মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জন বর্ণ : ক্রসফায়ার কোন বর্ণ

জিবলু রহমান : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় উল্লেখ আছে, ‘যাহাতে মনুষ্যত্বের অপমান হয় তাহা কখনোই উন্নতির পথ হইতে পারে না’। আরেক কবি বলেছেন ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথায় কবে’। জন্মের অনিবার্য পরিণতি মৃত্যু। কারও সম্পর্কে একটি ভবিষ্যদ্বাণীই শতভাগ নির্ভুলভাবে বলা যায়, সেটা হল-আপনি মারা যাবেন। তারপরও কারও মৃত্যু সংবাদ শুনলে আমরা দুঃখ পাই, ব্যথিত হই। একজন মানুষ এই বিশাল পৃথিবীর জনারণ্যে মিশেছিলেন, কিন্তু এখন আর নেই। মৃত্যু তাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। তার এই না থাকা কোথাও কোনো শূন্যতা প্রকৃত অর্থে তৈরি করে না, অথচ কারও না থাকার খবর শুনে আমাদের মধ্যে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়, আমরা বেদনা বোধ করি। তবে আজকাল এতো বেশি মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর আমরা শুনছি যে আমাদের মধ্যে মৃত্যু শোকের কাতরতা আর সেভাবে কাজ করছে না। ‘আমরা অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর’।

 আমরাও বোধ হয় পাথর মানুষে পরিণত হতে চলেছি। অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যু হবে- এটাও যেনো একটি অবধারিত সত্য হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। তাই নির্মল সেনের মতো এখন আর কোনো সাংবাদিক ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ বলে আর্তি জানিয়ে কলাম লেখেন না। এমনকি আস্থাহীনতা এতোটাই প্রবল হয়েছে যে, ঘাতক চক্রের হাতে নির্মমভাবে খুন হওয়া সন্তানের পিতা ও পুত্র হত্যার বিচার চান না। যার প্রমাণ ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর নিহত দ্বীপনের পিতা আবুল কাসেম ফজলুল হকের আর্তনাদ। তিনি বলেছেন, হত্যাকারীদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।

কারণ তিনি জানেন, হত্যার বিচার চাওয়ার কোনো মূল্য নেই। কেউ খুন হবেন, খুনিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে, বিচার হওয়া তো দূরের কথা, একদিন সবকিছু আমরা ভুলে যাবো। এমনটাই এখন আমাদের দেশে হচ্ছে। 

অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পুলিশ বাহিনী রয়েছে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে যে পুলিশ বাহিনী বিদ্যমান, সেটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ঐতিহ্য বহন করে। ১৮৫৭ সালের সিপাহী অভ্যুত্থানের পর ইংল্যান্ডের রাণী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে এ দেশ শাসনের দায়িত্ব সরাসরি নিজ হাতে তুলে নেন। ১৮৬১ সালে এ অঞ্চলে জনশৃংখলা ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য দারোগা অ্যাক্ট প্রণীত হয়। এ আইনানুযায়ী দারোগাদের বেতনভাতা দেয়ার দায়িত্ব ঔপনিবেশিক সরকারের ওপর ছিল না। বলা হয়েছিল দারোগাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব দারোগার ক্ষমতাধীন এলাকার জনগণের ওপর বর্তাবে। 

দারোগা আইনের সুযোগে দারোগা এবং তার অধীনস্থ পুলিশরা জনগণের কাছ থেকে চাল-ডাল, তেল, নুন, সবজি, মাছ-মুরগি, গরুর দুধ, ঘি, মাখন প্রভৃতি সংগ্রহ করে নিতো। এভাবেই ঔপনিবেশিক পুলিশরা স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিয়ে জনগণকে রক্ষার নামে নানা রকম প্রদেয় আদায় করতো। বোধহয় এ কারণেই পুলিশ বাহিনী স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য রাষ্ট্র নিয়মমাফিক বেতনভাতা দিয়ে পুলিশ বাহিনীকে পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুলিশের পুরনো অভ্যাস সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে বলা যাবে না।

