শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ক্ষতিকর মশার কয়েল

বাংলাদেশের বাজারে যেসব মশার কয়েল বিক্রি হয় সেগুলোর বেশির ভাগের মধ্যেই মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান রয়েছে। দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে সর্বোচ্চ দশমিক শূন্য তিন মাত্রা পর্যন্ত সক্রিয় রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করার অনুমোদন দিয়েছে সেখানে বাংলাদেশের মশার কয়েলগুলোতে অনেক উচ্চ মাত্রার উপাদান পাওয়া গেছে। ২৪টি কোম্পানির এসব কয়েল সম্প্রতি সিঙ্গাপুরের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, কয়েলের মোড়কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত পরিমাণের উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে ২৪টির মধ্যে ২০টি কয়েলেই রাসায়নিক রয়েছে অনেক বেশি পরিমাণের। ফলে এসব কয়েলের ধোঁয়ায় মশার পাশাপাশি তেলাপোকা ও মাকড়সাসহ অন্য কীটপতঙ্গও মারা যাচ্ছে। মানব দেহেরও ক্ষতি হচ্ছে অত্যধিক।
উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে মাত্রার অনুমোদন দিয়েছে সে মাত্রায় রাসায়নিক ব্যবহার করা হলে কোনো কীটপতঙ্গেরই মৃত্যু ঘটার কথা নয়। ওই পরিমাণের রাসায়নিক মশাসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গকে শুধু তাড়িয়ে দেয়। ফলে মানুষ মশার যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পায় কিন্তু মানব দেহের কোনো ক্ষতি হয় না। অন্যদিকে বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো তাদের কয়েলে এমন উচ্চ মাত্রায় রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করছে যার ফলে কীটপতঙ্গ তো মারা পড়ছেই, একই সঙ্গে মানব দেহেরও অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। উল্লেখ্য, ভারত ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো মশার কয়েলে শুধু এলেথ্রিন ও পাইরেথ্রিন নামক কীটনাশক ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের কয়েলগুলোতে এলেথ্রিন ও পাইরেথ্রিন তো রয়েছেই, পাশাপাশি রয়েছে ডি-এলেথ্রিন, ডি-ট্রান্স এলেথ্রিন, এস-এলেথ্রিন এবং মেটোফ্লুথ্রিন নামের ছয় প্রকারের ক্ষতিকর উপাদান। এস-বায়োথ্রিন নামের ক্ষতিকর বিষও ব্যবহার করা হচ্ছে যথেচ্ছভাবে। এসবের জন্যও কোম্পানিগুলো নাকি যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েছে!
দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেয়ায় এসব কয়েলই খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে এবং মানুষও প্রতিদিন ব্যবহার করছে। পরিণতিতে তারা দীর্ঘমেয়াদী নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। রিপোর্টে এ তথ্যেরও উল্লেখ রয়েছে যে, একশ’টি সিগারেট ফুসফুসের যে পরিমাণ ক্ষতি করে এক রাতে তার চাইতেও বেশি ক্ষতি করছে এসব মশার কয়েল। কয়েলে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদানগুলো আর্সেনিক ও ফরমালিনের মতোই বিপদজনক এবং দীর্ঘ মেয়াদে ক্যান্সার ধরনের মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করে থাকে।
দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টে দুটি আশংকাজনক তথ্যও জানানো হয়েছে। প্রথম তথ্যটি হলো, বাংলাদেশে দেড় শতাধিক কোম্পানি মশার কয়েল উৎপাদন ও বাজারে বিক্রি করছে কিন্তু এসবের মধ্যে সরকারের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন বা বিএসটিআই-এর অনুমোদন নিয়েছে মাত্র ৪৫টি কোম্পানি। অর্থাৎ একশ’র বেশি কোম্পানি অবৈধভাবে মশার কয়েল উৎপাদন ও বিক্রি করছে। আশংকাজনক দ্বিতীয় তথ্যটি হলো, অবৈধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত কোম্পানিগুলোর ব্যাপারে সরকারের কোনো সংস্থাই অবহিত নয়। যেমন বিএসটিআই-এর কর্মকর্তারা বলেছেন, তাদের দায়িত্ব বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদিত পণ্যের মান যাচাই ও নিয়ন্ত্রণ করা। কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়ার দায়িত্ব বা ক্ষমতা বিএসটিআই-এর নেই। সে কারণে কারা কিভাবে কারখানা স্থাপন করেছে এবং ক্ষতিকর মশার কয়েল উৎপাদন ও বিক্রি করে চলেছে তা বিএসটিআই-এর জানা নেই।
অন্যদিকে অনুমোদন দেয়ার ক্ষমতা যে বিনিয়োগ বোর্ড ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তারাও বিষয়টির প্রতি প্রয়োজনীয় নজরদারি করছে না। এমন অবস্থার সুযোগ নিয়েই একদিকে দেড় শতাধিক কোম্পানি বাধাহীনভাবে মশার কয়েল উৎপাদন ও বিক্রি করার কার্যক্রম চালাচ্ছে, অন্যদিকে এক শ্রেণীর অসাধু ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ী চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ক্ষতিকর কয়েল আমদানি করে বাজারে বিক্রি করছে। আপত্তির সবচেয়ে বড় কারণ হলো, প্রতিটি মশার কয়েলের মোড়কেই বিএসটিআই-এর দেয়া অনুমোদনের সিল লাগানো রয়েছে, যা দেখে মনে হবে, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে উৎপাদনের পর মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অনুমোদন নেয়া হয়েছে। এর ফলেও প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
বলার অপেক্ষা রাখে না, মূলত সরকার তথা বিনিয়োগ বোর্ড ও বিএসটিআইসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর উদাসিনতার সুযোগ নিয়েই পরিস্থিতির এত ভয়ংকর অবনতি ঘটতে পেরেছে। এর পাশাপাশি ঘুষ ও দুর্নীতির শক্তিশালী অভিযোগও রয়েছে। কারণ, বছরের পর বছর ধরে নিষিদ্ধ হওয়ার উপযোগী মশার কয়েল বিক্রি হওয়ার খবর কোনো প্রতিষ্ঠানেরই জানা নেই-এমন কথা মুর্খজনেরাও বিশ্বাস করবে না। অর্থাৎ সবকিছু কর্তাব্যক্তিদের জ্ঞতসারেই ঘটছে কিন্তু ঘুষের কারণে তারা না দেখার ভান করে চলেছেন।
আমরা মনে করি, এমন অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। সরকারকে অবশ্যই কয়েল কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিটি কোম্পানি যাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারণ করে দেয়া মাত্রার মধ্যে রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করতে বাধ্য হয় তার ব্যবস্থাও সরকারকেই করতে হবে। এজন্য বিএসটিআইকে তৎপর করে তোলা দরকার। বিনিয়োগ বোর্ডকেও সতর্ক করতে হবে, যাতে বিএসটিআই-এর সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া কোনো কোম্পানিকে বিশেষ করে মশার কয়েল উৎপাদন ও বিক্রি করার অনুমোদন না দেয়া হয়। আমরা একই সাথে মশা নিধনের লক্ষ্যে প্রতিটি এলাকায় নিয়মিতভাবে পরিচ্ছন্নতার অভিযান চালানোর আহ্বান জানাই, যাতে মশার জন্ম ও বিস্তার ঘটতে না পারে এবং মানুষকে যাতে ওইসব বিষাক্ত ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কয়েল কিনতে ও ব্যবহার না করতে হয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