প্রত্যাবর্তন
আফরোজ ইসলাম : সেই সকাল থেকে সারাটা দিন জড়ি-কাতানের কুর্তা পরে থেকে এই ছুঁই ছুঁই সন্ধ্যার ভ্যাপসা গরমে অস্থির হয়ে পড়েছে শেফায়েত। বিয়েতে তার মত ছিল না, কিন্তু মা শয্যায়, নইলে এই মুহূর্তে বিয়ের বিষয়কে উড়িয়ে দিয়েছিল সে। ঢাকায় পড়াশোনা করা শিক্ষিত ছেলে সে, এমএ পাস করে চাকরি করবে ভাবছে অমনি বাড়ি থেকে খবর এল মা অসুস্থ। দৌড়ে এসে দেখে সব ঠিক, মিছে বলে তাকে ডেকে আনা! হাত ধরে মা’র অনুরোধ- তুই বিয়ে করবি, মেয়ে দেখে রেখেছি, তিনি কথা দিয়ে গেছেন, নইলে ওপারে গিয়ে তাকে মুখ দেখাব কি করে! ওসব চাকরি করা লাগবে না, ব্যবসা দেখবি, আমার চোখে চোখে থাকবি। শেফায়েত বেঁকে বসায় এবার সত্যি সত্যি শয্যা নিল বিধবা জানুবিবি। দানা পানি কিছুই মুখে তোলে না। কত চেষ্টাই করল
তাকে একটু পানি মুখে দেয়ার, কিন্তু পারল না। শরীরও খারাপ হতে থাকে। কি আর করা! মত দেয় শেফায়েত। এতকাল ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল শব্দটা
নোভেলে পড়েছে, আজ তার উপর শব্দটার বাস্তবিক প্রয়োগে এই প্রথমবার শব্দটার মর্মার্থ ও ভুক্তভোগীর অনুভূতি টের পেল। বাড়ি ফিরে কাপড় বদলাতে নিজের ঘরে ঢুকতে গেলে আত্মীয় সম্পর্কের মেয়েলোকের দল চোঁখ
বাঁকিয়ে টিপ্পনী কেটে বলে- না না এখন এ ঘরে ঢোকা যাবে না, বউ এর সাথে গল্প আলাপ করব তবে তুমি এসো।
কেউ আবার বলে—
-এ আর তোমার ঘর নেইগো! আজ থেকে সকল কিছুর ভাগাভাগি! মনের সাথে ঘরও! হিঃ হিঃ হাঃ হাঃ...স্ত্রীমহলে হাসির রোল পড়ে। দাঁড়ায় না আর শেফায়েত। বাড়ির পশ্চিমের দিকে তার পড়ার ঘরটায় গিয়ে অমনোযোগী চোঁখে আলমারি থেকে কি একটা ইংরেজী বই নিয়ে বসে। এখানেও শান্তি পেল না বন্ধুমহলের আক্রমণে। বন্ধু অরুণ চ্যাটার্জী, এনায়েত করিম তাকে ঘিরে রম্যরস মিশ্রিত প্রেমালাপ জুড়ে দেয়। অনেকক্ষণ বাদে বকুল খালা
এসে উদ্ধার করল যেন শেফায়েতকে।
-কিরে এখনও গল্প করে কাটালে হবে? আর তোরাও আছিস বাপু...কই ওকে ওঘরে নিয়ে যাবি, তা না, আমাকেই করতে হয় সব! চল বাপ, উঠ দেখি। বউটা কতক্ষণ একলা থাকবে?