আমাদের জীবন স্বাভাবিকভাবে চলার জন্য যে দায়িত্ব পালন করে সেই বাংলাদেশের পুলিশের বিরুদ্ধে নাগরিকদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতনের মাধ্যমে ব্যাপক হারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ যথেষ্ট পুরনো। কখনো কখনো পুলিশের গুলীতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ কয়েকটি জেলায় মানুষের শরীরে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলী করে হত্যা করেছে পুলিশ। সরকারের নির্দেশেই র‌্যাব-পুলিশ সদস্যরা আইনবহির্ভূত এ সব কাজ করছে বলে বিস্তর অভিযোগ সংবাদপত্রে প্রকাশ পেয়েছে। 

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বর্বরতা সব সীমা অতিক্রম করেছে। একের পর এক নজিরবিহীন বর্বরতা ঘটিয়ে চললেও তারা সব রকম জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে চলে গেছে। বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার, বিভিন্ন ইস্যু গ্রেফতার বাণিজ্য, রিমান্ডে নিয়ে বর্বর নির্যাতন করে পঙ্গু ও হত্যা করা, ঘুষ গ্রহণের জন্য গ্রেফতার ও নির্যাতন, টাকার বিনিময়ে গুম ও ক্রসফায়ারের মতো ঘটনা ঘটছে অহরহই। 

 সরকার পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। পুলিশ বাহিনীকে দলীয় সংগঠনে পরিণত করেছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘আমরা পুলিশকে কখনও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাই না।’ (সূত্রঃ দৈনিক মানব জমিন ২৩ জানুয়ারি ২০১৩)

পুলিশে পিটুনি, টিয়ারশেল নিক্ষেপ- এগুলো এখন বাসি হতে চলেছে। এখন ‘দেখামাত্র গুলী’ করতে পুলিশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। প্রতিবাদী জনতার ওপর পুলিশের গুলীতে এ রকম মৃত্যু সভ্য দুনিয়ায় তো অচিন্তনীয় ব্যাপার, এমনকি আফ্রিকার জংলি শাসনেও এমন নজির অন্তত সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি। স্বভাবতই পুলিশের হাতে এরকম মৃত্যুকে দেশের মানুষ গণহত্যা বলে আখ্যা দিয়েছে। অবশ্য এতে জোর আপত্তি মহাজোটের। নিরস্ত্র প্রতিবাদী জনতাকে গণহারে হত্যাকে ‘দুর্বৃত্তদের মৃত্যু’ বৈ অন্য কিছু বলতে নারাজ তারা।

দৈনিক আমার দেশ ৭ জানুয়ারি ২০১৩ ‘বিএনপি নেতাকে গুম করে খুন ঃ র‌্যাবের অস্বীকার-ঢাকার ৫৬ নং ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদক রফিকের লাশ পাওয়া যায় কুমারখালীতে’, দৈনিক নয়াদিগন্ত ১০ এপ্রিল ২০১৩ ‘আতঙ্কের নাম সাদা পোশাকের পুলিশ আর কালো গ্লাসের গাড়ি’, দৈনিক আমার দেশ ১৫ মে ২০১৩ (অনলাইন) ‘রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে আবারও র‌্যাব ঃ রাজশাহীতে ক্রসফায়ারে শিবির নেতা-৯ দিন নির্যাতনের পর পরিকল্পিতভাবে হত্যার দাবি পরিবারের’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দৈনিক আমার দেশ ৩১ মে ২০১৩ ‘নিরাপত্তা বাহিনীর বর্বরতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে’ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। 

পুলিশ হেফাজতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানার ওসির বর্বর নির্যাতনে শামিম রেজা নামে এক যুবকের করুণ মৃত্যু নিয়ে তোলপাড় হয়েছে। নিহতের বাবা আলাউদ্দিনের কাছ থেকে পুলিশ ৬ লাখ টাকা উৎকোচ নিয়েও শামিমকে নির্যাতন চালিয়ে হাত-পা ভেঙে দেয়। এরপর হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। পুলিশি তদন্তেও শামিমকে হত্যার জন্য তিন পুলিশ কর্মকর্তা ওসি (তদন্ত) অরূপ তরফদার, এসআই পল্টু ঘোষ এবং এএসপি উত্তম প্রাসাদকে দায়ী করা হয়েছে। 

দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ২০১২ সালেও অব্যাহত ছিল। তথাকথিত ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার ও বন্দুকযুদ্ধের নামে মৃত্যু হয়েছে কয়েকজনের। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুযায়ী ২০১২ সালে পুলিশ, র‌্যাব ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৬ জন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে আরও ২৮ জনের। নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে ২০১২ সালে। 

