ঢাকা, বৃহস্পতিবার 18 April 2024, ০৫ বৈশাখ ১৪৩০, ৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী
Online Edition

ঢাকার গণপরিবহনে নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা গণভোগান্তি

গত দুই বছরে তেলের দাম বাড়েনি এক টাকাও। আনুষ্ঠানিকভাবে বাস ভাড়াও বাড়েনি। কিন্তু নানা কৌশলে যাত্রীদের পকেট থেকে বাড়তি টাকা আদায় হচ্ছেই। যথেচ্ছ ভাড়া আদায় গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলার একটি উদাহরণ মাত্র। ফিটনেসবিহীন গাড়ি আর লাইসেন্সবিহীন চালক এবং মালিকদের খেয়ালখুশিমতো চলছে রাজধানীর গণপরিবহন। পরিবহন মালিকদের এই নৈরাজ্য অবসানে প্রশাসনের নীরবতায় জিম্মি হয়ে আছেন যাত্রীরা। গত পাঁচ বছরে চার দফায় অভিযান চালানো হলেও শৃঙ্খলা আসেনি গণপরিবহন খাতে। যাদের অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করার কথা, সেই সরকারি সংস্থাই স্বীকার করছে, গণপরিবহনে গোঁজামিল চলছে গোড়া থেকেই।

সর্বশেষ ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল ডিজেলের দাম লিটারে ৭ টাকা বৃদ্ধি পায়। ওই সময় বাসভাড়াও বৃদ্ধি করা হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে রাজধানী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ১৬৮টি রুটে প্রায় সাড়ে প?াঁচ হাজার বাস-মিনিবাসের চলাচলের অনুমতি আছে। তবে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির হিসাবে এখানে বাস-মিনিবাস চলাচল করে সাড়ে সাত হাজার।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, ২০১১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে রাজধানীতে দুই দফা বাসভাড়া বাড়ানো হয়। প্রতি কিলোমিটারে মিনিবাসের ভাড়া এক টাকা ৫০ পয়সা। বড় বাসে ১ টাকা ৬০ পয়সা। মিনিবাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা, বড় বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা। তবে কোনো বাস-মিনিবাসেই ভাড়ার তালিকা নেই। ঢাকার প্রায় প্রতিটি রুটে সরকার নির্ধারিত হার না মেনে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাসেও একই চিত্র।মতিঝিল-বরাইঙ্গাইল রুটে চলাচলকারী বিআরটিসির বাসে সর্বনিম্ন বাড়া ৩০ টাকা! প্রেস ক্লাব থেকে আমিনবাজারের ভাড়া ৩০ টাকা। আবার প্রেস ক্লাব থেকে কারওয়ান বাজারের ভাড়াও ৩০ টাকা! অথচ সরকারের হিসাবে ভাড়া মাত্র ৭ টাকা। অন্য পরিবহনগুলোতে একই চিত্র।এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক (প্রশাসন) মশিউর রহমান সমকালকে বলেন, 'সর্বনিম্ন ভাড়া ৩০ টাকা হওয়ার সুযোগই নেই। তার পরও এমন হয়ে থাকলে এটা জুলুম ছাড়া কিছুই নয়।' এই কর্মকর্তা জানান, ভাড়া নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বিআরটিসির এনফোর্সমেন্ট বিভাগের। তবে বিভাগের আরেক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, 'ভাড়া নির্ধারণের দায়িত্ব আমাদের। কিন্তু তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পুলিশ ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের। নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আমাদের নয়।' তবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের একজন ম্যাজিস্ট্রেট সমকালকে বলেন, ভাড়া নিয়ন্ত্রণ নয়, যানবাহনের অনিয়ম দেখা আমাদের দায়িত্ব। আসলে এ ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে চান না কেউই।

