শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ড. পিয়াস করিমদের আজ বড় প্রয়োজন

এইচ এম জোবায়ের : টেলিভিশন টক শোর পরিচিত মুখ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক পিয়াস করিম হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ইন্তিকাল করেছিলেন ২০১৪ সালের ১৩ অক্টোবর। মানুষ মারা গেলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। থেকে যায় তার কৃতকর্ম। অধ্যাপক পিয়াস করিমও সেরকম একজন ব্যক্তিত্ব যিনি চলে গেলেও রেখে গেছেন তার শেষ জীবনের কিছু সাহসী উচ্চারণ। মিডিয়ানির্ভর এই সভ্যতায় তিনি অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন একজন সাহসী-রূঢ় সত্য বচন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে। এদেশের লাখ মানুষ টিভি টকশো অন করে বসে থাকতো তার বাস্তব ভিত্তিক জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য শুনার জন্য।  

বাংলাদেশের রাজনীতি আজ কলুষিত, অর্থনীতি হচ্ছে নিপীড়িত মানুষদের শেষণের হাতিয়ার, সংস্কৃতিতে নগ্নতা ও পরনির্ভরতার জয়জয়কার। রাজনৈতিক অঙ্গনে চাটুকারিতার মাত্রা পৃথিবীর যে কোন দেশকে বহু আগেই ছাড়িয়েছি আমরা। এক নেতার এক দেশের পাশাপাশি একেক নেতা একেক দল পরিচালনা করছেন। সেসব দলের বাকীরা অন্ধ অনুসারী মাত্র! উচিত কথা যথা সময়ে যথাস্থানে বলার লোকের রয়েছে সীমাহীন অভাব। বিশেষ করে দেশের বুদ্ধিজীবী মহল আজ অনেকটাই বিক্রি হয়ে গেছেন স্বার্থের মায়াজালে। সরকারি দলের সমর্থক বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা অতীতের মত এখনও বেশি। সরকারের আনুকূল্য নিয়ে স্বার্থ হাসিলের খায়েশ কার নাই? বেশির ভাগই আখের গোছানোয় ব্যস্ত। সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার লোকের অভাব সরকারি দলেও নাই। তবে সামনাসামনি না বলে তারা কাপুরুষের মতো আড়ালে কথা বলেন। এ সকল ক্ষেত্রে অধ্যাপক পিয়াস করিম ভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সত্য বলতেন ভয় ভীতি ও পারিপার্শি¦ক চাপকে উপেক্ষা করে। কোন্ চ্যানেলে কথা বলছেন বা কার সামনে বলছেন কিংবা কোথায় বলছেন তা তিনি বিবেচনা করতেন না। দেশ কি বিদেশ তিনি সময়ের কথা সময়ে বলতেন। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তিনি তার শেষ সময়গুলোতে যেসব বিশ্লেষণ করেছেন তা বাস্তবতার নিরিখে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। বিশেষ করে বিগত এক দশক ধরে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সংক্রান্ত বিষয়টিই বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দেশ-বিদেশে আলোচিত হয়ে আসছে। দেশের হাতেগোনা দু-একজন বুদ্ধিজীবী ছাড়া সকল বুদ্ধিজীবীই অনেকটা জ্ঞানপাপীর মতই এ ইস্যু থেকে সচেতনভাবে নিজেদেরকে দূরে রেখেছেন। এক্ষেত্রে নিজের খেয়ে বনের মেষ না তাড়ানোর পলিসি নিয়েছেন তারা। বনের মেষ পাশের কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল খাচ্ছে দেখেও স্বার্থবাজ লোকটি নিজে উদ্যোগী হয়ে মেষটি না তাড়িয়ে তামাশা দেখলেন। আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরাও জামায়াত ইস্যুতে ঐ স্বার্থবাজ লোকটির মতই ভূমিকা রেখে চলেছেন। সত্যকে তারা ইচ্ছেকৃতভাবে গোপন করেন। কিন্তু সময়ের সাহসী মুখ হিসেবে গর্জে উঠলেন ড.পিয়াস করিম। বনের মেষকে গরিব কৃষকের একমাত্র অবলম্বন খেতটি খেতে দেখে তিনি নিজের খেয়ে মেষ তাড়াতে লাগলেন। অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম বলেছিলেন- বাংলাদেশের তিনশত সংসদীয় আসনে জামায়াতের মোট ভোটের সংখ্যা হবে প্রায় এক কোটি। আর তাদের এক কোটি ভোটারের প্রত্যেকের কমপক্ষে ৪ জন করে আত্মীয় স্বজন থাকলে তারাও জামায়াতের সমর্থক। এ হিসেবে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৫ কোটি লোক জামায়াতের প্রতি সহানুভূতিশীল। জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে প্রফেসর পিয়াস করিমের এ বিশ্লেষণটাই হচ্ছে বাংলাদেশের বাস্তবতা। কিন্তু এদেশের মিডিয়ার ইসলামবিরোধী একটি অংশ অপপ্রচার চালিয়ে সাধারণ মানুষকে জামায়াতে ইসলামী ও তার সমর্থকদের ব্যাপারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চায়।

যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রসঙ্গে ড. পিয়াস করিম বলেছিলেন, “একটা জিনিস আমরা লক্ষ্য করে আসছি, যেসব ইস্যু বারবার আমাদের সামনে আসছে, হোক সেটা পদ্মাসেতু, হলমার্ক কিংবা বিশ্বজিত প্রসঙ্গ, সব বিষয়ে সরকার বলে আসছে, এটা নাকি যুদ্ধাপরাধীর বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র। এ ধরনের অপচেষ্টা আমাদের জাতিকে বিভক্ত করে দিয়েছে। আমরা সবখানে মুক্তিযুদ্ধকে টেনে আনছি। এটা মোটেই ঠিক নয়। এভাবে মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।”

‘আগামী বছর ১৪ জন যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসি দেয়া হবে’- বলে মহাজোট নেতারা যে মন্তব্য করেছিলেন সে প্রসঙ্গে ড পিয়াস করিম বলেছিলেন, “একটা রাজনৈতিক দলের জনসভা থেকে কিভাবে ঘোষণা দেয়া হয় যে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হবে। এটা কোন গণতান্ত্রিক দেশে হতে পারে না। বিচারের ব্যাপারে কাকে ফাঁসি দিবে আর কাকে কারাদণ্ড দিবে সেটা দিবে আদালত। এভাবে কথা বলে বিচার ব্যবস্থার চরম অবমাননা করা হয়েছে।” চ্যানেল আইয়ের মধ্যরাতের টকশো ‘আজকের সংবাদপত্রে’ তিনি এসব কথা বলেন।

বিএনপির বর্তমান তৎপরতার দিকে ইঙ্গিত করে অধ্যাপক পিয়াস করিম বলেছেন, “সরকারের বিরুদ্ধে খুন-গুম, অর্থনৈতিক জালিয়াতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দেশব্যাপী জনগণের ক্ষোভ রয়েছে। আন্দোলনের মাঠ  তৈরিই আছে। এখন বিএনপির কাজ হলো জনগণের এ ক্ষোভকে ভাষা দিয়ে আন্দোলনে নামা। আর ঈদের পর আন্দোলনে নামার যে হুমকি দিচ্ছে, এটা তাদের জন্য শেষ সুযোগ। তার এই দূরদর্শী মন্তব্য কতটা সময়োপযোগী ছিল তা বর্তমানে উপলব্ধি করা কোন কঠিন ব্যাপার নয়। 

জামায়াত প্রসঙ্গে ড. পিয়াস করিম বলেন, “দেশ পরিচালনায় আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা এবং সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিএনপির ব্যর্থতায় রাজনীতিতে প্রধান শক্তি হিসেবে ভবিষ্যতে জামায়াতের উত্থানের সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও আমি তা চাই না। তবে চোখ বন্ধ রাখলেই তো মহাপ্রলয় ঠেকানো যাবে না, প্রলয় হবেই। তবে জামায়াত না হলে আরেকটি শক্তি (সেনাবাহিনী) দেশের ক্ষমতায় চলে আসবে।” দেশের চলমান সংকট উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি, ফলে জনগণের পছন্দের সরকার ক্ষমতায় আসেনি। তাই সকল দলের অংশগ্রহণে অবিলম্বে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।” সাথে সাথে তিনি একথাও বলেন- “তবে তিনি বলেন, এমন অক্ষম, অপদার্থ ও একচোখা নির্বাচন কমিশনের অধীনে একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা কখনই সম্ভব নয়।”

