শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মুক্ত মতামত বন্ধ হলে মানুষ বাঁচবে কিভাবে?

জিবলু রহমান : বিশ্বে বর্তমানে গণতন্ত্রের যে দুর্দশা, তার সুযোগ নিচ্ছে কিছু ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার। গণতন্ত্র হয়ে উঠছে জবরদখলের গণতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে সরকাগুলো। এর চাপটা সেই সব দেশের গণমাধ্যমের ওপর এখন চরমভাবেই পড়তে শুরু করেছে। কর্তৃত্ববাদ স্বাধীন গণমাধ্যম পছন্দ করে না বা একে ভয় পায়। ফলে নানা কায়দায় গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার পথই বেছে নেয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষায় সাংবাদিকদের ত্যাগ ও ভূমিকা অনেক। প্রত্যক্ষ রাজনীতিবিদদের চেয়েও কম নয় সাংবাদিকদের আত্মত্যাগ। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন খ্যাতনামা সাংবাদিকরা। সেই ধারা চলছে এখনো। বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা চাপেরমুখে থাকলেও সেই প্রতিবাদী ধারা রয়েছে অব্যাহত, যা সংবিধান সম্মতও।
আমাদের সংবিধানে বাক-স্বাধীনতার বিধান থাকলেও তার চর্চায় বাধা আসে ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের পর পরই। আমাদের সংবিধানের ৩৯-এর ২(ক) তে বলা আছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল’।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ও স্বাধীনতা যুদ্ধে গণতন্ত্রের দাবি ছিল জোরালো। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই আওয়ামী লীগ সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করতে খড়গ ঝুলিয়ে দেয়। সে সময় গ্রেফতার হন তখনকার জাসদের মুখপত্র জনপ্রিয় দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদক কবি আল মাহমুদ ও ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডের সম্পাদক এজেডএম এনায়েতুল্লাহ খান। স্বাধীনতার ৪ দশক পর এখনো চলছে সেই অবস্থা। এদের মধ্যে এজেডএম এনায়েতুল্লাহ খান মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু স্বাধীন সাংবাদিকতার পুরোধা হিসেবে প্রেরণা হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। সাংবাদিকতা ছাড়াও তিনি মন্ত্রীত্ব ও রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। একদা এক আলাপচারিতায় তিনি বলেন, ‘আমি কোনো রাজনৈতিক দল করি না, কিন্তু রাজনীতিতো করি’ (আই ডুপলিটিকস, বাট আই হ্যাভ নো পার্টি)। (সূত্রঃ দৈনিক দিনকাল ২৪ এপ্রিল ২০১৬)
বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহর ওপর হামলা চালিয়েছিল সন্ত্রাসীরা। ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সুপ্রিম কোর্ট বার অডিটোরিয়ামে এক অনুষ্ঠান শেষে বেরিয়ে আসার পথে এ হামলা হয়। হামলায় ড. মাহবুব উলাহর শরীরের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে চোখে আঘাত লেগেছে। বিকেলে তাকে ভর্তি করা হয় ল্যাবএইড হাসপাতালে।
দুপুরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ড. মাহবুব উল্লাহ। অডিটোরিয়াম থেকে বের হওয়ার পরপরই পাঁচ-ছয়জন অজ্ঞাত সন্ত্রাসী তার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। দুর্বৃত্তরা মাহবুব উল্লাহকে মেঝেতে ফেলে উপর্যুপরি কিলঘুষি দেয় ও তার শার্ট ছিঁড়ে ফেলে। পরে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।
এ ঘটনার পরেই ছেঁড়া শার্ট গায়ে থাকা অবস্থাতেই সুপ্রিম কোর্ট থেকে গাড়ি নিয়ে সরাসরি ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-অ্যাবের মহাসমাবেশে চলে আসেন ড. মাহবুব উল্লাহ। তিনি যখন মিলনায়তনে আসেন তখন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি খালেদা জিয়া বক্তব্য রাখছিলেন। মাহবুব উল্লাহকে দেখে বিএনপি চেয়ারপারসন আবার কথা বলা শুরু করেন।
খালেদা জিয়া বলেন, সুপ্রিম কোর্টের ভেতরে মাহবুব উল্লাহর ওপর যে হামলা হয়েছে তার দায়-দায়িত্ব হাসিনাকেই নিতে হবে। আমরা মনে করি, হাসিনার সন্ত্রাসীরাই মাহবুব উল্লাহর ওপর হামলা করেছে। এর দায় তিনি না নিলে তাকে গদি ছাড়তে হবে।
খালেদা জিয়া বলেন, এভাবে দেশ চলতে পারে না। এভাবে দেশ চলতে দেয়া যায় না। হাসিনাকে বলব, আপনি আপনার সন্ত্রাসী-খুনিদের সামলান। অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার করুন, নইলে গদি ছাড়–ন।
