শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘাত অনিবার্য করে তুলেছে সরকার-২

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী : লংগদুতে থাকবার জায়গাটা লঞ্চঘাট থেকে একটা মোড় পেরিয়েই। শান্ত। স্নিগ্ধ। সবুজে শ্যামলিমায় একাকার। ট্রাক-বাস নেই। গাড়ি নেই। কোনো যানবাহনের হর্ন নেই। স্কুটারের ফটফটি নেই। যানবাহন বলতে মোটর সাইকেল। তারও কোনো শব্দ নেই। আরণ্যক পরিবেশ। তার মধ্যে অবিরাম পাখির ডাক। জনমানুষেরও তেমন কোলাহল নেই। উপজেলা সদর হলেও একটি মাত্র সরু সড়ক। তারও সবটুকু পাকা নয়। সামান্য এবড়োখেবড়ো পাকা রাস্তার পর ইটের সোলিং দেওয়া পথ। সেও দাঁতভাঙা। লোক চলাচলও খুব কম। সেদিন বন্ধ ছিল না। তবু উপজেলা কমপ্লেক্সে মানুষের কোনো ভিড় দেখলাম না। এসব অফিসে মানুষের বোধকরি তেমন কোনো কাজ নেই। প্রাইমারি, হাই স্কুল, গার্লস স্কুল, কলেজও আছে। বেশ বড় বাউন্ডারির ভেতরে গার্লস স্কুল। হাই স্কুলটি বেশ কিছুকাল আগে জাতীয়করণ করা হয়েছে। জাতীয়করণ করার আগে ৫ জন শিক্ষক ছিলেন। এখনও সেই পাঁচজনই আছেন। কেউ আসেন। কেউ আসেন না। ছাত্র বেড়েছে। পাঠদান কমেছে। একটি মাদ্রাসা আছে। মাদ্রাসার সামনেও মাঝারি মাঠ। এই সরু রাস্তার দু’ পাশ ঘিরে নানা ধরনের সরকারি অফিস। সেসব কম্পাউন্ডের ভেতরে কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন আছে। কিন্তু সেখানে কেউ থাকে বলে মনে হলো না। অধিকাংশ বাসার দুয়ারেই তালা দেখলাম। আরও খানিকটা এগোলে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত পাকা বিদ্যুৎ অফিস। ১৯৯১ সালে ভেঙে পড়েছে। এখনও মেরামত করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সেখানে দেড়খানা অবিধ্বস্ত কক্ষ দখল করে থাকে কোনো পরিবার। কেউ খবর নেয় বলে মনে হলো না। যেন, চলছে চলুক।
দুপুরের খাবার রান্না হলো স্থানীয় হোটেলেই। হোটেলের ভেতরের অবস্থা জানি না। আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসা হলো পরিপাটি করে ডিশে সাজিয়ে। গ্লাস- প্লেট পরিচ্ছন্ন। আমরা বোতলের পানি কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারা জানালেন, আমরা নির্দ্বিধায় এখানকার ডীপ টিউবঅয়েলের পানি পান করতে পারি। শতভাগ বিশুদ্ধ। লেক থেকে তোলা বড় তাজা তেলাপিয়া মাছের ঝোল, শাক, সবজি, ডাল আর একটা ছোট মাছ। সুস্বাদু সুঘ্রাণ উপাদেয় খাবার।সবাই বোধকরি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিই খেলাম। নাগরিক কোলাহল নেই বলে শীত বেশ জাঁকিয়ে নামে। আমরা কম্বলের নিচে খানিকটা ভাতঘুম দিয়ে নিলাম।
পাশেই বেশ বড় ফুটবল খেলার মাঠ। সেখানে আজ দুই উপজাতীয় গ্রামের মধ্যে সেমি-ফাইনাল খেলা। বারান্দায় বসেই সে খেলা দেখা যায়। আস্তে আস্তে পিলপিল করে খেলা দেখতে আসতে শুরু করলেন বাঙালি আর উপজাতীয় নারী-পুরুষেরা। উপজাতীয় দর্শকই বেশি। কোনো ফুটবল ক্লাবের ব্যানারে এই খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল কিনা বলতে পারি না। ৩টা ৫-এ খেলা শুরু হবে। পৌনে তিনটায় এসে হাজির হলো কয়েকটা মিলিটারির গাড়ি। তারা ঝটপট গোলপোস্টে নেটটেট লাগিয়ে ফেললেন। তারাই রেফারি, লাইনস্ ম্যান। ইতিমধ্যে শত শত দর্শক এসে জড়ো হয়েছেন খেলা দেখতে। বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ। হল্লা। করতালি। ৪টা ৪০শে খেলা শেষ। ৭-৩ গোলে খেলার মীমাংসাও হলো। এরপর দর্শক-খেলোয়াড়-–মিলিটারিরা যে যার গন্তব্যে চলে গেলেন। এতক্ষণের ভরাট মাঠ শূন্য হয়ে গেলো। এখানে এসে যেমন শুনশান পরিবেশ পেয়েছিলাম, তেমনি ফাঁকা হয়ে গেল সব কিছু।
