ঢাকা, শুক্রবার 29 March 2024, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী
Online Edition

গৃহস্থালি বাজারের অভ্যাস বদলে জনপ্রিয় সুপারশপ

ঝাড়ু বা ঝুল ঝাড়ন অথবা তৈজসপত্র, মানে হাড়ি-কুড়ি, বাসন পেয়ালা, ষ্টেশনারী জিনিসপত্র---এক আউটলেটেই সব পাওয়া যায়

একসময় মাছ-মাংস কি সবজি, মসলা কিংবা গৃহস্থালি পণ্য কেনার ক্ষেত্রে বাসাবাড়ি সংলগ্ন বা কাছের বাজারগুলোই ছিল একমাত্র ভরসা।

সময়ের সাথে সাথে, নিত্য প্রয়োজনীয় সব পণ্য এক ছাদের নিচে, নির্ধারিত মূল্য আর যথাযথ মানের আশ্বাস নিয়ে, পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সুপার শপগুলো ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে এখন।

তবে, তাতে চাহিদা কমেনি নিউ মার্কেট, কাপ্তান বাজার বা মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের মত ঐতিহ্যবাহী বাজারগুলোর।

দিনের শুরুতে বাজারে গিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসাতাজা শাক-সবজি, নানা ধরনের মাছ, মাংস, আর ফল নিয়ে বিক্রেতাদের ব্যস্ত হাঁকডাক, ক্রেতা-বিক্রেতার দরদাম---শেষে পছন্দের জিনিস বাজারের থলেতে পুরে হৃষ্টচিত্তে বাড়ি ফেরার দৃশ্য আমাদের খুব চেনা।

তবে, ক্রমে সময় বদলাচ্ছে।

গত প্রায় এক যুগের কিছু বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে রোজকার গৃহস্থালি বাজারের অভ্যাসে ধীরে ধীরে পরিবর্তন এসেছে।

এক ছাদের নিচে নিত্য প্রয়োজনীয় সব পণ্য, নির্দিষ্ট মূল্য আর যথাযথ মানের আশ্বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করা সুপার শপগুলো ক্রমে মানুষের কাছে পছন্দের বিকল্প হয়ে উঠছে।
সুপার শপের সব পন্য আসে নির্ধারিত সরবারহকারীর কাছ থেকে

সুপার শপগুলোতে কাঁচাবাজার অর্থাৎ মাছ মাংস, সবজি, তরকারি আর ফল চাই, কি দৈনন্দিন কাজের জিনিসপত্র, তা সে ঝাড়ু বা ঝুল ঝাড়ন বা তৈজসপত্র, মানে হাড়ি-কুড়ি, বাসন পেয়ালা, ষ্টেশনারী জিনিসপত্র---এক আউটলেটেই পাবেন সব।

এখনকার বহু নাগরিক পরিবারে দেখা যায় স্বামী-স্ত্রী দুজনই কাজ করেন।

ফলে হয়ত দিনের শুরুর বাজারের কাজটি তাদের করতে হয় বিকেলে বা সন্ধ্যায়।

আবার কেউ আছেন নিত্য কাঁচাবাজারে যাওয়াকে এক ধরণের হ্যাপা মনে করেন।

কেউ আছেন সারাদিন কাজ করে দরদাম করার হাঙ্গামায় আর যেতে চান না।

“এখানে কোয়ালিটি মেনটেইন করা হয়, সেই বিশ্বাস থেকে আসি। তাছাড়া আমরা তো খুব ব্যস্ত জীবনযাপন করি, ফলে সময় মত মানে সকালে বাজারটা করা হয় না। ফলে সন্ধ্যায় এখানে বাজার করতে পারি।”

“এখানে গৃহস্থালির সব জিনিস এক জায়গায়, এক সঙ্গে থাকে। ফলে সময় বাঁচে আমাদের। ফল ও অন্যান্য সব কিছু টাটকাই থাকে।”

“এখানে ডিসকাউন্ট কার্ডের সুবিধা পাওয়া যায়। প্রয়োজনে নগদে পাওনা শোধ না করে, কার্ডে বিল দেয়া যায়। এটা নিরাপদ অনেক।”

