শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বাংলা ভাষার মর্যাদা ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার শপথ

স্টাফ রিপোর্টার : “একুশ আমার অহংকার, একুশ আমার চেতনা/ একুশ আমার শৌর্য-বীর্য, একুশ-ই মোর ঠিকানা।” -সত্যিকার অর্থেই একটি দিনের বদৌলতে একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ গোটা জাতি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শহীদ রফিক-জব্বারদের রক্ত ঋণ শোধে এদিন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের দীপ্র অঙ্গীকার নেয় সকলে। বাংলা ভাষা ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার শপথ ধ্বনিত হয় সবার কন্ঠে। অমর ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ সাল থেকেই মহান শহীদ দিবস আর জাতিসংঘের ঘোষণাক্রমে ২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে। গতকাল শনিবার এ উপলক্ষ্যে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ দেশে ও বিদেশে সকল শহীদ মিনারে মানুষের ঢল নেমেছিল। জনস্রোতে পরিণত হয়েছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, পলাশী, দোয়েল চত্বর, টিএসসি, বাংলা একাডেমিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণ। ভাষা সৈনিকদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষাকে বরণ করে নিতে ধর্ম-বর্ণ, বয়স, শ্রেণী-পেশা নির্বিশেষে সকলে মিলিত হয়েছিল এক কাতারে। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনসমূহ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর বিভিন্ন বিভাগ যথাযোগ্য মর্যাদায় মাতৃভাষা দিবস পালন করে।
শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে অর্থাৎ অমর একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে জাতির পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাষা শহীদদের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপনপূর্বক দিবসের কর্মসূচি শুরু করেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তারা কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এরপর জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। তারপরই বাংলাদেশে সফররত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ হাউস অব লর্ডসের স্পীকার ব্যারোনেস ডি সুজা ও সফররত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ সময় ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার পংকজ শরণ ও তার সফরসঙ্গিরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর ১২টা ৬ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রীসভার সদস্য ও সংসদ সদস্যদের সাথে নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
এরপর স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নেতৃত্বে ১৪ দল, বিরোধী দলের পক্ষে রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, আ স ম ফিরোজ, জিয়াউদ্দিন বাবলু, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল মোহাম্মদ ইনামুল বারী, নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল মুহাম্মদ ফরিদ হাবিব, ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সাবের হোসেন চৌধুরী, বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাই কমিশনারবৃন্দ, এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে শিক্ষক সমিতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সদস্যরা একে একে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
এর পরপরই জনসাধারণের জন্য শহীদ মিনার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। একে একে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ সময় শ্রদ্ধা জানায় শিল্পকলা একাডেমি, গণসংহতি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দরা, ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র মৈত্রী এবং রাজনৈতিক সংগঠগুলোর নেতৃবৃন্দরা। 
ভোর হতে না হতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের শিক্ষক কর্মচারী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নিজস্ব ব্যানার নিয়ে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানায়। ভোর সাড়ে ৬টায় বনানী কবরস্থানে ভাষা শহীদদের মাযারে ফাতেহা পাঠ ও দোয়া এবং পরবর্তীতে শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে সকল শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ (বিএসপিপি) এবং ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। এ ছাড়া ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ক্র্যাব), বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর, বঙ্গবন্ধু বিদ্যা নিকেতন, গণফোরাম, বাংলাদেশ ছিন্নমূল হকার্স, বদরুন্নেছা মহিলা কলেজ, বিআইডব্লিউটিসি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, শিক্ষা ও তথ্য মন্ত্রণালয়, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়, তেঁজগাও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্য পুস্তক বোর্ড, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন লীগ, কামরাঙ্গীচর ভাষা আন্দোলন স্কুল, বাংলাদেশ যুব অর্থনীতিবিদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি মাদরাসা-ই-আলিয়া, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার, অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ছায়ানট, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান শ্রদ্ধা জানায়। একুশে উদযাপন নির্বিঘœ করতে কেন্দ্রীয়সহ শহীদ মিনারগুলোতে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল।
পুত্রশোকে মূহ্যমান বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এবার শহীদ মিনারে যাননি। তবে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা এনাম আহম্মেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি বিশাল মিছিল পলাশী মোড় দিয়ে প্রবেশ করে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানায়। এ সময় চেয়ারপার্সনের অপর এক উপদেষ্টা অধ্যাপক মাজেদুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া এ সময় বিলকিস ইসলাম ও বিলকিস জাহান শিরীনের নেতৃত্বে জাতীয়বাদী মহিলা দল, সহ-সভাপতি এজমল হোসেন পাইলটের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ঢাকা মহাগনগর বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী যুবদল, ঢাকা মহানগর বিএনপি দক্ষিণ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের নেতাকর্মীরাও পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। শ্রদ্ধা শেষে তারা দোয়েল চত্বর হয়ে বেরিয়ে যান। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ভাষা শহীদদের জন্য বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।
দিনব্যাপী হাজার হাজার মানুষ নগ্নপায়ে বুকে শোকের প্রতীক কালো ব্যাজ লাগিয়ে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি- আমি কি ভুলিতে পারি’ গানের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও শহীদ দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে সব বয়সী মানুষের ঢল নামে। শ্রদ্ধা নিবেদনে শিশুদের আগ্রহটাই যেন বেশি। মুখে-হাতে একুশের আল্পনা আর লাল-সবুজের পোশাক পরে বাবা-মা’র সঙ্গে তারা শহীদ মিনারে আসে। ছোট্ট শিশু তানিয়া। বাবার হাত ধরে এসেছে শহীদ মিনারে ফুল দিতে। মুখে একুশের আল্পনা। তানিয়ার অনুভূতির কথা জানতে চাইলে সে বলে, ‘শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছি। অনেক মানুষ। খুব ভালো লাগছে। আব্বুর সঙ্গে এখন বই কিনতে যাবো।’ তানিয়ার বাবা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘তানিয়ার বয়স ৬ বছর। মিরপুরের একটি স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। আমি একুশের চেতনাকে ধারণ করি। মেয়েকে নিয়ে এসেছি তার মনেও যেন একুশ দাগ কাটে।’

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