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার জরিপে পুলিশের হেফাজতে আত্মহত্যা করেছে ২ জন। পুলিশ হেফাজতে রিমান্ডের নামে নির্যাতন ২০১২ সালেও অব্যাহত ছিল। হাইকোর্টের নির্দেশনা, মানবাধিকার সংস্থা ও সুশীল সমাজের উদ্বেগ উৎকণ্ঠাও ছিল পুলিশের রিমান্ড নামক ‘অস্ত্র’ প্রয়োগে। ২০১২ সালে শুধু ঢাকা জেলা মহানগর ও দায়রা জজ আদালতে ৪ হাজার ৮২৯ জনকে পুলিশী রিমান্ডে নেয়া হয়েছে অপরাধের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। এর মধ্যে ২০ বছরের অন্তঃসত্ত্বা নারীও বাদ যায়নি রিমান্ড থেকে।

২০১৩ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়, ‘বর্তমানে কারাগারে আটক লোকদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই বিনাবিচারে আটক রয়েছেন। ২০১২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫৬ হাজার।’

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব মতে ২০১০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ২৬৮ জন অপহৃত হন। তাদের মধ্যে ৪৩ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। অপহরণের পর ২৪ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়। পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয় ১৪ জনকে। 

যদিও অনেকের ধারণা প্রকৃত গুমের ঘটনা আরও বেশি। সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন ১১ মে ২০১৪ হাইকোর্টে স্মরণ করেছেন ঐতিহাসিক সত্য, ‘বেঁচে থাকার অধিকার মৌলিক অধিকারের মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক।’ (সূত্রঃ দৈনিক মানব জমিন ১৪ মে ২০১৪)

আবার ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নিয়ে কথা উঠেছে! আবার সেই বহুলশ্রুত বন্দুকযুদ্ধের গল্প-আসামীকে নিয়ে পুলিশের অস্ত্র উদ্ধার বা আস্তানায় অভিযান। সেখানে বা পথিমধ্যে সহযোগীদের গুলীবর্ষণ। আত্মরক্ষার্থে পুলিশের পাল্টা গুলী। ওই গুলীতে আসামী নিহত। কিংবা আসামীর পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা বা তাকে সহযোগীদের ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা। বাধ্য হয়ে পুলিশের গুলী। যার বলি ১,৭১৫ জন (জুন ২০০৪-২০১৬ পর্যন্ত) আসামী। তন্মধ্যে ২০১৬ সালের জুন মাসেই নিহত ১৪ সন্দেহভাজন জঙ্গি। (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ২০ জুন ২০১৬)

এখন একের পর এক যেভাবে ক্রসফায়ার চলছে, অনেকেই চিন্তিত। এটা ঠিক যে ক্রসফায়ারে মূলত দাগি কিছু আসামী, জঙ্গি সন্ত্রাসী বা গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিই মারা যান। কিন্তু মারা যেতে হবে কেন? এখানেই প্রশ্ন। আদালতে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কি তাঁদের অপরাধী হিসেবে সাজা দেয়া যায়? তাই পুলিশের কাজ হলো অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ধরে বিচারের সম্মুখীন করা। তারপর আদালত জানেন কী করতে হবে। কিন্তু তার আগেই পুলিশ তাদের নিয়ে যাচ্ছে ‘স্বীকারোক্তি’ অনুযায়ী অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার বা অন্য অভিযুক্ত অপরাধীদের ধরতে এবং সেখানে চিরাচরিত প্রথায় ‘ওত পেতে থাকা কিছু অপরাধী পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ শুরু করে এবং আসামী মারা যায়’! (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো ৩ জুলাই ২০১৬) 

মাহজোটের আমলে আতঙ্কের নাম সাদা পোশাকের পুলিশ আর কালো গ্লাসের গাড়ি। শুধু বিরোধী নেতা-কর্মীরাই নন, সাধারণ মানুষও এখন তাদের দাপটে আতঙ্কগ্রস্ত। কখন কাকে আটক করে নিয়ে যাবে সেই আশঙ্কায় থাকতে হয় মানুষকে। এমনকি পেশাজীবীরাও এর বাইরে নন। অনেককে দিনের পর দিন আটকে রেখে নানা অভিযোগে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হচ্ছে। হাজির করা হচ্ছে মিডিয়ার সামনে।

