বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মজুদ নেমে এসেছে অর্ধেকে ॥ হুমকিতে খাদ্য নিরাপত্তা

সাদেকুর রহমান : দেশে খাদ্যশস্যের মজুদ গত বছরের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। একই সময়ে চালের মজুদ কমেছে উদ্বেগজনক প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। এ অবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সমীক্ষা মতে দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বর্তমানে যে মজুদ তা যথেষ্ট নয়। সংশ্লিষ্ট গবেষকরা আশংকা প্রকাশ করে বলছেন, সিন্ডিকেট মোকাবিলা করে চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের বড় হাতিয়ার হলো মজুদ। সেটা কমে গেলে ঝুঁকি তৈরি হয়।
তবে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন কর্মসূচিতে খাদ্যশস্য দেয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হয়নি। এ জন্য মজুদ কমে গেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণের মতো পর্যাপ্ত মজুদ তাদের হাতে রয়েছে বলে দাবি করেছেন তারা। এছাড়া আমন মওসুম শুরু হওয়ায় চালের সংকট হবে না বলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে দাবি করা হয়।
প্রধান খাদ্যশস্য চালের উৎপাদন, বণ্টন, বিপণনসহ সার্বিক তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে বেশ কিছুদিন ধরে সরকার দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দাবি করে আসছে। চলতি অর্থবছরে সারা দেশে বোরো ধান উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ টনের বেশি, যা লক্ষ্যমাত্রা ছাপিয়ে গেছে। বিশ্বখাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট বিশ্বের ক্ষুধাসূচক প্রতিবেদনে এশিয়ার সবচেয়ে ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ বলে মন্তব্যও করে। এফএও তার প্রতিবেদনে দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে তাৎপর্যপূর্ণ উল্লেখ করে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু, মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানেই দেখা যাচ্ছে, সরকারি খাদ্য মজুদ পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় নেমে এসেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) তথ্য অনুযায়ী, ২৭ নবেম্বর দেশে খাদ্যশস্যের মোট মজুদ ৭ লাখ ৪ হাজার ১০ মেট্রিক টন। এরমধ্যে চাল ৪ লাখ ৬০ হাজার ৬শ’ টন ও গম ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪১ টন। গত বছর একই দিনে এ মজুদের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৫ লাখ ৯২ হাজার টন। এরমধ্যে ১২ লাখ ৩ হাজার ৮৭০ টন চাল ও ৩ লাখ ৮৮ হাজার ১শ’ টন গম ছিল। 
আর গত ৫ মে হতে বোরো সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়ে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৫৭৭ টন বোরো ধান এবং ৫ লাখ ৮৫ হাজার ৬৩২ টন বোরো চাল সংগৃহীত হয়েছে এবং ৩১ অক্টোবর সংগ্রহ কার্যক্রম সমাপ্ত হয়েছে । অপরদিকে, গত ১০ মার্চ হতে গম সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়ে ২০ জুন পর্যন্ত ১ লাখ ৯৮ হাজার ৪৭২ মেট্রিক টন গম সংগৃহীত হয়েছে।
দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে এই মজুদ যথেষ্ট নয় বলে বিআইডিএস’র এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে। সরকার দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ বাজার স্থিতিশীল রাখতে কমপক্ষে ১৬-১৭ লাখ টন খাদ্যশস্যের মজুদ রাখে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত বলেন, সরকারের মজুদ কমে গেলে সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিতে পারে সিন্ডিকেট। রেন্ট-সিকাররা সুবিধা নিতে রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনীতিকে অধীনস্ত করে রেখেছে।
‘রেন্ট-সিকার’ শব্দের ব্যাখ্যা করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, যারা নিজেরা কোনো সম্পদ সৃষ্টি করে না। অন্যের সৃষ্ট সম্পদ জোর করে দখল করে তারাই হচ্ছে রেন্ট-সিকার। ওই দুষ্কৃতিকারীরা যাতে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে ফায়দা লুটতে না পারে সেজন্য প্রভাব বিস্তার করা যায় এ পরিমাণ খাদ্যশস্যের মজুদ সব সময়ই সরকারের হাতে রাখতে হবে।
