শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সিডর ক্ষতিগ্রস্তদের ভাগ্যের পরিবর্তন না হলেও এনজিওর কর্মকর্তারা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ

খুলনা : সাত বছরেও সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলবাসী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি

আব্দুর রাজ্জাক রানা : আজ সেই ভয়াল ১৫ নবেম্বর। ২০০৭ সালের এই দিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা। স্মরণকালের ধ্বংসাত্মক ঘূর্ণিঝড়গুলোর অন্যতম সিডরের তান্ডবে লাখ লাখ ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। উপকূলজুড়ে এখনও শুকায়নি সিডরের ক্ষত। সাত বছরেও ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলবাসী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি। এখন আর তাদের কেউ খোঁজ নেয় না। সরকার বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো এখনো পুনর্বাসন হয়নি। আর বেসরকারি সংস্থাগুলো সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুঁজি করে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তারা একাধিকবার ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলীয় এলাকা পরিদর্শন করেন। আশ্বাস দিয়েছিলেন গৃহহারাদের বাড়ি-ঘর করে দেয়া, বেকারদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন না হলেও বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে গেছে।
ঘূর্ণিঝড় আইলা ও সিডরে পুনর্বাসনে সরকারকে প্রতিশ্রুতি দিয়েও অর্থ সহায়তা দেয়নি উন্নয়ন সহযোগী অধিকাংশ দাতা সংস্থা। ভারত, ইউএসএইড, ডিএফআইডি, মুসলিম এইড, একশন এইড, কুয়েত ফান্ড সিডরের পর কয়েকটি গ্রাম পুনর্বাসনের ঘোষণা দিলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। তান্ডবের পর নানাভাবে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিল বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও রাষ্ট্র। ওইসব প্রতিশ্রুতির সিকিভাগও পায়নি বাংলাদেশ সরকার। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ৬শ' ঘরবাড়ি আর দুটি মডেল গ্রাম তৈরি করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল ভারত। সাত বছরে তার আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের এক-দশমাংশও বরাদ্দ পায়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দিয়ে শত কোটি টাকার কাজ করালেও তাদের বিল না দেয়ায় তারা কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। বিধ্বস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেয়া অর্থ-সহায়তার পরিমাণও খুবই নগণ্য।
সিডরের সাত বছর পরও দক্ষিণাঞ্চলের বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ পুরোপুরি সংস্কার হয়নি। সাইক্লোন সেল্টারের সংখ্যাও অপ্রতুল। বাসস্থান পাননি বহু মানুষ। এখনও ঝুঁকির মধ্যেই বসবাস করছেন উপকূলের অর্ধকোটি মানুষ। এখনও সাগর বা পায়রা-বিষখালী-বলেশ্বরে জোয়ার এলে প্লাবিত হয় উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা। আবারও বিপর্যয়ের আশঙ্কায় আতঙ্কিত দিন যাপন করছেন উপকূলের মানুষ। সিডরদুর্গত এলাকার বাসিন্দাদের দাবি দ্রুত বাঁধ মেরামত করা হোক। না হয় নতুন করে তারা আবার নিঃস্ব হতে পারেন। সিডরে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধগুলোর বেশির ভাগ এখনও আগের মতোই আছে। বিকল্প বাঁধগুলো দিয়ে অল্প জোয়ারের পানিতে এখনও তালিয়ে যায় ফসলের জমি ও জনবসতি। মিঠাপানির সব উৎসও পুনঃস্থাপন হয়নি। সিডরকবলিত শরণখোলা, সাউথখালী, মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা, বরগুনা, তালতলী, কলাপাড়া, গলাচিপা, চরখালীসহ অন্যান্য এলাকায় এখনও বহু মানুষ ঘর পায়নি। জেলেদের অবস্থা আরও করুণ। তারা যে জাল ও ট্রলার সাহায্য হিসেবে পেয়েছিলেন তার বেশির ভাগই ব্যবহার করতে না পেরে বিক্রি করে দিয়েছেন। রয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, সুপার সাইক্লোন সিডরে দক্ষিণের ৩০ জেলার ২ হাজার ৩৪১ কিলোমিটার বাঁধ বিধ্বস্ত হয়। যার মধ্যে একেবারেই বিলীন হয়ে গেছে ৩৯১ কিলোমিটার বাঁধ। ১ হাজার ৯৫০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সূত্র জানায়, সিডরের পর ওই বাঁধ মেরামতের জন্য পাউবো ৭২২ কোটি ৮৩ লাখ টাকার চাহিদাপত্র পাঠালেও ১০ ভাগের একভাগও বরাদ্দ আসেনি। ফলে উপকূলের জনজীবনে ফিরে আসছে না নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, সম্প্রতি বেড়িবাঁধ নির্মাণের দুটি টেন্ডার সম্পন্ন হয়েছে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ ৩১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ হবে।
সাত বছরেও তেমন একটা বদলায়নি সিডর এলাকার পরিস্থিতি। এখনও মানুষকে চলতে হয় ভাঙাচোরা সড়ক দিয়ে। ফসলের জমি প্লাবিত করে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে ঢোকা সাগরের নোনা পানি। মেরামত না হওয়ায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে পটুয়াখালী এবং বরগুনার ২৮টি গ্রামে। প্রকৃতির নিদারুণ রোষে কৃষক থেকে জেলেতে পরিণত হয়েছেন বহু মানুষ। দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া ৬ লাখ বাড়িঘরের অধিকাংশ এখনও রয়েছে আগের অবস্থায়। দুর্গত মানুষের জন্য কিছু বাড়িঘরের বরাদ্দ হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা একেবারেই অপ্রতুল।
সাগর ও নদীবেষ্টিত উপকূলীয় জেলা বরগুনায় এখনও জোয়ারের পানি সামান্য বেড়ে গেলেই নিম্নাঞ্চলসহ বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাসকারীদের বাড়িঘর, ফসলি জমি তলিয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় রান্না-বান্না। জলোচ্ছ্বাস বা ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে আশ্রয় নেয়ার মতো পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার নেই। তাই মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই বরগুনার উপকূলীয় এলাকার মানুষ বসবাস করছে। সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ আজও সংস্কার হয়নি। এখনো এ অঞ্চলের মানুষ কখন বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে সব শেষ করে দেবে সে আশংকায় দিনাতিপাত করে।
সিডরবিধ্বস্ত এলাকার অসংখ্য মানুষ এখনও নিখোঁজ। আহত মানুষের সংখ্যাও প্রায় ১০ হাজার। ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার বেগের তীব্র ঝড়ের সঙ্গে স্থানভেদে ২০-৩০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে উপকূলের বিস্তীর্ণ জনপদের ফসল, গবাদিপশু, বনজ ও অন্যান্য সম্পদের ক্ষতি হয় ব্যাপক। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। সরকারিভাবে ১৫ লাখ ৭২ হাজার ৪৯৫টি পরিবারের ৬৬ লাখ ৬৯ হাজার ৪৫৬ জনকে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চার লাখ ৬১ হাজার ৩৯৯ একর জমির ফসল সম্পূর্ণ এবং ১২ লাখ ২৫ হাজার ৩০৪ একর জমির ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিধ্বস্ত হয় আড়াই হাজার কিলোমিটার বাঁধ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