প্রেস ক্লাব থেকে সিটি কলেজের দূরত্ব ২.৯ কিলোমিটার। প্রায় তিন কিলোমিটারের এই পথে ভাড়া হওয়ার কথা সাড়ে ৪ টাকা। সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা হওয়ায় যাত্রীদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৫ টাকা নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ১০ টাকা। কিন্তু কেন? মতিঝিল থেকে মোহাম্মদপুর রুটে চলাচলকারী এটিসিএল পরিবহনের টিকিট বিক্রেতা বাপ্পির কাছে জানতে চাইলে উত্তর দেন, আমাদের সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। যেখানে যান ১০ টাকা। মালঞ্চ পরিবহনেও একই চিত্র। প্রেস ক্লাব থেকে ধানমণ্ডি-১৫ পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ২৫ টাকা। এই পথে ভাড়া হওয়ার কথা ১২ টাকা।

আজিমপুর-উত্তরা পথের দিবানিশি পরিবহনে রামপুরা সেতু থেকে সোবহানবাগের ভাড়া ২০ টাকা। কিন্তু সোবহানবাগ থেকে রামপুরা যেতে ভাড়া ২৫ টাকা। অর্থাৎ একই পথে ভাড়ার ব্যবধান পাঁচ টাকা। বিকল্প অটো সার্ভিসের মিনিবাসে মতিঝিল থেকে মিরপুর ১২ নম্বরের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ২৪ টাকা। এই পথের দূরত্ব ১৪ দশমিক ৬ কিলোমিটার। মতিঝিল থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ১০ টাকা এবং ফার্মগেট থেকে মিরপুর পর্যন্ত ১৪ টাকা নেওয়া হয়। কিন্তু মতিঝিল থেকে ফার্মগেটের আগে যে কোনো স্থানে এবং ফার্মগেট থেকে আগারগ??াঁও গেলেও ১৪ টাকা নেওয়া হয়। অর্থাৎ এই মিনিবাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ ও ১৪ টাকা। গুলিস্তান থেকে ফার্মগেট হয়ে মিরপুর ১০ নম্বরে চলাচল করা ইটিসি, বিহঙ্গসহ বিভিন্ন মিনিবাসের ভাড়া যথাক্রমে ৮ ও ২০ টাকা। আবার গুলিস্তান থেকে এয়ারপোর্ট পথে চলা ৩ নম্বর রুটের মিনিবাসে ফার্মগেট পর্যন্ত নেওয়া হয় ৬ টাকা। দুই বাসে দুই রকম।ব্র্যাক ব্যাংকের বিপণন বিভাগের কর্মকর্তা কামাল ইবনে ইউসুফ সমকালকে বলেন, 'বাসে ভাড়ার অবস্থা যাচ্ছেতাই। প্রতিবাদ করলে অপমান-অপদস্থ হতে হয়। যাত্রীদের গায়েও হাত তোলা হয়। তার চেয়ে চুপচাপ দিয়ে দেওয়াই ভালো।' তবে বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবুল বশর সমকালকে বলেন, 'অতিরিক্ত ভাড়ার বিরুদ্ধে যাত্রীরাই সাক্ষ্য দেন না। তখন আদালতের কিছুই করার থাকে না।'

শুধু ভাড়া বেশি নয়, আসন বাড়িয়ে যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়িয়েও বাড়তি টাকা আদায় করে নিচ্ছেন মালিকরা। মিনিবাসে আসন থাকার কথা ৩১টি। সরকারি ভাড়া নির্ধারণ করা হয় ৭০ শতাংশ আসন বোঝাই ধরে। অর্থাৎ ২৬ জন যাত্রী পেলেই মালিকের লোকসানের আশঙ্কা নেই। কিন্তু ঢাকার কোনো মিনিবাসেই আসন সংখ্যা ৩১ নয়। ইটিসি পরিবহনের বাসে সরেজমিনে গণনা করে আসন পাওয়া গেল ৩৯টি। গুলিস্তান-এয়ারপোর্ট রুটের ৩ নম্বর বাসে আসন পাওয়া গেল ৪৩টি। যেখানে ২৬ যাত্রী পেলেই মালিকের লোকসানের আশঙ্কা থাকে না, সেখানে অন্তত ৪৩ যাত্রী নেওয়া হচ্ছে। দাঁড় করিয়েও নেওয়া হয় যাত্রী। সরকারি নিয়মে বড় বাসে আসন থাকার কথা ৫১। রাজা, সিটি, তরঙ্গ, তরঙ্গ প্লাস, বৈশাখী, উইনার বাসে গণনা করে আসন পাওয়া গেল ৬২ থেকে ৬৫টি।অতিরিক্ত আসনের বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক আবুল বশর সমকালকে বলেন, 'ঢাকায় এমন কোনো বাস পাবেন না যেখানে নির্ধারিত আসন আছে। যে বাসে ৩২ আসন থাকার কথা সেখানে ৪৪ আসনও পেয়েছি। গাড়ি জব্দ ও জরিমানা করা হয়েছে। কিছুদিন পর একই গাড়িতে অভিযান চালিয়ে দেখা গেছে, আবারও সিট বাড়ানো হয়েছে।' এ অবস্থার জন্য নিজেদের দায়ী করেন আবুল বশর। তিনি সমকালকে বলেন, 'প্রতিটি বাসকে প্রতি বছর ফিটনেস সার্টিফিকেটের জন্য বিআরটিএতে যেতে হয়। তখনই তো আটকে যাওয়ার কথা। কিন্তু কীভাবে যেন এসব যানবাহন ফিটনেস সনদ পেয়ে যায়।'