২০০১ সালে ঢাকার রাইফেলস স্কয়ারে রহিমআফরোজ গ্রুপের সুপার শপ আগোরো যাত্রা শুরুর মাধ্যমে বাংলাদেশে সুপারশপের যাত্রা শুরু হয়।

এরপর একে একে বেশ কটি নামকরা প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়।

এদের বেশিরভাগই নগর কেন্দ্রিক।
দামে সাশ্রয়ী এবং তাজা পন্যের আশায় এখনো অনেকেই নির্ভর করেন নিউ মার্কেটের মত ঐতিহ্যবাহী বাজারের ওপর

ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরেও এখন সুপার শপ বা বড় ডিপার্টমেন্টাল শপ ছড়িয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ সুপার শপ মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী দেশে এই মূহুর্তে বিভিন্ন আকারের আড়াইশ’ থেকে তিনশত সুপার শপ রয়েছে।

যাদের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ প্রায় কুড়ি হাজার কোটি টাকা।

সুপার শপে কিভাবে পণ্যের মান নিশ্চিত করা হয়?

আর প্রায়ই সাধারণ বাজারের থেকে বেশি দাম নেয়ার যে অভিযোগ শোনা যায় তার কারণ কি?

জিজ্ঞেস করলে বাংলাদেশ সুপার শপ মালিক সমিতির সভাপতি এবং রহিম আফরোজ সুপারষ্টোরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়াজ রহিম জানান, সুপার শপে যেকোন পন্য নির্দিষ্ট সরবারহকারীর কাছ থেকে নেয়া হয়।

“সুপার শপে রাখা সব পণ্যই আসে নির্দিষ্ট সোর্স থেকে। এমনকি, মাংস নেবার সময়ও আমরা আমাদের নির্ধারিত কসাই এর কাছ থেকে মাংস নিই। নির্দিষ্ট কসাই এর কাছ থেকে, গরুকে যথাযথভাবে পরীক্ষা করিয়ে, ঠিকমত বিশ্রাম দিয়ে, এরপর মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী জবাই করিয়ে, তার মাংস নেয়া হয়।”

“আমরা আমাদের সবগুলো সোর্স চিনি। এমনকি শাকসব্জির ক্ষেত্রে ও তাই। সেকারণে আমরা কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে পারি। অন্য কেউ কম দামে দিলেও আমরা সেটা নিইনা।”

তবে মি. রহিম বলছেন, নাগরিক মানুষেরা যেভাবে খুব সহজে সুপার শপকে গ্রহণ করেছেন, সে তুলনায় এ খাতের প্রসার ঘটেনি।

প্রথম সুপার শপ স্থাপনের পর ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো সুপারশপের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল।

সেক্ষেত্রে সরকারের আরো নীতি সহায়তা দেয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন মি. রহিম।
দিনের শুরুতে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে আসে তাজা মাছের চালান

কিন্তু অন্যদিকে, সুপারশপের বিস্তারের পাশাপাশি এখনো সগৌরবে টিকে আছে দেশের ঐতিহ্যবাহী বাজার নিউমার্কেট, কাপ্তান বাজার কিংবা মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটের মত বাজারগুলো।

সেখানকার একটি নির্দিষ্ট ক্রেতা গোষ্ঠী রয়েছেন, যারা এখনো প্রতিদিনকার ব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে প্রয়োজনে ছুটির দিনে কাঁচাবাজার থেকেই প্রয়োজনীয় বাজার করে থাকেন।

ঢাকার অন্যতম পুরনো ও ব্যস্ত কাচা বাজার নিউ মার্কেট।

এখনকার ক্রেতাদের বেশিরভাগই বলছেন, তাজা পণ্য এবং দামে কিছুটা সাশ্রয় হবার কারণে তারা সুপার শপে যাওয়া এখনো পছন্দ করেন না।

“এখানে দামাদামি করা যায়, সেজন্য এটা ভালো লাগে। ওখানে তো ফিক্সড প্রাইসে কিনতে হয়।”

“এখানে সব টাটকা জিনিস, কিন্তু সুপার শপে তো সব এনে ফ্রিজে রাখে। তাই সেখান থেকে ফলমূল কিনতে ইচ্ছা হয় না।”

