বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ভারতে সালাফিপন্থীদের ‘আদর্শ ইসলামী সমাজ’ তৈরির উদ্যোগ ব্যর্থ

৩ জানুয়ারি, বিবিসি : বছর দশেক আগে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কেরালা রাজ্যের কিছু মুসলমান পরিবার আদর্শ গ্রাম তৈরির যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। যারা এ উদ্যোগ নিয়েছিলেন তারা এখন ব্যর্থতার কথা স্বীকার করছেন।
 কেরালার কালিকট শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে এক ফাঁকা এলাকায়, জঙ্গলের পাশে 'আদর্শ ইসলামী সমাজ' গড়ে নিজেদের মতো করে বসবাস করতে ২৫ টি পরিবার গড়ে তুলেছিল আতিক্কঢ নামের ওই গ্রাম।
বাইরের জগত থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে 'বিশুদ্ধ ইসলামী জীবনযাপন' করতেই এ আদর্শ গ্রামটি গড়ে তোলার উদ্দেশ্য ছিল। যেখানে থাকবে একটি মসজিদ, একটি মাদ্রাসা আর বিরাজ করবে শান্তি।
সবকটি পরিবারই কট্টর ইসলামী চিন্তাধারা - সালাফি মতবাদে বিশ্বাসী।
গণমাধ্যমকে নিজেদের গ্রামে ঢুকতে দিতে চান না সেখানকার অধিবাসীরা। কিন্তু সম্প্রতি সে গ্রামের একটি পরিবার কিছুটা সঙ্কোচের সাথে বিবিসিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সেখানে।
 পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ইয়াসের আমানত সেলিম ওই গ্রামেরই বাসিন্দা।
তিন সন্তানের জনক . সেলিম বলছিলেন, " কেরালার বর্তমান মুসলমান সমাজ বিশুদ্ধ ইসলামের পথ থেকে সরে গেছে। সেজন্যই আমরা ভেবেছিলাম নিজেরাই এমন একটা গ্রাম তৈরি করব, যেখানে সত্যিকারের ইসলামী পথ অনুসরণ করে থাকতে পারব আমরা। নিজেদের গাড়িতেই বাইরে যাব এবং ফিরে আসব। অন্য কারও সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখব না, এরকমই কল্পনা ছিল আমাদের।"
 গোটা গ্রামটা উঁচু একটা দেওয়াল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। কিন্তু যে কট্টর চিন্তাধারা থেকে এই পরিবারগুলো একত্রিত হয়েছিল, সে সালাফি মতবাদই ফাটল ধরিয়েছে তাদের ঐক্যে।
গ্রামের মাদ্রাসাটির প্রধান শিক্ষক কেন ছোট বাচ্চাদের নিজের কোলে বসিয়ে শিক্ষা দেন, এ নিয়ে গ্রামবাসীরা আপত্তি তোলেন। সকলেই মেনে নেন যে ওই শিক্ষকের শাস্তি হওয়া দরকার। কিন্তু কী শাস্তি দেওয়া হবে, তা নিয়ে দেখা দেয় মতভেদ।
একদল মনে করেন, ওই শিক্ষককে একবছরের জন্য বহিষ্কার করা হোক। অন্য পক্ষের মতে তাকে গ্রাম থেকে বার করে দেওয়া উচিত।
 শেষমেশ ওই মাদ্রাসা শিক্ষককে একবছরের জন্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত বহাল হয়। কিন্তু যারা আরো বেশি শাস্তি দেবার পক্ষে ছিলেন, তারা এ সিদ্ধান্ত মানতে না পেরে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।
এখন সে গ্রামে এখন মাত্র দশটি পরিবার বসবাস করে।  সেলিমের পরিবার তাদের মধ্যে একটি।
দু:খ করে তিনি বলছিলেন, "যে আদর্শে গ্রাম তৈরির পরিকল্পনা করেছিলাম আমরা, সেটা ব্যর্থ হয়েছে। বাইরের জগত থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখাটাই বোধহয় আমাদের ভুল হয়েছে। আমি এখনও গ্রামে রয়ে গেছি বাচ্চা তিনটের জন্য। ওদের জন্ম তো এখানেই।"
অনেকেই আতিক্কঢকে পাকিস্তান কলোনি বলে ডাকত। তারপরে বলা শুরু হয় যে ওখানে উগ্রপন্থীরা থাকে। আশপাশের এলাকার মানুষ যেমন উগ্রপন্থীদের গ্রাম আখ্যা দিয়েছে, তেমনই সংবাদমাধ্যমেও এর পরিচিতি 'সালাফি গ্রাম' বলে।
গতবছরের মাঝামাঝি সময়ে যখন কেরালার ২০ যুবক নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার খবর আসে, তখন সংবাদ শিরোনামে এসেছিল আতিক্কঢ গ্রাম।
 সে যুবকরাও কট্টর ইসলামী মতাদর্শ বিশেষ করে সালাফি ভাবধারায় প্রভাবিত ছিল বলে মনে করা হয়। তবে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ওই যুবকদের সঙ্গে নিজেদের গ্রামের কোনও সম্পর্ক নেই বলে জানাচ্ছিলেন আতিক্কঢের বাসিন্দারা। তখনই পুলিশ আতিক্কঢের প্রত্যেক অধিবাসীর ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সে পুলিশ দলের এক সদস্য বলছিলেন, ‘সালাফি ভাবধারার প্রথম ধাপে বিশুদ্ধ ইসলামের চর্চা করা হয়, পরের ধাপে কট্টর চিন্তাভাবনা আরও বাড়ে আর শেষ ধাপে গিয়ে সালাফি মুসলমানরা যে কোনও কাজ করতে তৈরি থাকে। এই গ্রামের বাসিন্দারা প্রথম ধাপে আছেন। তারা বে আইনি কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত নন। তবে আমরা নজর রাখি ওদের ওপরে।’
ইয়াসের সেলিম বলছিলেন, ‘বছর খানেক আগে বাইরে থেকে দু-তিনটি পরিবার গ্রামে এসেছিল। ঘর ভাড়া নিয়ে তারা কট্টর ইসলামী শিক্ষা দিচ্ছিল। কমবয়সীদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছিল। তবে ওদের গতিবিধি নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় পুলিশকে জানানো হয় বিষয়টা। তারপর থেকে ওই পরিবারগুলো গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।’
আদর্শ গ্রাম থেকে  সেলিমের মন উঠে গেছে। তিনি এখন চান হিন্দু, খ্রিস্টান, আস্তিক, নাস্তিক - সব ধরনের মানুষই তাদের গ্রামে বসবাস করতে আসুক। কিন্তু গ্রামের অন্য অনেকের চিন্তাধারা এখনও পাল্টায় নি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