মগ শাসকদের কোপানলে ইতিহাসের আরাকান
সাজজাদ হোসাইন খান : নতুন ইতিহাস রচনার ঘোষণা দিয়েছে মিয়ানমারের বৌদ্ধ শাসকগোষ্ঠী। উদ্দেশ্য আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্মকাহিনী তুলে আনা। বিশেষভাবে বাংলাভাষী মুসলিমদের। স্মরণযোগ্য এই বঙ্গভাষী রোহিঙ্গাদের একটা বড় অংশ বৌদ্ধ ধর্মীয়ও রয়েছে। এদের ব্যাপারে কিন্তু মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ শীতল। কোপানলে কেবল বাঙালি মুসলিম। ইতোমধ্যে মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিকত্ব হরণ করেছে। এখন অত্যাচার-নিপীড়নে দেশ ত্যাগে বাধ্য করছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিভীষিকাময় বিদ্বেষে ওরা নিপতিত। এরই মধ্যে প্রায় চৌত্রিশ হাজার আরাকানী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। জাতিসংঘ, আসিয়ান, ওআইসিসহ প্রায় সারা বিশ্বেই বিষয়টি নিন্দিত হচ্ছে। এরপরও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ অনেকটাই নির্বিকার। হত্যা-অত্যাচার অব্যাহত রাখছে। তারা তাদের অসভ্যতাকে প্রকাশে দ্বিধা করছে না। এখন আবার ইতিহাস রচনার ঘোষণা দিল। ইতিহাস রচনা করেন ইতিহাসবিদরা। সেই ইতিহাসবিদরা যদি সত্য সন্ধানী হন তবে সেই ইতিহাসে প্রাণের স্পন্দন দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়, হতে পারে। কিন্তু এখানে ইতিহাস কতটা বিদ্বেষমুক্ত হবে কে জানে? যেখানে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বিদ্বেষমুক্ত নন। এমনকি বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী তো আছেই বৌদ্ধ ভিক্ষুরা পর্যন্ত হিংসার অনলে জ্বলছে। সে দেশের ইতিহাস রচকগণ এ সীমান্তের বাইরে কতটা যেতে পারবেন সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। কারণ শান্তি পুরস্কার সংগ্রহ করে যে দেশের নেত্রী অশান্তির দেবী হয়ে বসে থাকেন, প্রলাপ বকেন, সেখানে সুস্থতা অবান্তর।
আজ থেকে প্রায় তের হাজার বছর আগেই মিয়ানমারে জনবসতি ছিল। ইরাবতী উপত্যকায় বসবাসরত ‘মুন’ জনগোষ্ঠীকেই প্রথম জনবসতি বলে মনে করে গবেষকগণ। পরবর্তী সময় বেশ কিছু রাজ্যে বিভক্ত ছিল বার্মা বর্তমানের মিয়ানমার। যেমন আভা, আরাকান এবং হানথাবতী ইত্যাদি। সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময়ে আরব দেশীয় বণিকরা আরাকানে আসে। কেউ কেউ সেখানে বসতি স্থাপন করে। এরপর তুর্কিরা আসে, ইরাক-ইরানীরাও আরাকানে উপস্থিত হয়েছিল সে সময়। পর্তুগীজ বণিকরাও তাদের বাণিজ্যকে সম্প্রসারিত করে এ অঞ্চলে। দক্ষিণ ভারত থেকেও আসে অনেকে। বিশেষ করে তের শতকের প্রথমদিকে বাঙালিরা আরাকানে প্রবেশ করতে শুরু করে। আরাকান এবং বাংলাদেশীদের ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে অন্যরকম একটা হৃদ্যতা গড়ে উঠে। ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও কৃষিকাজের জন্যও বাঙালিগণ সেখানে ব্যাপকহারে প্রবেশ করতো। ইতালীয় পর্যটক মার্কোপলো থেকে জানা যায়, ১২৭২ সালের দিকে চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালীর কিছু অংশ তৎকালীন আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এসব তথ্য উপাত্ত থেকে বুঝা যায় বাংলাভাষীদের সাথে আরাকানীদের যোগাযোগ-আত্মীয়তা শত শত বছর আগ থেকেই। এসব বহিরাগত জনগোষ্ঠী আরাকানে