পেলভিক ইনফ্লামেটরি ডিজিজ
নারীদেহের প্রজননতন্ত্র বা তলপেটের মারাত্মক প্রদাহের মধ্যে পিআইডি বা পেলভিক ইনফ্লামেটরি ডিজিজ অন্যতম। বেশির ভাগ মহিলাই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ দিন কষ্ট ভোগ করে। এ প্রদাহ দুই রকম হতে পারে- প্রথমত, জননাঙ্গের নিচের দিকের প্রদাহ। দ্বিতীয়ত, জননাঙ্গের ওপরের দিকের প্রদাহ।
কারণ: এ রোগের অনেকগুলো কারণের মধ্যে যৌন রোগ, যেমন- গনোরিয়া ও ক্ল্যামাইডিয়া সংক্রমণ উল্লেখযোগ্য। স্বামীর যদি যৌন রোগ থাকে তাহলেও হতে পারে। ৬০-৭০ শতাংশের ক্ষেত্রে পিআইডি যৌন রোগের সাথে সম্পর্কযুক্ত। জননাঙ্গে যক্ষ্মার জীবাণুর সংক্রমণেও পিআইডি হতে পারে। মদপান, ড্রাগ আসক্তি ও একাধিক যৌনসঙ্গীর কারণে পিআইডি হয়ে থাকে। অন্যান্য কারণের মধ্যে অল্প বয়সে যৌনজীবন শুরু, মাসিকের সময় সহবাস, অস্বাস্থ্যকর ও অদক্ষভাবে গর্ভপাত করা এবং ডেলিভারি করানো, ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে কনডম ব্যবহার না করা, স্ত্রী জননাঙ্গের কোনো অপারেশনের পর লুপ বা কপারটি পরানোর পর এ প্রদাহ হতে পারে।
সাধারণত ১৪-২৫ বছর বয়সের মহিলারা পিআইডিতে বেশি আক্রান্ত হয়। অশিক্ষিত ও দরিদ্র মহিলাদের মধ্যে এ রোগের প্রকোপ বেশি, কারণ তাদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা খুবই কম।
লক্ষণ: তলপেটে তীব্র ব্যথা হওয়া। এ ব্যথা কোমর ও বাহুতে বিস্তার করতে পারে। তলপেট ভারী অনুভব করা। সহবাসে এবং জরায়ু ও জরায়ুমুখ স্পর্শ করলে প্রচ- ব্যথা অনুভব করা। যোনিপথে দুর্গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব বা পুঁজ নির্গত হওয়া। মূত্রনালীর চারপাশের গ্রন্থিতে বা বারথোলিন গ্লান্ডে সংক্রমণ থাকে ফলে প্রস্রাব করার সময় ব্যথা ও জ্বালা-যন্ত্রণা করতে থাকে। মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তপাত হতে পারে। শরীরে সব সময় জ্বর থাকতে পারে। মাথাব্যথা, বমি ভাব, পেট ফাঁপা, খেতে অরুচি ও স্বাস্থ্য ক্ষীণ হয়ে যেতে পারে।
পরীক্ষা: রক্তের রুটিন পরীক্ষা করতে হবে। জরায়ুমুখের রস পরীক্ষা করলে গনোরিয়ার জীবাণু পাওয়া যেতে পারে। বাওল সাউন্ড কম থাকলে পেটের এক্স-রে করার প্রয়োজন হতে পারে। ট্রান্স ভ্যাজাইনাল আলট্রাসনোগ্রাম ও ল্যাপারোস্কপি করলে আরো সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব।
কিছু কিছু সমস্যা আছে, যাদের লক্ষণ পিআইডির মতো মনে হতে পারে যেমন- একিউট এপেন্ডিসাইটিস, মূত্রনালীর তীব্র প্রদাহ, জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণ বা অক্টোপিক প্রেগনেন্সি, সেপটিক অ্যাবরশন বা গর্ভপাত ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে দ্রুত পরীক্ষা করে সঠিক কারণ নির্ণয় করতে হবে।
চিকিৎসা: পিআইডির লক্ষণগুলো দেখা গেলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগে চিকিৎসা করতে হবে। অবস্থা জটিল হলে প্রয়োজনে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করাতে হবে। মুখে খাওয়ার জন্য ট্যাবলেট ওফ্লক্সাসিন ৪০০ মিলিগ্রাম ১২ ঘণ্টা পরপর ১৪ দিন, এর সাথে ট্যাবলেট মেট্রোনিডাজল ৪০০ মিলিগ্রাম ১২ ঘণ্টা পরপর ১৪ দিন খেতে হবে। যদি দেখা যায়- মুখে ওষুধ খাওয়ার তিন দিন পরও লক্ষণগুলো প্রশমিত হচ্ছে না বা রোগীর অবস্থার অবনতি হচ্ছে, তবে তৃতীয় জেনারেশন সেকালোস্পোরিন বা ইনজেকশন সেফটিয়াক্সন ২৫০ মিলিগ্রাম মাংসপেশিতে এককমাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে, তার সাথে ডক্সিসাইক্লিন ১০০ মিলিগ্রাম ১২ ঘণ্টা পরপর ১৪ দিন মুখে খেতে হবে।
পিআইডি রোগীর যৌনসঙ্গীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও যৌন রোগ নির্ণয় করে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। যৌনসঙ্গীর সঠিক চিকিৎসা না হলে রোগিণী আবার আক্রান্ত হয়ে পড়বে।
গর্ভাবস্থায় পিআইডি হলে গর্ভবতীকে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি রেখে ইনজেক্টেবল অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দ্রুত চিকিৎসা করাতে হবে। গর্ভবতীর দ্রুত এবং সঠিক চিকিৎসা না হলে মা ও শিশু নানা রকম জটিলতার শিকার হবে, এমনকি শিশুর মৃত্যুও হতে পারে।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা: পিআইডি রোগীর উপযুক্ত চিকিৎসা করা না হলে পরবর্তীকালে বন্ধ্যত্ব এবং অন্যান্য জটিলতা দেখা দেয়, যেমন- পেলভিক পেরিটোনাইটিস বা পেলভিক সেলুলাইটিস, টিউবো-ওভারিয়ান অ্যাবসেস, পেলভিক অ্যাডহেশন, পরিপাকতন্ত্রের অ্যাডহেশন, গনোকক্কাল আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি। সে জন্য যৌন রোগগুলোর প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা দিলে পিআইডি হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব। সন্তান হওয়ার পর বা গর্ভপাতের পর বিশেষ পরিচ্ছন্নতা দরকার। মাসিকের সময় কাপড় বা ন্যাপকিন যাই ব্যবহার করা হোক না কেন, তা অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
একবার ব্যবহার করা জিনিস কখনোই দ্বিতীয়বার ব্যবহার করা যাবে না। প্রতিবার বাথরুমে যাওয়ার পর যৌনাঙ্গ ভালো করে ধুয়ে ফেলতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ সহবাসে কনডম ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কনডম সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেট ডিজিজ থেকে রক্ষা করে যৌন রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
-ডা. জ্যোৎস্না মাহবুব খান
জেনারেল প্রাকটিশনার (মহিলা ও শিশু)
মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।