মাহবুব উল্লাহ আহতাবস্থায় বিএনপির চেয়ারপারসনের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, আমি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের একটি বই প্রকাশনার অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। ওই অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক, আবদুল আউয়াল মিন্টু, সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদসহ অনেকে ছিলেন। অনুষ্ঠানটি নির্বিঘেœ হয়েছে। অনুষ্ঠান শেষে আমি মিলনায়তন থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে আমার কল্পনার বাইরে হঠাৎ চার-পাঁচজন ছেলে এসে আমাকে ঘিরে মেঝেতে ফেলে মারতে থাকে। এ সময়ে অনুষ্ঠান শেষে মানুষজন মিলনায়তন থেকে বেরিয়ে এলে তারা দ্রুত পালিয়ে যায়।
তিনি আবেগময় কণ্ঠে বলেন, আমি একজন শিক্ষক। আমার কোনো শক্র নেই। যতটুকু প্রয়োজন সেভাবেই কথা বলি। আমি আজ এই হামলার নিরপেক্ষ তদন্ত চাই। হামলাকারীদের শাস্তি দাবি করছি। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এই ঘটনায় আমি উপলব্ধি করছি, এ দেশে কোনো সভ্য মানুষের পক্ষে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহর ওপর সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান বুদ্ধিজীবীদের সংগঠন শত নাগরিক। সংগঠনটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ও সদস্য সচিব কবি আবদুল হাই শিকদার স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে অবিলম্বে হামলাকারীদের গ্রেফতার এবং শাস্তির দাবি জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ দেশের একজন জ্যেষ্ঠ নাগরিক। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস, আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক শাখায় তার বিচরণ। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের এই মহানায়ক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে সাহসী উচ্চারণের প্রতীক। এ জন্যই তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে শত নাগরিক। অবিলম্বে হামলাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয় বিবৃতিতে।
বিবৃতি প্রদানকারী শত নাগরিকের নেতৃবৃন্দ হলেন আহ্বায়ক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, যুগ্ম আহ্বায়ক বিচারপতি আবদুর রউফ, সদস্য সচিব কবি আবদুল হাই শিকদার, সদস্য ডাঃ এম এ মাজেদ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, ড. খন্দকার মোস্তাহিদুর রহমান (জাবি), ড. আ ফ ম ইউসুফ হায়দার (ঢাবি), ড. সদরুল আমিন (ঢাবি), ড. তাজমেরী এস এ ইসলাম (ঢাবি), ড. আবদুর রহমান সিদ্দিকী (রাবি), ড. আজহার আলী সরকার (রাবি), ড. হাসান মোহাম্মদ (চবি), প্রকৌশলী আবু সুফিয়ান (চট্টগ্রাম), ডঃ রেজাউল করিম (খুলনা) ও ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী (খুলনা)। (সূত্রঃ দৈনিক নয়া দিগন্ত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪)
১৬ অক্টোবর ২০১৪ পাঁচ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের হতাশা প্রকাশ করা হয় আনুষ্ঠানিকভাবে। যুক্তরাজ্য সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক রিপোর্টে তাদের এ অবস্থান তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ-কান্ট্রি কেস স্টাডি আপডেট’ শীর্ষক ওই রিপোর্টে যুক্তরাজ্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি ছাড়াও বলা হয়, বাংলাদেশের মিডিয়া বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিধিনিষেধের আওতায় আনা হয়েছে। সরকারের সমালোচনাকারী বা ভিন্নমতাবলম্বীদের আটক করা হচ্ছে। সীমিত করা হয়েছে এনজিওর কর্মকা-। এতে বাংলাদেশে সবার অংশগ্রহণমূলক একটি রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির আহ্বান জানানো হয় বিশেষভাবে। শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকে ডেভিড ক্যামেরন এই বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ওই রিপোর্টে বলা হয়, রাজনৈতিক সহিংসতার ঝুঁকি অব্যাহত রয়েছে বাংলাদেশে।