প্রবেশের কারণে সেখানকার সামাজিক, ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ম-রীতিতে পরিবর্তন আসে। বিশেষভাবে মুসলিম অনুশাসনে মিশ্রণ ঘটে। কারণ আরাকানের রাজসিংহাসনে বৌদ্ধ রাজা উপবিষ্ট থাকলেও রাজকর্মচারী এবং উজির নাজিরদের অধিকাংশই ছিলেন ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। এদের প্রভাব আরাকানী সমাজে যেমন শিকড় গেড়েছিল তেমনি রাজদরবারও সপ্রশংস থাকতো মুসলিম তাহাজ্জিব-তমদ্দুনে। বর্তমান আরাকান রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকার লোক ছিলেন হয়তো। বিশেষভাবে বাংলাভাষীরা। তাই বর্তমান প্রজন্মের রোহিঙ্গারা সেখানকার নাগরিক নন এমন বেআইনী ঘোষণা মিয়ানমার সরকারের বিদ্বেষপূর্ণ আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ। আরাকানের মাটিতে যাদের বসবাস প্রায় পাঁচশ বছরের অধিককাল থেকে। এককালের জঙ্গলাকীর্ণ আরাকান ভূমি সাফসুতর করে যারা বাসযোগ্য করলো তারাই এখন নিজে দেশে পরবাসী।
কয়েকশ বছর আগ থেকেই আরাকান রাজ্য এবং বাংলার সাথে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় যোগাযোগ ছিল অবাধ। বাংলার উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপাঞ্চলে মগ বসতি আরাকান-বাংলার বৈশ্বিক যোগাযোগের প্রমাণকেই তুলে আনে। ঢাকার মগ রাজার এ রকমেরই একটি চিহ্ন। বড় মগবাজার এবং ছোট মগবাজারে মগদের বসতি গড়ে উঠে সপ্তদশ শতকের দিকে। বড় মগবাজারের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও ছোট মগবাজার বর্তমানে অস্তিত্বহীন। ধারণা করা হয় ছোট মগবাজার হাতির ঝিলের কোনো অংশে হয়তো ছিল। ঠিক তেমনি আরাকান এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বাংলাভাষী মুসলিমরা বসতি গড়ে তোলে। সপ্তম শতক থেকেই আরাকানে আরব বণিকদের আগমন নির্গমনের কারণে ইসলামের বিস্তার তখন থেকেই শুরু হয়। সেসব বণিকদের কেউ কেউ স্থানীয়দের সাথে আত্মীয়তা করে এবং স্থায়ীভাবে থেকে যায়। বর্তমান আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠী এদেরই সন্তান-সন্ততি। আরাকান অঞ্চলে ৮ম এবং ৯ম শতকেই ইসলাম পৌঁছে গিয়েছিল। সপ্তদশ শতকে এসে তা দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে যায়। আরাকান রাজা নরমিখলার (১৪০৪-৩৫) আমল থেকেই ইসলাম ধর্মের প্রসার এবং প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। আরাকানী মুদ্রায় কলেমার উৎকলন এর এক বড় চিহ্ন। উল্লেখ্য, বর্মি রাজা কর্তৃক পরাজিত হয়ে নরমিখলা বাংলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন সুলতান জামাল উদ্দিন তাকে আশ্রয় এবং যুদ্ধ করে তার সিংহাসন উদ্ধার করে দেন। সিদি খান এবং ওয়ালী খানের নেতৃত্বে দুটি সেনা দল আরাকানে প্রবেশ করে। এটি ঘটেছিল ১৪৩০ খৃস্টাব্দে। পরবর্তী সময় সেনাদের অনেকেই আরাকান রাজের অধীনে চাকরি নেয়। বিয়েশাদী করে সংসার পাতে। আরাকান রাজাগণ এবং রাজদরবার মুসলিম অনুশাসনকে অনুকরণ করতো। অনুসরণ করতো মুসলিম দরবারী সংস্কৃতি। যেমন ওয়াজির, লষ্কর, কাজী, কোতোয়াল এবং দাসদাসী ইত্যাদি। এমনকি রাজাদের পোশাক-আশাকেও থাকতো মুসলিম রাজা-বাদশাদের প্রভাব। বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী হলেও রাজা শ্রীচন্দ্র সুধর্মার (১৬৫২-১৬৮৪) অভিষেক অনুষ্ঠানে বৌদ্ধ শ্রমণ বা পুরহিত্যের