সন্ধ্যায় দেখা করতে এলেন স্থানীয় জাতীয়তাবাদী ধারার কিছু নেতা-কর্মী। চার পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকেও এসেছেন কেউ কেউ। ঐ সরু সড়ক ধরে দু’ কিলোমিটার এগিয়ে গেলে বাইট্টা বাজার। সে এলাকা বাঙালি- প্রধান। আরও দুই আড়াই কিলোমিটার এগোলে মাইনা বাজার। সেটা গঞ্জের মতো এলাকা। সেখানে আছে নানা ধরনের পণ্যের আড়ত। পাইকারি বাজার। এ এলাকাও বাঙালি প্রধান। বাইট্টা বাজার জমে উঠেছে বাস চলাচলের জন্য। এখান থেকে চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি বাস সার্ভিস চালু ছিল আগে থেকেই। এখন ঢাকা -লংগদু সরাসরি বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। বাইট্টা বাজার লংগদু ঘাটের বাজারের চেয়ে বেশ বড়। এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা তেমন একটা নেই। একমাত্র ভরসা রাবেতা আল ইসলাম। সস্তা আর আন্তরিক সেবার জন্য তারা বাঙালি-উপজাতি সকলের কাছেই প্রিয়। শুধু এই এলাকার লোকই নয়, রাবেতা আল ইসলামের কাছে চিকিৎসার জন্য আসেন আশেপাশের উপজেলার লোক। আসেন রাঙ্গামাটির মানুষও। মাইনা বাজার বাইট্টা বাজারের চেয়েও বড়। এই বাজার- প্রধান এলাকার বাইরে উপজাতীয়দের বাস। বাঙালিদের সঙ্কটের উৎস সেখানেই।
খাগড়াছড়ি শহর থেকে সাজেক পর্যন্ত, রাঙ্গামাটি থেকে লংগদু-সর্বত্রই একই আলোচনা, সরকার পাহাড়ের বাঙালিদের জীবন অনিরাপদ করে তুলেছে। এমনকি পাহাড়ের আদিবাসী যে বাঙালি, তাদের পাহাড় থেকে উৎখাত করার চক্রান্ত করছে সরকার। আর এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপর থেকে সার্বভৌমত্ব হারাতে বসেছে বাংলাদেশ। সরকার যা কিছু করছে, তা সংবিধানের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। আর এক শ্রেণীর সশস্ত্র সন্ত্রাসীর হাতে সরকার ছেড়ে দিতে বসেছে পার্বত্য এলাকার নিয়ন্ত্রণ। এর মূলে আছে সরকারের ভূমি কমিশন আইন। এই আইনের উৎস ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী দল শান্তি বাহিনীর চুক্তি। এই চুক্তি স্বাক্ষরের আগে আওয়ামী সরকার কর্তৃক গঠিত জাতীয় কমিটির ও শান্তি বাহিনীর প্রতিনিধি দলের মধ্যে কি আলোচনা হয়েছিল তার কোনো বিবরণ আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। শান্তি বাহিনীর প্রধান দুটি দাবি ছিল। প্রথমত, পার্বত্য চট্টগ্রামকে  আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দান, এবং সেখানে বসবাসরত বাঙালিদের সরিয়ে নেওয়া। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাদের এই দুটি দাবি পরোক্ষভাবে পূরণ করেছে। সরকার পার্র্বত্য চট্টগ্রামকে অঞ্চল ঘোষণা করেছে আঞ্চলিক পরিষদ স্থাপন করেছে। পরিষদকে ব্যতিক্রমী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বাঙালিদের প্রত্যাহারের ব্যাপারে পরোক্ষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
শান্তি চুক্তি মোতাবেক দুটি ভোটার তালিকা হবে। একটি ভোটার তালিকা হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য। আর একটি ভোটার তালিকা হবে আঞ্চলিক পরিষদ ও তার নিম্নের সকল নির্বাচনের জন্য। প্রথম তালিকায় সকলেই ভোটার থাকবেন। দ্বিতীয় তালিকায় শুধুমাত্র পার্র্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাগণ শামিল থাকবেন। ‘স্থায়ী বাসিন্দা’ অর্থ হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে যাদের জায়গা জমি আছে। আর জায়গা জমি আছে কিনা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যে স্থায়ী বাসিন্দা তার সার্টিফিকেট দেবেন মৌজা হেডম্যান, যিনি উপজাতীয়। চুক্তি স্বাক্ষরকালে আওয়ামী লীগ ও সন্তু লারমা সম্ভবত মনে করেছিলেন যে, বাঙালিরা তাদের স্থায়ী বাসিন্দার সপক্ষে কোনো প্রমাণ দিতে পারবেন না। অতএব তারা নিজে নিজেই পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যাবেন। তাছাড়া উভয় পক্ষ এও মনে করেছিলেন যে, যেহেতু চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং রাজনীতির অধিকার ইত্যাদিতে বাঙালিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে দেয়া হবে ও উপজাতীয়দের মুখাপেক্ষী করা হবে, সুতরাং রাগান্বিত হয়ে বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রাম ছেড়ে যাবেন। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সন্তু লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিদের উপর আঘাত হানার জন্য শান্তি বাহিনীকে শক্তিশালী করে তোলেন। যারা ধারাবাহিকভাবে বাঙালিদের উপরে হামলা, নির্যাতন ও তাদের নামে বরাদ্দকৃত জমি দখল করে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করেন। এর মধ্যে ভারসাম্যের ব্যবস্থায় ছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু সরকার বহু এলাকা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বাঙালিরা এখন উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের করুণার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন।