“এখানে যেসব পণ্য কিনি তার সবই হয়তো আমার পাড়ার বাজারেও পাওয়া যায়, কিন্তু এখানে পাই মাত্র ঘাট থেকে আনা তাজা মাছ, আর ফ্রেস সবজি। দাম রিজনেবল, মোটেই বেশি না।”
নিউ মার্কেটের মত সুপার শপগুলোতে এখন এমন খাচাভর্তি মুরগি পাওয়া যায়

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি হিসেব অনুযায়ী ঢাকায় মোট কাচা বাজারের সংখ্যা প্রায় দুইশো।

সুপার শপের উত্থানের কারণে এখনো ঢাকার কোন কাঁচাবাজার বন্ধ হয়ে গেছে, কিংবা ক্রেতা সংখ্যা কমে গেছে এমন কোন হিসেব পাওয়া যায়নি।

কিন্তু তা সত্ত্বেও সাধারণ কাচা বাজারের অনেক বিক্রেতা আক্ষেপ করলেন, তাদের ভাষায় পাড়ার দোকানগুলোর জন্য তাদের ক্রেতা কমে গেছে।

“আমাদের এখানে এখন লোক অনেক কম। ঘাটের থেকে যে জিনিস একশ’ ত্রিশ টাকা কই মাছ কিনে আনি, একশ’ সত্তর বা আশি টাকা বেচি। কিন্তু তবু কাষ্টমার পাই না।”

তবে, নতুন জমানার বাজারের উত্থান আর তার এগিয়ে যাওয়ার গল্প, এত সরল নয়।

অনেক সময়ই যেমন ক্রেতাদের অভিযোগ করতে শোনা যায়, সুপার শপগুলোতে পণ্যের দাম বাইরে যেকোনো স্থানের চেয়ে বেশি, কিংবা পণ্য মানসম্মত নয়।

আবার, অনেক সময়ই গণমাধ্যমের খবরে দেখা যায়, মানহীন বা মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য রাখায় সুপার শপগুলোকে জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমান আদালত।

সেক্ষেত্রে সুপারশপের নিজস্ব মান নিশ্চিত করার যে প্রতিশ্রুতি তা কতটা বাস্তবসম্মত?

আগোরা’র প্রধান নির্বাহী মি. রহিম বলছেন, “আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন সুযোগ দেয় না। অন্য কোন ল্যাবরেটরীকে সরকার স্বীকৃতি দেয় না। এক সংস্থার অনুমোদন দেয়া পণ্য আমরা রাখছি, অন্য সংস্থা সেটা স্বীকার করেনা। আমরা আজ কোন ভুল বা নিম্নমানের পণ্য দিয়ে পালিয়ে যাব, তা হবে না।”

বহু ক্ষেত্রেই ভোক্তা স্বার্থ দেখার দেখা কিংবা ভোক্তা স্বার্থ পরিপন্থী কাজের জন্য জবাবদিহিতা করতে কোন প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করার নজির এখানে দেখা যায় না।

আবার বহু ক্ষেত্রে বলা হয়, সুপারশপের মালিকপক্ষ অনেক সময় প্রভাব খাটিয়ে রেহাই পেয়ে যায়।

বাংলাদেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে কাজ করে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।

সংস্থাটির সভাপতি গোলাম রহমান বলছেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে অনেক সময়ই শাস্তি পায় না অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান, পেলেও অনেক সময়ই তা হয় লঘু দণ্ড।

“আমার দৃষ্টিতে সুপার শপ যে জরিমানা দেয়, তা খুবই লঘু দণ্ড। এরা যেহেতু দাম বেশি রাখে এবং মানুষ বিশ্বাস করে তারা সঠিক মানের পণ্য দেয়, ফলে এদের শাস্তি দৃষ্টান্তমূলক হওয়া উচিত।”

“ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার মত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলে একটি সরকারী কাঠামো আছে, কিন্তু তার লোকবল এবং প্রচার প্রচারণা দুটোই খুব কম।”

তবে, ভোক্তা স্বার্থ পরিপন্থী এবং মানহীন ও ভেজাল পণ্য সরবারহের অভিযোগ কাচা বাজারের বিরুদ্ধেও রয়েছে।

সেক্ষেত্রে মি. রহমান বলছেন, ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে।

বিদ্যমান যেসব আইন রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা এবং দৃষ্টান্তমূলক প্রয়োগ নিশ্চিত করলে এসব সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