গত কয়েক মাসে সারা দেশে পুলিশ বাহিনীর কেউ কেউ যে কাণ্ড ঘটিয়েছে, তার ফলে মিডিয়া ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। একাধিক সংবাদপত্রে এ বিষয়ে সম্পাদকীয় নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। বিরোধী দলের সাবেক চীফ ইইপ জয়নাল আবেদীন ফারুককে পেটানোর ঘটনায় ডিসি হারুনকে পুলিশ পদক দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলে দেশের কোনো রাজনৈতিক শক্তির জন্যই ভাল হবে না। মনে রাখা উচিত ক্ষমতা সবসময় হাত বদল হয়। পুুলিশ দ্বারা নির্যাতন করে যে আগুন মহাজোট ঘরে ও বাইরে জ্বালিয়েছে তার ফলাফল অচিরেই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। 

ব্যাপক ক্ষমতা পাওয়ার পর দিন দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে পুলিশ। পুলিশের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অর্থ আদায়ের জন্য নির্যাতনের অভিযোগের হিড়িক উঠলেও দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় দিনে দিনে আরো বেপরোয়া পুলিশ। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে তদন্তের নামে প্রত্যাহার করা হয়। পরে আবার তাকে আরো ভালো পদে পদায়ন করার ঘটনা ঘটছে। ‘সেবাই পুলিশের ধর্ম’ প্রতিটি থানার সামনে লেখা থাকলেও কার্যত পুলিশের সেবা নেয়া তো দূরের কথা এখন পুলিশের নিকট থেকে ক্ষতিকারক কিছু থেকেই মানুষ বাঁচতে চায়। ধনাঢ্য ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষকে ধরে নির্যাতন করে অবৈধভাবে টাকা আদায় পুলিশের এখন নিয়মিত কাজে পরিণত হওয়ায় জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অবৈধভাবে অর্থ কামাইয়ে পুলিশের নির্যাতন ও অপরাধ বেড়ে যাওয়া নিয়ে মানবাধিকার এবং বিশিষ্টজনেরা বলেন, সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করে পুলিশ পার পেয়ে যেতে পারে বলেই বারবার এমনটি ঘটছে। বলা হয়ে থাকে, যারাই অপরাধ করে, অভিযুক্ত সেই পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু বাস্তব দৃশ্যমান নয়। দলীয়করণের কারণেও অপরাধী পুলিশ সদস্যরা পার পেয়ে যায়। 

নানা অভিযোগে ঢাকা মহানগরে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দৈনিক প্রায় ২০টি অভিযোগ জমা পড়ছে আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফতর, ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়সহ ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভিন্ন বিভাগ, জোন ও থানাগুলোয়। এর ভয়াবহতা আরও সুস্পষ্ট হয় ডিএমপি পুলিশ কমিশনারের ১৭ জুন ২০১৫ দেয়া এক অফিস আদেশে। সেই আদেশে কতিপয় পুলিশ সদস্যের সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড তুলে ধরে ঢাকার সব ইউনিট ইনচার্জকে তাদের অধীনে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের চালচলন, আচরণ, কর্মকাণ্ড প্রভৃতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে অপরাধী পুলিশ সদস্যদের কঠোর বিভাগীয় বা আইনগত শাস্তির আওতায় আনতে নির্দেশ দেয়া হয়। 

বর্তমানে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় টহল পুলিশ, বিশেষ করে রাতে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশের ইউনিটগুলো সম্পর্কে বিস্তর অভিযোগ সাধারণ নগরবাসীর। মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে নিরীহ মানুষকে সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে আটক করা হয়েছে বলে জানানো হয় বা হত্যাসহ কোনো গুরুতর মামলার সন্দেহভাজন আসামী কিংবা মাদক-কারবারি হিসেবে আদালতে চালান করা হবে বলে ভয়ভীতি দেখানো হয় টহল গাড়িতে তুলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন আটক ব্যক্তি। সর্বস্ব পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে এবং নিকটজনদের ফোন দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আনিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন। পুলিশের এসব কর্মকাণ্ড এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। 