মূলত একটি জাতিকে যখন সবদিক থেকে বেঁধে ফেলা হয়, যখন সবকিছুর শেষ পরিণতি হয় কারাগার অথবা সরকারি জুলুম-নির্যাতন তখন বনের বাঘও শিয়ালে পরিণত হয়। প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাস অথবা ঘূর্ণিঝড়ের কবলে থাকা সিংহ ও হরিণ পাশাপাশি অবস্থান নেয়। বর্তমান সময়ে চলতে থাকা এরকম দুর্যোগের কারণেই অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেশ নিয়ন্ত্রণকারী অধিকাংশ শক্তি বাহ্যত এককাতারে চলে গেছে। তাল মিলিয়ে চলছে সবাই। সত্য কথা যথাস্থানে বলার লোকের বড় অভাব আজ। এহেন পরিস্থিতিতে ড. পিয়াস করিম আমাদেরকে ভিন্নভাবে বলতে ও উপলব্ধি করতে শিখিয়েছেন। পায়ে দলে কীভাবে বিপরীতে চলতে হয় তা তিনি দেখিয়ে গেছেন। মুক্ত চিন্তাটি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে না করে ভিন্নভাবে করতে শিখিয়েছেন। তিনি মার্কসবাদী ছিলেন একথা সত্য হলেও তিনি একজন কট্টর জাতীয়তাবাদীও ছিলেন। পাকিস্তানের আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে ভারতের আধিপত্যকে মেনে নিতে তিনি কখনই রাজি ছিলেন না। তাইতো সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার লাশ শহীদ মিনারে নিয়ে যেতে দেয়া হয়নি। 

মাওলানা সাঈদী সাহেবের রায় পরবর্তী ঘটনা প্রসঙ্গে রেডিও তেহরানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে সমস্ত রকমের রাজনৈতিক সহিংসতার বিরুদ্ধে। আমি যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সহিংসতার বিরুদ্ধে একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বিরুদ্ধে। আর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনেক বেশি সহিংস হওয়াার ক্ষমতা রাখে। আজকে জামায়াতে ইসলামী বলি, আওয়ামী লীগ বলি বা বিএনপি বলি- দল হিসেবে তারা যতটা সহিংস হওয়ার ক্ষমতা রাখে রাষ্ট্রযন্ত্র তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা রাখে। আর সেই রাষ্ট্রের পুলিশ যখন অসংযত ব্যবহার করে, যখন কোন রকম বিধি-নিষেধ না মেনে জনগণের ওপর গুলী করে তখন সেটা খুবই দুঃখজনক। ধরা যাক- জামায়াতের মিছিল থেকে যদি আইন লংঘন করা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে পুলিশের সামনে কতগুলো পথ খোলা ছিল। পুলিশ প্রথমে তাদের সতর্ক করতে পারত, এরপর পুলিশ কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ করতে পারত তারপর একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে গুলীর নির্দেশ দেয়া যেত। কিন্তু পুলিশ তা না করে প্রথমেই পাখির মতো গুলী করা এটাকে তো কোন রাজনৈতিক বিধিমালায় বা কোন গণতান্ত্রিক নিয়ম নীতি অনুসারে এটাকে জাস্টিফাই করা যাবে না। এটা সরাসরি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। সরকার চেষ্টা করেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালু করে একটি প্রতিবাদ করতে। কিন্তু সেই প্রতিবাদ ন্যায় নাকি অন্যায় সে বিতর্কে আমি যাচ্ছি না। তবে তারা একটি প্রতিবাদকে দমিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। এটা কিন্তু কাউন্টার প্রডাকটিভ হতে পারত। কিন্তু এভাবে তো আসলে হয় না। পৃথিবীর কোন দেশেই ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্যাতন চালিয়ে স্তব্ধ করা যায়নি আজ পর্যন্ত। আমি Karen Armstrong-এর The Battle for God যখন পড়ছিলাম তখন দেখলাম পৃথিবীর কোন জায়গায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে ওরকভাবে দমন করা যায়নি। বরং দমন করার যত চেষ্টা করা হয়েছে ততই তারা আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে। ফলে সরকারের সহিংসতাকে আমি  নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিরোধিতা করি। তাছাড়া বাস্তব রণকৌশলগত দিকে থেকেও সরকার প্রচন্ড রকমের একটা ভুল করছে বলে আমার ধারণা। কারণ জামায়াতের আন্দোলনে ও প্রতিবাদে পুলিশের বাধা দেয়ার ফলে বা পুলিশি আচরণের কারণে তাদের Political Resolve-কে আরো বেশি দৃঢ় করেছে।

পরিশেষে বলতে চাই অধ্যাপক ড. পিয়াস করিমদের মতো লোকের আজ বড় প্রয়োজন। বাংলাদেশের বর্তমান সংকটকালে তার ভবিষ্যৎ মন্তব্যগুলো অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হচ্ছে। তাই সাধারণ মানুষের চেতনায় ড. পিয়াস করিম আজো জীবিত থেকে প্রতিনিয়ত কড়া নাড়ছে সত্য-বাস্তব কথা অকুতোভয়ে বলতে। 

[email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