনো যৌক্তিক কারণ দেখছি না বলেই আমি কিছু লেখার কসরত করলাম। আশা করি, কৌতূহলী গবেষকগণ দুর্বার অভিযান চালিয়ে কবিতাটির আরো নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবেন।
(অসম্পূর্ণ আলোচনা- লেখক)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