শেফায়েত এ ঘরে ঢুকতেই মেয়ের দল আরেকবার হাঃ হাঃ হিঃ হিঃ রোল তুলে বেরিয়ে গেল। মেয়েলোক! এমনি হাসে ফের এমনি কাঁদে! ঘরে খাটের এক কোণে চুপচাপ কোলের উপর দু’হাত ভাঁজ করে বসে আছে সুতপা। গাঁয়ের মেয়েদের মত কোন অহেতুক পাঁচহাত লম্বা ঘোমটা টানা নেই, নেই কপালে আঁকিবুকি আল্পনা আঁকা! শেফায়েতকে দেখে উঠে দাঁড়াতেই নীচু বজ্রকণ্ঠে শেফায়েত ঘোষণা দিল- মায়ের শয্যাগ্রহণে তোমাকে বিয়ে করতে বাধ্য
হয়েছি, নইলে কালো বর্ণ আর কম বিদ্যের মেয়েলোক আমি সইতে পারিনা, বড় ঘেন্না হয়, রুচিতে বাঁধে। তোমার থাকতে ইচ্ছে হয় থাকো, নয় চলে যাও। আমাকে তোমার কোন ইচ্ছা আগ্রহের প্রত্যাশা পূরণকারী হিসেবে আশা করোনা। রাত বাড়ে, বিয়ে বাড়ির হইহুল্লোড় কমে। রাতে জ্বলা জোনাকিরাও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। শুধু শ্যামল বর্ণের অপমানে জর্জরিত কৃঞ্চকালো কমলাক্ষ থেকে নিঃশব্দ বারি ঝরতে থাকে, অন্ধকার অন্তরীক্ষ তার নিভৃত সাক্ষী হয়ে থাকল! সুতপা কালো জানে সে, কিন্তু কালো বলে এমন করে অপমানিত সে কোনদিনও হয়নি। জন্মের পর মা মারা যাওয়ার পর দাদীর কোলে বড় হয়েছে। বাবা তাকে রুচিসম্পন্ন, মার্জিত, স্বশিক্ষিত করে তুলেছেন। বাবা মারা গেছেন মাস তিনেক হয়েছে। বাপআদুরে মেয়েটি এখনও শোকই ভুলতে পারেনি, তার উপর বাল্যকাল থেকে হবু স্বামী বলে জেনে আসা মানুষটির মুখে এমন বাক্যে রীতিমত মুষড়ে পড়ে। আইএ-তে ভালো রেজাল্ট করে শহরে পড়তে যেতে চেয়েছিল সুতপা কিন্তু তার শ্বাশুড়ি ওর দাদীকে বললেন, আমার ছেলের বউ ঘরকন্না করবে, অত পড়াশোনা
করে লাভ কি! ও কাজতো একজনে করছেই। ওই পড়ার অভ্যেস তো! পুরো একঘর বই রয়েছে ছেলের আমার! পড়বে! সুতপাও বিবাহোত্তর সংসার, হবু স্বামীকে মনের মাঝে রেখে ভবিষ্যৎ স্বপ্নসুখের আশায় পড়ালেখাটাকে ইতি জানায়। তার মাসখানেক পরই বাবা মারা যায়, পিতৃশোকই এখনও ভুলতে পারেনি, তাতে এমনতর অবস্থা একাকী মাতৃহীনা নারীমনে কি প্রকারে রক্তক্ষরন ঘটালো তার খবর শয্যায় ঘুমন্ত অন্তঃপ্রেমশূন্য পাষান হৃদয়ের বাহ্যিক সৌন্দর্যপূজারীর কান, মন পর্যন্ত পৌঁছাল না।
এভাবেই কাটে নব দম্পতির বিবাহিত কাল। ভেতরের ঘরের অবস্থা বাহিরে প্রকাশ পায় না। শেফায়েত পারিবারিক ব্যবসায় মনোনিবেশ করে সারাদিন ব্যস্ততায় কাটায়। অতি অভিমানী, আত্মমর্যাদায় পরিপূর্ণ সুতপা ভেতরে কুশপুত্তলিকার মত জ্বলন্ত অগ্নি বয়ে বেরিয়ে সারাদিন সংসারের কাজকর্মে সঁপে দেয় নিজেকে। বিবাহের কয়েকদিন পর আত্মীয় স্বজন যারা এসেছিল একে একে সবাই বিদায় নিলে দুপুরে মধ্যাহ্নভোজের পর শেফায়েতের মা জানুবিবি সুতপাকে ঘরে ডেকে কাছে বসায়। শরীর এবার আর চলছে না।
-কিরে মা, মুখখানা ওমন হয়ে গেছে কেনরে তোর? ছেলেটা তোর সাথে ঠিকমত কথাটথা বলেতো?
