শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

নদীর কান্না

রুবিনা আখতার শিমুল : নাফ নদী।
নদী থেকে একটু দূরেই আলীদের বাড়ী।
প্রায়ই বিকেলবেলা আলী খেলার মাঠ থেকে নদীর পাড়ে চলে আসে।
স্নিগ্ধ বিকেলে নদীর বুকের নৌকাগুলো তাকে ভীষণভাবে টানে। নীড়ে ফেরা পাখির ঝাঁক। নদীর দু’পাশের কাশবন, নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস দোলা দিয়ে যায় সেই কাশবনে। কী অপরূপ দৃশ্য!
নদীর পাড়ে বসে আলী এসব দৃশ্য উপভোগ করে আর নদীর পানিতে ঢিল ছুঁড়ে। নৌকার বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ পানিতে আওয়াজ আর পানিতে ঢিল ছোঁড়ার আওয়াজ মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।
নদীর পাড়ের এসব দৃশ্য দেখার ফাঁকে ফাঁকে ছোট্ট আলীর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় ওপাশের কাঁটাতারের বেড়ার দিকে। বুকের ভিতর কেমন যেন এক অজানা ভয় অনুভব করে সে। ভয়টা দূর করার জন্য আলী তখন আপন মনে প্রকৃতির সাথে কথা বলতে শুরু করে-
- নদী তুমি কি জান তোমার স্রষ্টা কে? কাশফুল তুমি লিকলিকে দন্ডের উপর দাঁড়ানো কি সুন্দর ফুল! তোমায় কে সৃষ্টি করলো জান? ঐ যে দূরে মাঠ ভরা সবুজ ধানের ক্ষেত, কাশবনে বয়ে যাওয়া বাতাস তোমারও একজন সৃষ্টিকর্তা আছে, জান? আমার আর তোমার সৃষ্টির কারিগর হচেছন মহান আল্লাহ। দেখো দয়ালু আল্লাহ আমায় দুটো চোখ দিয়েছেন বলেই আমি তোমাদের অপরূপ দৃশ্যগুলো দেখতে পাচ্ছি।
- এই ছেলে, এই ছেলে
- চমকে উঠল আলী।
- এখানে কী করছো একা একা?
- সীমান্তরক্ষীর গুরুগম্ভীর আওয়াজে একটু বিরক্ত হয় সে।
- কোন উত্তর না দিয়ে নদীর পাড় দিয়ে দ্রুত দৌঁড় দিল আলী।
ইদানিং কেন জানি সীমান্তরক্ষীদের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে নদীর পাড়ে। আগে ওদের হঠাৎ দেখা যেত। কিছু কী ঘটেছে? আনমনে ভাবতে থাকে আলী।
    এই যাহ! বৃষ্টি নামলো!
ভালোই হলো, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়ি যাওয়া যাবে। 
চলার গতি কমিয়ে হালকা বৃষ্টির ঝাপটার মধ্যে হাঁটতে লাগল সে।
হঠাৎ, একটু দূরেই একটা ভিড় নজরে এল আলীর। দৌঁড় দিল সে।
একি! নৌকাতে ওরা কারা? ছোট ছোট বাচ্চা কোলে মায়েরা করুণভাবে সীমান্তরক্ষীদের কাছে অনুনয়-বিনয় করছে, পাড়ে ওঠার জন্য। ৫/৬ বছরের তিনটি মেয়ে শিশুসহ নৌকায় আরোহী প্রায় ১০ জন। আরোহীরা সবাই কাঁদছে। কিন্তু রক্ষীরা তাদের উঠতে দিল না।
আলী অবাক হয়ে দেখলো নদীতে আরো কয়েকটি এরকম বড় নৌকা। কোন ছাউনি নেই নৌকাগুলিতে। নৌকাতে বেশীরভাগ ছোট শিশু আর মহিলা।
কী ব্যাপার? কখনো তো আমার প্রিয় নদীর বুকে এমন দৃশ্য দেখিনি!
রক্ষীরা ওদের উঠতে দিল না কেন?
বৃষ্টি জোরে আসছে। নাহ! আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ী যেতে হবে। না হলে মা বকবে। আলী বাড়ীর দিকে ছুটতে থাকে, মনে তার একরাশ প্রশ্ন।
হাঁপাতে হাঁপাতে মায়ের কাছে আসে আলী।
কী হয়েছে আলী? জিজ্ঞেস করেন মা।
সব ঘটনা খুলে বলে সে মায়ের কাছে। রক্ষীরা তাদেরকে উঠতে দিল না কেন মা? জিজ্ঞেস করে আলী।
মনে হয় পার্শ্ববর্তীদেশে কিছু হয়েছে। রাতে টিভির খবরে জানা যাবে সব।
সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে কিছুতেই আলী মন বসাতে পারছে না। বৃষ্টি ভেজা ঐ নারী শিশুগুলোর অসহায় মুখ কেবলি তার মানসপটে ভেসে উঠছে। মনটা ছটফট করছে।
মায়ের অনুমতি নিয়ে টিভির পর্দায় চোখ রাখে আলী। সেই দৃশ্য! পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে মুসলমানদের উপর বর্বর অত্যাচার চালানো হচ্ছে। ওদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হচেছ, নারীদের নির্যাতন করা হচেছ। অনেককে হত্যা করা হয়েছে। প্রাণ ভয়ে সবাই পালাচ্ছে।
নদীতে ভাসমান ঐ মানুষগুলো মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের মুসলমান, মানে আমাদেরই ভাই-বোন!
তাহলে, তাহলে ওদের সাথে এমন ব্যবহার কেন করলো সীমান্তরক্ষীরা?
কি জানি, হয়তো কোন কারণ আছে- আলী নিজেকে বুঝানোর চেষ্টা করে।
একটা অস্থির মন নিয়ে সে কোনমতে স্কুলের পড়া শেষ করে। মা আমার শরীরটা ভালো নেই। আজ আমি রাতে খাব না- এই বলে সে ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্ন দেখে সে। কে যেন ডাকছে তাকে
-------আলী!----আলী! তুমি কি করছো আলী? আমার বুকের এই নৌকা বোঝাই অসহায় মানুষগুলিকে নিয়ে এখন আমি কি করবো আলী?
তুমি ঘুমাচ্ছো? আর দেখো বাচ্চাগুলি ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় বৃষ্টির মধ্যে কাঁদছে।
আমিও কাঁদছি, কান্না ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমার। তোমরা ওদের কোন আশ্রয় দিলে না। ওরা আমার বুকে কতদিন ভাসবে? আলী তুমি, তোমরা সবাই ওদের এভাবে ফেলে রেখে নিশ্চিন্তে আছ কীভাবে? তোমাদের দেহের একটা অঙ্গ ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে কিন্তু তোমাদের সর্বাঙ্গে তা অনুভব হচ্ছে না কেন?
আমার কান্নার আওয়াজ কি তুমি শুনতে পাচ্ছ আলী---আলী-----আলী---
হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি শুনতে পাচ্ছি, আমি শুনতে পাচ্ছি। চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে উঠে আলী। কাঁদতে থাকে সে।
বাইরে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে।
বৃষ্টির পানির মত ছোট্ট আলীর দু'চোখ বেয়ে অজস্র অশ্রুধারা ঝরে পড়ছে।
নদীর কান্না আর আলীর কান্না গভীর রাতের নিকষ কালো আঁধারে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