তবে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ দাবি করেন, 'তেলের দাম না বাড়লেও চালক, সহকারীর বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে। সব যন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে। কিন্তু সরকার ভাড়া বৃদ্ধি করেনি। ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়মিত পর্যালোচনা করা উচিত।' তবে যথেচ্ছ বাসভাড়া বৃদ্ধির অভিযোগ ঠিক নয় বলে দাবি করেন এই পরিবহন নেতা। তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা হলেও অনেক ক্ষেত্রে ২ টাকা ভাড়াও নেওয়া হয়।

তবে আরেকজন মালিক সমকালকে বলেন, ভাড়া নির্ধারণ কমিটি শুধু কর্মচারীর বেতন, তেল খরচ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হিসাব করে। কিন্তু একজন মালিককে আরও ১০ খাতে টাকা দিতে হয়। দুটি সমিতিকে দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদা দিতে হয়। পুলিশকে টাকা দিতে হয়। তবে কোনো পরিবহন মালিক এসব বিষয়ে নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।যাত্রী কল্যাণ সমিতির সমন্বয়ক মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, 'কোনো রুটেই নির্ধারিত ভাড়া হয়নি। এ-সংক্রান্ত অভিযোগ কয়েক দফায় মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএকে জানিয়েছি। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। যাত্রীদের চেয়ে মালিকরা অনেক শক্তিশালী। যাত্রীদের কথা কেউ শোনে না।' তিনি জানান, ভাড়া নির্ধারণ কমিটিতে পুলিশ, প্রশাসন, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধি থাকলেও যাত্রীদের কোনো প্রতিনিধি নেই। কমিটি মালিকদের স্বার্থ রক্ষাকারী।

কিন্তু ভাড়া ও সেবা নিয়ে মালিকদের এই নৈরাজ্য থামাতে সরকারি উদ্যোগ দেখা যায় প্রতি বছরই। গত বছরের ১০ নভেম্বর থেকে অভিযান শুরু করে বিআরটিসি। কিন্তু সাত দিন পার না হতেই অভিযান স্তিমিত হয়ে যায়। বিআরটিএর হিসাবে রাজধানীতে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা ৯৩ হাজার ৬০৪। কিন্তু অভিযানে মামলা হয়েছে চার শতাধিক গাড়ির বিরুদ্ধে। অভিযানের সময় রাস্তায় না নেমে পাড় পেয়ে গেছে এসব গাড়ি। এর আগেও ২০০৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত তিন দফায় অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। মালিকদের বিরোধিতার মুখে কোনোবারই সফল সমাপ্তি হয়নি। এ প্রসঙ্গে বিআরটিএর একজন ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, 'অভিযানের অভিজ্ঞতা হলো, নানা বাস্তবতায় কিছুদিন পর তা বন্ধ হয়ে যায়।' বিআরটিএর পরিচালকের দাবি, গত নভেম্বরে শুরু হওয়া অভিযান এখনও চলছে। পাঁচজন ম্যাজিস্ট্রেটের ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছেন। তবে মশিউর রহমান নিজেই স্বীকার করেন, অভিযানে আগের গতি নেই।-সমকাল

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