অবশ্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) ও টিআরে (টেস্ট রিলিফ) আমরা আর খাদ্যশস্য দিচ্ছি না। এগুলো এখন থেকে টাকায় দেওয়া হবে। কাবিখা ও টিআরে আমাদের মোট ৩ লাখ ৯০ হাজার মেট্রিকটন চাল ও ৪ লাখ ৭০ হাজার টন গম মিলিয়ে মোট ৮ লাখ ৬০ হাজার টন খাদ্য শস্য প্রয়োজন হতো। এখন আর তা লাগবে না। এজন্য এ পরিমাণ খাদ্যশস্য আমাদের মজুদের প্রয়োজন হচ্ছে না। বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য যতটা খাদ্যশস্য মজুদ থাকা প্রয়োজন সেটা সরকারের হাতে আছে দাবি করে ওই কর্মকর্তা বলেন, আমন মওসুম চলছে। আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী আমনও সংগ্রহ করব।’
সার্বিক বাজারের কথা চিন্তা করে হতদরিদ্রদের জন্য ১০ টাকার চাল বিতরণ (খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি) কর্মসূচি আরও সম্প্রসারিত হতে পারে জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, এখন এটা ৫ মাস দিচ্ছি। এটা প্রয়োজনে সরকার সারা বছরই সম্প্রসারণ করতে পারে। খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে বছরে সাড়ে ৭ লাখ টন চাল প্রয়োজন হবে বলেও ইতোমধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।
খাদ্যশস্য কেনার জন্য চলতি অর্থবছরে যে অর্থ দেয়া হয়েছিল সেটা অর্থ মন্ত্রণালয় ফিরিয়ে নিয়ে টিআর-কাবিখায় দিয়েছে বলেও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
গত ৯ নবেম্বর থেকে ঢাকা মহানগর ছাড়া সারাদেশে ওএমএসের (খোলা বাজারে বিক্রি) চাল বিক্রি বন্ধ করে দেয় সরকার। ওএমএসে প্রতি কেজি চাল ১৫ টাকা দরে বিক্রি হয়। জানা গেছে, চালের মজুদ কমে যাওয়ায় ওএমএসে চাল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। তবে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের দফতর থেকে জানানো হয়, মাঠ পর্যায়ে আমন ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। আমান আসা শুরু হয়ে গেছে। এজন্য চাল বিক্রি বন্ধ রাখা হয়েছে।
সরকারি মজুদ কমে যাওয়ার প্রাথমিক প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়েছে চালের বাজারে। গুণীতকহারে দাম বাড়তে শুরু করেছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার মনিটরিং সংক্রান্ত গত ৩০ দিনের রিপোর্টে চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখীর চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে মোটা চালের দাম কেজি প্রতি ৩৬-৪০ টাকা ও সরু চাল ৪৬-৫৬ টাকা এবং আটা ২৫-৩৪ টাকা কেজি উল্লেখ করা হয়েছে।
সাবেক কৃষি সচিব ড. মির্জা এ. জলিল এ প্রসঙ্গে বলেন, সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে চাল নয়, ধান কেনার ঘোষণা দিয়েছে এবং সবসময়ই তাই করে থাকে। কিন্তু তাতে কৃষকের কোনো লাভ হয় না। বাংলাদেশে অধিকাংশ কৃষকই বর্গাচাষি। তারা মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়ে ধান উৎপাদন করে। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, ধান কাটার সঙ্গে-সঙ্গে মহাজনও দাদনের টাকা সুদাসলসহ আদায় করতে হাজির হয় কৃষকের বাড়িতে এবং কৃষকও বাধ্য হয়ে তাদের কাছে কমদামে ধান বিক্রি করে এসেছে।
তিনি বলেন, উৎপাদিত ধান সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় কৃষকও মহাজনের টাকা শোধ করতে কম দামে তাদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হয়। চাল বিক্রি করেন চালকল মালিকরা। বাজারে এখন চালের দাম বাড়তি। সময়মতো চুক্তি না করার সুযোগও নিচ্ছেন অনেক অসাধু মিলার। তাই সরকারকে এখন দেখেশুনে এগোতে হবে। সরকারি মজুদ কমে এসেছে। তাই আপৎকালীন দুর্ভোগ এড়াতে সার্বিক অবস্থা বিবেচনাপূর্বক সরকারের উচিত অবিলম্বে খাদ্য মজুদ এবং উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দেয়া।
জানা গেছে, বাংলাদেশকে প্রতিবছর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেসরকারি উদ্যোগে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। বিশ্ববাজারে চালের মূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতার জন্য চাল রফতানিকারক দেশ ভারত, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারসহ অন্য দেশগুলো পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও মূল্যবৃদ্ধি এবং সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবিলার জন্য অতিরিক্ত মজুদ গড়ে তুলছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