-সে ব্যস্ত মানুষ, তার কি আর এত কথা বলবার সময় আছে বলুন মা?অযথা চিন্তা করবেন না। আপনার শরীর ভালো নেই।
-এ আর কত চলবে বল? কলের মেশিনই নষ্ট হয়, আর এতো মাটির....
-হয়েছে! এখন একটু ঘুমান। পুত্রবধূ মুখে না বললেও ওর কচি মুখটায় চাপা কষ্টের ছায়া জানুবিবি ঠিক ধরতে পারেন। চেপে থাকা শ্বাসটা ছাড়েন ধীরে ধীরে। চুলে পাক ধরেছে-এ জীবনে কম কিছুতো দেখেননি। সবই বোঝেন- ছেলেটাকে অমতে বিয়ে করিয়ে এই বাপ মা মরা মেয়েটার কপাল
-পোড়ালেন নাতো! এসব আকাশ পাতাল ভেবে ভেবে আরও অসুস্থ হন তিনি। দুদিন পর সুবহে সাদিকের সময় সুতপার কোলে মাথা রেখেই জীবনবায়ু ত্যাগ করেন। গত সপ্তাহটা গেছে একেবারে খাঁ খাঁ করা রোদে। সন্ধ্যায় হলা’র মাকে নিয়ে পুকুরে গলা পানিতে নামে সুতপা। এ বাড়ির পুকুর ঘাটটা ওর খুব পছন্দের। চারপাশে উঁচু দেয়াল তোলা। লাল রং করা শান বাঁধানো ঘাটের কাছেই কামিনী ফুলের গাছ। যদিও অজায়গায়, কিন্তু মৌসুমে থোকা থোকা সাদা ফুলের গন্ধে পুকুরের চারপাশ সুরভিত থাকে।
-আইচ্ছা বউ, আফনে যে পরায় পরায়ই এই রাইতদুপুরে নাইবার আহেন, আফনের ডর ভয় লাগে না?
-ভয় কিসের বলত?
-কিয়ের আবার! রাইতের বেলায় নানান কিছু ঘুইরা বেড়ায়, আর এমুন জায়গায় তো আরও বজ্জাতগুলান থাহে।
-তাই বুঝি? তুমি দেখেছ কখনও?
-না তা দেহিনাই, তয় বুজবার পারি।
-হা হা...না দেখেই এত ভয়!
-হাইসোনা বউ, ওগুলা মনে হইলেও আত্মা ছ্যাৎ কইরা উঠে।
-ভয় করতে হবে না, তুমি বাড়ি যাও, আমি আসছি। তার আসার সময়
হলো!
হলা’র মা চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ পুকুরে গলা ডুবিয়ে থাকে সুতপা। অন্ধকারে নিজেকে খুঁজে পায় যেন! বাড়িতে পোঁছে শেফায়েতের ঘরে গল্প-তামাশার জোর কথাবার্তা কানে আসে সুতপার। আশেপাশে হলা’র মা, গোসাই কাউকে খুঁজে না পায়ে তড়িঘরি করে কাপড় বদলে অতিথি আপ্যায়নে নিজেই এগিয়ে যায় রসুইঘরের দিকে।
অরুণ: -তা বন্ধুমশাই, বউদিকে একটু ডাক, একটু চোঁখের দেখা দেখি। নইলে যে সকল আদরই বৃথা মনে হবে! তার কথায় সায় দিয়ে এনায়েত করিম বলে-
এনায়েত: -এতক্ষণে একটা খাঁটি কথা বলেছ হে। সেই কখন থেকে বসে আছি শুকনো মুখে! কর্ত্রী ছাড়া কি এই খাবার মুখে রোচে বল?