পরিবর্তে একজন মুসলমান মহামাত্য নবরাজ মজলিস সভাপতিত্ব করেন। মহাকবি আলাওলের কবিতায় এই অভিষেক চিত্রটির উল্লেখ পাওয়া যায়। আরাকানে মুসলিম প্রভাব এতটাই প্রবল ছিল যে, তখনকার রাজাগণ নিজেদের পরিচয়কে গরীয়ান করার উদ্দেশে মুসলিম উপাধি যুক্ত করতেন নামের সাথে। যেমন নরমিখলা (১৪০৪-১৪৩৪) সুলায়মান শাহ, মেঙখরি, (১৪৩৪-১৪৫৯) আলী শাহ, বাসাপ্যি (১৪৫৯-১৪৮২) কলিমাশাহ, গজপতি (১৪২৩-১৫৩১) ইলিয়াস শাহ, মেঙবেঙ (১৫৩১-১৫৫৩) মুবারক শাহ, সেন পালং (১৫৭১-১৫৯৩), সিকান্দর শাহ, রাজা (১৫৯৩-১৬১২), সলিম শাহ, মেঙঘামঙ (১৬১২-১৬২২) হুসাইন শাহ।
এখানেই শেষ নয়। উজির নাজির এবং সেনাপতিদের অনেকেই ছিলেন মুসলিম এবং বাংলাভাষী। যেমন চট্টগ্রামের আশরাফ খাঁ ছিলেন রাজা সুধর্মার লষ্কর উজির। অর্থাৎ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কবি কোরেশী মাগন ঠাকুরের পিতা বড় ঠাকুর ছিলেন রাজা নরপদ্যিগির প্রতিরক্ষামন্ত্রী। তিনিও ছিলেন চট্টগ্রাম নিবাসী। মাগন ঠাকুর নিজে ছিলেন রাজা শ্রীচন্দ্র সুধর্মার প্রধানমন্ত্রী। আরাকানের রাজধানী ছিল রোসাঙ্গ। রোসাঙ্গ, রাখাইন-রোহিঙ্গার অপভ্রংশ। এই রোসাঙ্গ রাজদরবার ছিল বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল জাজিম। কবি আলাওল, কবি দৌলত কাজী এবং মাগন ঠাকুররা দাপটের সাথে সাহিত্য চর্চা করতেন। শাসন কর্মের সঙ্গেও ছিল তাদের দৃঢ় বন্ধন। বাংলাভাষা এবং বাংলা সাহিত্য তখন এতটাই প্রবল হয়েছিল যে, আরাকানী মুদ্রায় বাংলা হরফের ব্যবহার হয়ে পড়েছিল অনিবার্য। বাংলাভাষা এবং বাঙালি সমাজ আরাকানে বলশালী না হলে তো এমনটা হবার কথা নয়। পরিতাপের সংবাদ হলো সেই বাঙালিদের উত্তরসূরীগণই কিনা আরাকানে অপাংক্তেয়, অচ্ছুত বিতাড়িত। যাদের শ্রম এবং মেধায়, আরাকানের ভূমির উর্বরতা-উন্নতি, রাজনৈতিক সামাজিক প্রসার তারাই বর্তমানে বৈরী পরিবেশের শিকার।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নয়া ইতিহাস নাকি রচনা করবেন। আরাকান, রোসাঙ্গ রোহিঙ্গা রাখাইন এ শব্দগুলো ইতিহাসের একটি দৃপ্তময় অংশ জুড়ে থাকলেও বর্তমানে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে অন্ধকারে। হচ্ছে অসত্য, অবিচার এবং অসভ্যতায় নিমজ্জিত। এ অসভ্যতার জোগানদাতা মিয়ানমারের সরকার। সে দেশের অভব্য সেনাবাহিনী। মিয়ানমার সরকার আরাকানে বাংলাভাষী মুসলিমদের অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও সত্যসন্ধ ইতিহাস কিন্তু ভিন্ন সাক্ষ্য দেয়। বাংলাভাষী মুসলিমদেরই ভূমিপুত্র হিসেবে তুলে আনে। কেবল বাঙালিরাই নয় আরাকানে বিভিন্ন দেশ থেকেই লোকজন আসা-যাওয়া করতো। ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। নানান ভাষা নানান সংস্কৃতির মেলবন্ধন তখন ঘটেছে আরাকানের রোসাঙ্গে। কোরেশী মাগন ঠাকুরের কবিতায় চিত্রটি উঠে এসেছে এভাবেÑ ওলেমা সৈয়দ শেখ যত পরবাসী/পোষেন্ত আদর করি মনে স্নেহবাসি। কাহাকে খতিব কাহাকে করেন্ত ইমাম/ নানাবিধ দান দিয়া পুরান্ত মনস্কাম।’ অতীতের বৌদ্ধ রাজন্যবগের্র এমন মহত্ত্ব একেবারেই অপনোদনের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। বর্তমানের বৌদ্ধ শাসকগণ এর বিপরীত অবস্থানে মিয়ানমার শাসকদের দিকে নজর ফেরালে তো এর বাইরে চিন্তা করার জো নেই। কারণ অনুসন্ধানে বৌদ্ধ পণ্ডিতদের গবেষণায় অগ্রসর হওয়া উচিত।