২০০১ সালের ৫৩ নম্বর আইন। তথা পার্র্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ আইনের ২০ ধারার বিপরীতে আঞ্চলিক পরিষদের মাধ্যমে প্রথমে সন্তু লারমা ১৯ দফা সুপারিশ পেশ করেন। পরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন কমিশন আইন ২০০১ সালে পাসের পর থেকে গত দেড় যুগ থেকে সরকারের নানা পর্যায়ে এ আইন সংশোধন নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদেও আলোচনা হয়েছে। কিন্তু দেশের সংবিধান ও সার্বভৌমত্বের বিষয় বিবেচনায় সে সব সংশোধনী শেষ পর্যন্ত কার্যকর করা যায়নি। এরপর বেশ কিছু দিন নীরব থেকে হঠাৎ করেই ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি আইন কমিশন আইন ২০০১-এর ১৪টি সংশোধনী অনুমোদন করে মন্ত্রিপরিষদ। সংসদ বসতে দু’মাস দেরি থাকায় তা রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়। পরে সংসদেও তা পাস করিয়ে নেয়া হয়। এ সব সংশোধনী কার্যকর হলে পাবর্ত্য অঞ্চলে বসবাসরত বাঙালিরা যেমন তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হতে পারেন, তেমনি সে অঞ্চলের ভূমির উপর সরকারের কর্তৃত্ব হারানোর আশঙ্কাও রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে ইতিপূর্বে যেসব ভূমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে, সংশোধিত আইনে সে বন্দোবস্তকে ‘অবৈধ’ বলে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। অপর দিকে অবৈধ বন্দোবস্ত এবং অন্যান্য ভূমি বিরোধ ‘পাবর্ত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন রীতি ও পদ্ধতি’ অনুযায়ী নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত ‘আইন রীতি ও পদ্ধতি’ বলতে মূলত হেডম্যান, কারবারি ও সার্কেল চিফদের ব্যক্তিগত মতামত ও সিদ্ধান্তকে বুঝানো হয়েছে। কিন্তু ঐ তিন ব্যক্তির সমন্বয়ে করা ব্যবস্থাটি একটি সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। তাদের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা আশা করা অবাস্তব। তাছাড়া ইচ্ছা করলেও যে জেএসএস  কিংবা ইউপিডিএফ এর সশস্ত্র ক্যাডারদের নির্দেশের বাইরে সেখানে কারো কোনো কথা বলার সুযোগ নেই। ফলে নিশ্চিত করে বলা যায় যে, আইনের এই ধারাটি অপব্যবহার করে বাঙালিদের বসতভিটা ও জায়গা-জমি হতে তাদের বঞ্চিত ও উচ্ছেদ করা হবে। তাছাড়া এ আইন বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল রিজার্ভ ফরেস্ট, সরকারি শিল্প-কারখানা, সেনানিবাস, বিজিবি, পুলিশ ব্যারাক, এসপি অফিস, ভূমি অফিস, আদালতসহ সকল প্রকার সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য যে ভূমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছে, তাও অবৈধ হয়ে যাবে।
এর আগে সিদ্ধান্ত ছিল ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তই কমিশনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে। কিন্তু তাতেও সরকারের কিছুটা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু এখন সংশোধিত আইনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিধান করা হয়েছে। যে কমিটি গঠিত হবে তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে উপজাতীয়রা। এ ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান কার্যত ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হবেন। উপজাতীয়দের চাপিয়ে দেওয়া যে কোনো সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া ছাড়া তার কোনো গত্যন্তর থাকবে না। ফলে কার্যত গোটা ব্যবস্থাই উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যাবে। এর কোনো চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সও থাকবে না। কারণ ভূমি কমিশনের চেয়ারম্যান যেই হোন না কেন, তার সংবিধান রক্ষার শপথ গ্রহণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এটি একটি বিপজ্জনক ব্যবস্থা। ভূমি কমিশন আইনে বলা হয়েছে, ‘এই ধারার অধীনে কমিশনের সচিব ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে পার্বত্য জেলার উপজাতীয়দের অগ্রাধিকার প্রদান করিতে হইবে।’ এর ফলে পার্বত্য ভূমি কমিশন মূলত একটি উপজাতীয় কমিশনে পরিণত হয়েছে। এর কোনো স্তরেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার অর্ধেক অংশ বাঙালিদের জন্য ভরসার কোনো স্থান নেই। কমিশনে বাঙালি প্রতিনিধি না রাখার অর্থ হলো এটা স্বীকার করে নেয়া যে, এখানে বাঙালিদের কোনো স্বার্থ জড়িত নেই। যা স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের মূলনীতির বিরোধী। তাছাড়া কমিশনের রায়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ না রাখায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাঙালি স্বার্থ তথা জাতীয় স্বার্থ বিঘিœত হলেও প্রতিকারের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এর পেছনে বাঙালিদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করার গভীর ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে।
পার্বত্য এলাকার ভূমি কমিশনের আলোচনা শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে চাঁদাবাজিতে। পাহাড়ি-বাঙালি সকলের কাছ থেকে সকল পেশাজীবীর কাছ থেকে জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (সংস্কার) ও ইউপিডিএফ রীতিমতো রশিদ দিয়ে চাঁদা আদায় করছে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে প্রাণনাশ থেকে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা সবাই এ বিষয়ে অবহিত। তারা বিষয়টি সরকারের কাছে তুলেও ধরেছেন। বিষয়টি সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলকেও জানানো হয়েছে। বছরে এই তিন জেলায় ঐ তিন সন্ত্রাসী বাহিনী সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তোলে ৪০ কোটি ২৯ লাখ ১৬ হাজার টাকা বলে মানবজমিন রিপোর্ট করেছে। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশের সংবিধানে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। কেবল ধর্ম গোষ্ঠী বর্ণ নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে। কেবল ধর্ম গোষ্ঠী বর্ণ নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা এই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না। তাছাড়া বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক ইহার যে কোনো স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন করতে পারবেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনে এর সব কিছু অস্বীকার করা হয়েছে, যা সংবিধানের ঘোরতর পরিপন্থী।
এখন গোটা পার্বত্যাঞ্চল জুড়ে একই আলোচনা: কী করতে চায় সরকার? কী করবে পাহাড়ের বাঙালীরা? পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী বাঙালিরা কি বহিরাগত উপজাতীয়দের করুণার পাত্র হয়ে তাদের নির্যাতনের কাছে মাথা নত করে থাকবে, নাকি নিজের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে?
ঘড়ির কাঁটায় রাত খুব বেশি না হলেও পাহাড়ি জনপদ দ্রুত শান্ত হয়ে যায়। পাশেই টিনের ঘরের চালের ওপর  টপ করে মাঝে মধ্যে হয়তো পাহাড়ে বসবাসকারী দরিদ্র উপজাতি ও বাঙালীদের অশ্রুর মতো দু’ এক ফোঁটা শিশির পড়ে। শীত কুয়াশার মতো ভারী হয়ে নামতে থাকে। আমি লংগদুর বাংলোর ভেতরে নির্ঘুম চোখ খুলে সামনের দিনগুলোর কথা ভাবতে থাকি। [সমাপ্ত]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