অরুন: -হা হা হা ঠিক, বেশ বলেছ।
শেফায়েত: আর বউদি! ওকে তোমাদের বউদি মনে হয়? ওমন কাউকে নিয়ে কি আর সংসার করা চলে? না আছে কোন সুরত, না আছে পেটে বিদ্যা!
সবাই থতমত খায় একটু। শহরতলী থেকে এসেছে বন্ধুর ঘরকন্না দেখতে, এমন কথায় একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে।
অরুণ: এ কেমনতর কথা বলছ হে বন্ধু? সে তোমার বউদির অন্তরঙ্গ সখী। যতদূর জানি তিনি পড়াশোনায় বেশ ভালো, ভালো নম্বর নিয়ে আইএ পাস করেছেন।
শেফায়েত: আহ্! রাখো তোমার পড়া! পাড়াগাঁয়ের বিদ্যা কতটুকু সে ঢের জানি।
এনায়েত: আচ্ছা একটা কথা বল, তার সম্পর্কে এত প্রশংসার ফুলঝুরি ফোটানোর ইচ্ছে থাকলে বিয়ে করলে কেন?
শেফায়েত: সে কি আর সাধে করেছি?মা শয্যা নিলেন, বাবা মৃত্যুর আগে কথা দিয়েছিলেন, অনুরোধে ঢেঁকি গিলেছি মাত্র। গলার কাঁটা হয়ে বিধে আছে, না গেলার মত, না ফেলার মত। জ্বালা, বুঝলে, কিযে লজ্জিত হই আমি ওই হেড়োপেতœীর জন্যে!
অরুণ: বাহ্! ভারী তো এক বলির পাঁঠা পেয়েছ তোমরা! নিতান্তই দুর্ভার্গ্য তোমার যে এমন একজনকে মনে ধরছেনা। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল অরুণ, সমুখে ছিপছিপে গড়নের শ্যামা বর্নের উজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত কিন্তু শান্ত চেহারার রমণীকে দেখতে পেয়ে থেমে গেল।
অরুণ- আরে বউদি, বলি সব ভালো তো? এতক্ষণে এই অভাগাদের প্রতি কৃপা হল!
সুতপা: মাফ করবেন বিলম্ব হওয়ার জন্য। অভাগা তো আমি ভাই, অতিথিদের খোঁজ নিতে পারিনি।
অরুণ: -মাফ? সে পরে দেখব! আগে তো বসুন, কথাইতো হয়নি আপনার সাথে।
শেফায়েত: ওর এখানে থেকে কাজ নেই। রুচিবোধ বলে এখনও কিছু বজায় আছে আমার। বাহির থেকে এদের কথোপকথন সবই শুনেছে সুতপা। তার উপস্থিতিতে সবার সামনে এমন অপমান আত্মাভিমানী এই রমণীর ধৈর্য্যরে বাঁধ ভেঙে দিল। মুখে হাসি টেনে খাবার পরিবেশন করতে করতে নত মস্তকে নত অক্ষিযুগল অশ্রুপূর্ণ করে শ্যামলা মুখখানা কালো করে সুতপা বলল-
-এতই যদি অরুচি আমাতে, তবে এমন কাজ করলেন কেন? সুতপা’র দুঃখভরা মনের অব্যক্ত শব্দমালাগুলোর এমন বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশকে শেফায়েতের কাছে ধৃষ্টতা বলে গণ্য হওয়ায় বরফ শীতল কণ্ঠে জবাব দিল-
-ওটা মায়ের কথায় করেছি।
-তবে মায়ের কথায় সংসারটাও না হয় করুন। এতে দোষ কোথায় বুঝি না! [চলবে]