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এক উপ-কমিশনারের বিরুদ্ধে এক ব্যবসায়ীকে ধরে এনে ব্যাপক নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছিল। সৈয়দ আবিদুল ইসলাম নামে ওই ব্যবসায়ী পরে এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে মুক্তি পেয়েছেন। এই পরিমাণ টাকা দিতে গিয়ে তিনি কার্যত কপর্দকহীনে পরিণত হয়েছেন। 

টাকা দেয়ার প্রমাণ হিসেবে তিনি টাকা নেয়ার দৃশ্যসম্বলিত সিসিটিভির ফুটেজও দিয়েছেন সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে। ওই ফুটেজে টাকা নেয়ার দৃশ্যটি স্পষ্ট। একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টির তদন্ত করায় প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।

২০১৩ সালের ২১ জুলাই সিলেট নগরীর ভাঙ্গাটিকর এলাকা থেকে স্কুলশিক্ষক সন্তোষ কুমার দেব ও সর্বাণী দেবের কন্যা ৪ বছরের শিশু জয়ীকে অপহরণ করা হয়। এ ঘটনার পর পুলিশ প্রথমে তদন্তে নামলেও কোনো সুরাহা পায়নি। আলোচিত এ অপহরণের ঘটনাটি নিয়ে সিলেটে আন্দোলন দানা বাধে। দেয়া হয় পুলিশকে আলটিমেটামও। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ প্রথমে একই এলাকার রবিউলকে গ্রেফতার করে। রবিউল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জয়ী অপহৃত হয়েছে বলে ধারণা পায় পুলিশ। রবিউল জানিয়েছিল, ‘শংকর দাম নামের এক ব্যক্তি জয়ীকে নৌকায় উঠিয়ে দক্ষিণ সুরমা চলে যায়। কাজির বাজার খেয়াঘাটে শঙ্কর সেবিকা অনিতার কোলে বাচ্চাটিকে দিয়েছিল।’ তার এ স্বীকারোক্তির পর পুলিশ অনিতার সন্ধানে নামে। কিন্তু তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে ৭ নবেম্বর ২০১৪ পুলিশ শ্রীমঙ্গলের সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেফতার করে তাকে। 

ওই মামলায় প্রথম পর্যায়ে নার্স অনিতা ভট্টাচার্যকে ৩ দিনের রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। রিমান্ডে পুলিশের নির্যাতনে তিনি গুরুতর আহত হন বলে তার স্বামী কিশোর ভট্টাচার্য মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক তদন্তে নির্যাতনের সত্যতা মিলে। এর পরিপ্রেক্ষিতে (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম ও এসআই হাসিনা আক্তার আঁখিকে ক্লোজড করা হয়। 

স্বামী কিশোর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে অভিযোগে বলেন, তার শ্রীমঙ্গলের আলিসাকুল বাড়ি থেকে স্ত্রীকে কোতোয়ালি থানার একটি মামলায় গ্রেফতার করে পুলিশ। ৭ নবেম্বর ২০১৪ অনিতাসহ কিশোর ও তাদের সন্তানকে পুলিশ কোতোয়ালি থানায় নিয়ে আসে। ৮ নবেম্বর পুত্র ও ৯ নবেম্বর কিশোরকে পুলিশ ছেড়ে দিলেও তাকে আদালতে উপস্থাপন করে ৫ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত মহিলা পুলিশের উপস্থিতিতে হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক জিজ্ঞাসাবাদ করতে ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। ওই দিনই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই সিরাজুল ইসলাম তাকে পুলিশ হেফাজতে কোতোয়ালি থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে নিয়ে যান। অভিযোগে কিশোর জানান, জিজ্ঞাসাবাদে কোনো তথ্য না পেয়ে বাদীপক্ষ কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে থানার ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম ও এসআই হাসিনা আক্তার আঁখি শারীরিক নির্যাতন করে অনিতার ওপর। ওসি (তদন্ত) মনির তার গলার ভেতরে পাইপ ঢুকিয়ে মদ খাওয়ায়, পায়ের বুট দিয়ে গলায় চাপ দিয়ে অপহরণের ঘটনা স্বীকার করতে বলে। এসআই আঁখি আসামী অনিতার গোপনাঙ্গে লাঠি দিয়ে খোঁচায়।  [চলবে]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