প্রতিবেদনে নাগরিক সমাজ (সিভিল সোসাইটি) ও মিডিয়ার স্বাধীনতা খর্ব করার সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সেভেন মার্ডার প্রসঙ্গও স্থান পেয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে সহিংসতার ঝুঁকি রয়ে গেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে বিক্ষোভ-সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক সহিংসতা কমে এলেও এনজিওগুলো নির্বাচনের পর থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির কথা জানিয়েছে। ২০১৪ সালে গৃহীত নতুন নীতি ও আইন নাগরিকসমাজের ব্যাপ্তি ও মিডিয়ার স্বাধীনতা খর্ব হওয়া নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না হলে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না মনে করে বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোট ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ওই নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে প্রতিদ্ব›িদ্ধতা না হওয়ার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ উপর্যুপরি দ্বিতীয় মেয়াদে জয়ী হয়। ওই নির্বাচনের দিন ২১ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক স্কুলভিত্তিক নির্বাচনী কেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া হয়। নির্বাচনের পর থেকে বিএনপি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে, ২০১৩ সালের চেয়ে অনেক কম হরতাল ও অবরোধ হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ জানুয়ারি ওই সময়ের মানবাধিকারবিষয়ক মন্ত্রী ব্যারোনেস ওয়ার্সি রাজনৈতিক জবাবদিহি সমাধানে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতি একসাথে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি সব দলের ভীতি প্রদর্শনমূলক কর্মকা- এবং অবৈধ সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে গণতান্ত্রিক জবাবদিহি জোরদার এবং কোনো ধরনের ভীতি প্রদর্শন বা প্রতিহিংসার আশঙ্কা ছাড়াই ভবিষ্যতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের আগ্রহ ও সমতা সৃষ্টিতে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার বাংলাদেশের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়কমন্ত্রী, যোগাযোগমন্ত্রী ও বাণিজ্যমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্চে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে সব প্রধান দল প্রার্থী দেয়। প্রথম দুই দফা নির্বাচনে বিএনপির চেয়ে পিছিয়ে পড়ার পর শেষ তিন দফায় আওয়ামী লীগ অধিকাংশ আসনে জয়ী হয়। এনজিও ও মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী এটা ঘটেছিল ভীতি প্রদর্শন ও নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় হস্তেক্ষেপের মাধ্যমে।
ব্যারোনেস ওয়ার্সি বিষয়টি নিয়ে ১৩ মে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারের সাথে আলোচনা করেছিলেন। তিনি এসব খবরের পূর্ণ ও স্বচ্ছ তদন্ত করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মার্চে ওই সময়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগের প্রতিমন্ত্রী অ্যালেন ডানকান বাংলাদেশ সফর করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা, অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক করে আরো টেকসই রাজনৈতিক সমঝোতার প্রাথমিক প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন। একই সাথে জোর দিয়ে বলেন, গণতন্ত্রে সহিংসতার কোনো স্থান নেই।
এতে বলা হয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৩ সালের রিপোর্টে দেখা গেছে, বাংলাদেশের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দায়মুক্তি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। এনজিওগুলো জানিয়েছে, ২০১৪ সালের প্রথম ছয় মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে শতাধিক। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দৃশ্যত আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীগুলোর হাতে ক্রসফায়ারে বিপুলসংখ্যক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
এতে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জে প্রকাশ্যে সাতজনকে অপহরণ এবং পরে তাদের লাশ নদীতে পাওয়া যাওয়ার ঘটনায় দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়। এ হত্যার সাথে র‌্যাবের সম্পৃক্ততার অভিযোগের পর বাংলাদেশের সংসদ, হাইকোর্ট ও নাগরিক সমাজ বিষয়টি তদন্তের আহ্বান জানায়। সরকার প্রতিশ্রুতি দেয়, অপরাধীকে শাস্তি দেয়া হবে। এ মৃত্যুতে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তিন র‌্যাব সদস্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ দাখিল করা হয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার নতুন আইন প্রণয়ন কিংবা বিদ্যমান আইনগুলোতে সংশোধন আনায় নাগরিক সমাজের ব্যাপ্তির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ডিজিটাল মিডিয়ার আশ্রয় নিয়ে যারা সরকারের সমালোচনা করছেন, তাদের তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে আটক করা হচ্ছে। তা ছাড়া প্রস্তাবিত ‘ফরেন ডোনেশনস অ্যাক্ট’টি নাগরিক সমাজের কার্যক্রম সীমিত করে দিতে পারে।
আরো দু’টি ঘটনা নাগরিক সমাজের মধ্যে এ ধারণা জোরদার করেছে; বাংলাদেশ সরকার সমালোচনা ও ভিন্নমত প্রকাশের সম্ভাব্য চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে। সদ্য প্রণীত জাতীয় সম্প্রচার নীতি মিডিয়ার স্বাধীনতার ওপর রাশ টেনে ধরবে বলে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দু’টি টিভি চ্যানেল এবং একটি সংবাদপত্র পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নাগরিক সমাজের অনেক সংগঠন ক্রমবর্ধমান নজরদারি, হয়রানি ও ভীতিপ্রদর্শনের কথা বলেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি সরকারের নতুন সংবিধান সংশোধনের ফলে সংসদীয় কর্তৃপক্ষ বিচার বিভাগের সদস্যদের অভিশংসন করার মতা ফিরে পেয়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২ জুলাই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করেন। ক্যামেরন নির্বাচন নিয়ে তার উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেন। উভয়ে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এবং মিডিয়ার স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এমন উন্মুক্ত সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপে একমত হন। (সূত্রঃ দৈনিক নয়াদিগন্ত ১৮ অক্টোবর ২০১৪)
 নাগরিকের তথ্য জানার অধিকার একটি বহুল স্বীকৃত বিষয়। আদালত অনেক দিন থেকেই তথ্য প্রাপ্তির অধিকারকে নাগরিকের বাক্স্বাধীনতার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আসছেন। কারণ, নাগরিকের মতামত সৃষ্টি ও মত প্রকাশের সহায়তার জন্য তথ্য আবশ্যক। স্টেট অব ইউপি বনাম রাজ নারায়ণ (১৯৭৫)৪এসএসসি ৪২৮ মামলায় ভারতীয় আদালত আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ঘোষণা করেন যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের ‘এজেন্ট’ হিসেবে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের দায়বদ্ধ হতে হয়, ফলে তাঁদের কোনো কিছু, সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া, জনগণের কাছ থেকে গোপন রাখার অবকাশ নেই।
গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে ২০০৮ সালে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নাগরিকদের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তথ্য অধিকার অধ্যাদেশ, ২০০৮ জারি করা হয়। অধ্যাদেশটি বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীজনদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রণীত হয়। নির্বাচনের পর নবম জাতীয় সংসদ অধ্যাদেশটি অনুমোদন করে। ব্যাপক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রণীত হওয়ায় এটি একটি শক্তিশালী আইন হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিও পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কানাডাভিত্তিক সংগঠন ‘সেন্টার ফর ল অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’র মূল্যায়ন অনুযায়ী, আমাদের আইনটি বিশ্বের ২০টি শক্তিশালী আইনের মধ্যে একটি।
তথ্য অধিকার আইনের প্রস্তাবনায় আইনটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে চিন্তা, বিবেক ও বাক্-স্বাধীনতা নাগরিকদের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত এবং তথ্য প্রাপ্তির অধিকার চিন্তা, বিবেক ও বাক্-স্বাধীনতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ; এবং যেহেতু জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক ও জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক; এবং যেহেতু জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা হইলে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশী অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাইবে, দুর্নীতি হ্রাস পাইবে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হইবে; এবং যেহেতু সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশী অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়;’ তাই ‘তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার বিধান করিবার লক্ষ্যে’ তথ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করা হলো।
দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে আমাদের সমাজে তথ্য গোপনের একটি অশুভ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। এ সংস্কৃতি থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে এবং তথ্য অধিকার আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে আইনে একটি তথ্য কমিশন গঠনের বিধান রাখা হয়। আইনের ১৩ ধারা অনুযায়ী তথ্য কমিশনের উদ্দেশ্য হলো, মূলত তথ্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের অভিযোগ নিষ্পন্ন করা। এ ছাড়া আইনে তথ্য কমিশনকে স্ব-প্রণোদিত হয়ে অথবা কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে উত্থাপিত বিষয় সম্পর্কে অনুসন্ধান করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ২০০৯ সালে আইনটি সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হলেও নাগরিকরা এর সুফল পাওয়া থেকে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত। বিরাজমান তথ্য গোপন করে রাখার সংস্কৃতিতেও কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসেনি। এ পরিস্থিতির পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তবে একটি বড় কারণ দলীয় অনুগত ব্যক্তিদের নিয়ে সরকারের আজ্ঞাবহ একটি তথ্য কমিশন গঠন, যে কমিশনের সদস্যরা নাগরিকের তথ্য পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের খুশি করার, অন্তত নাখোশ না করার ব্যাপারেই যেন বেশি আগ্রহী।
প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিয়োগ, ইচ্ছেমতো পদোন্নতি, দলবাজি ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলায় ডুবতে বসেছে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বা বাসস। বিশেষ বরাদ্দ ছাড়া এখন আর চলতে পারছে না সংস্থাটি। সরকারের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ পাওয়ার পরও প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকার দেনা মাথায় ঝুলছে। আর এ হিসাব ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত।
সাংবাদিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা চালু রাখতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই ভবিষ্য তহবিল (প্রভিডেন্ট ফান্ড) থেকে টাকা তোলা হয়েছে। আবার এই তহবিলে নিয়মিত টাকা জমা রাখাও সম্ভব হচ্ছে না। রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়াও বয়স বিবেচনায় উঁচু পদে এবং উচ্চ বেতনে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। যোগ্যতার চেয়ে এক বা একাধিক গ্রেড নিয়েছেন প্রায় ১০০ জন সাংবাদিক ও কর্মকর্তা।
জনবল সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করতে না পারলেও কয়েক বছর ধরে আরও কর্মী নিয়োগের চেষ্টা করছে বাসস কর্তৃপক্ষ। তথ্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নতুন আরও ১০৫টি জনবল অনুমোদন দিয়েছে ২০১৪ সালে। এই জনবল অপরিহার্য উল্লেখ করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন, বিষয়টি অর্থ মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। অতীতের সব অনিয়মকে দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরে নিয়ে বাসসে সরকার-সমর্থক সাংবাদিকদের ইউনিট গ্রেড-১ ও বিশেষ গ্রেড দেয়ার জন্য ৪০ জনের তালিকা তৈরি করে তা বাস্তবায়নের জন্য চাপ দিচ্ছে। আর সরকারবিরোধী ইউনিট সবার পদোন্নতি দেয়ার দাবি তুলে বলেছে, কিছু কর্মীকে বঞ্চিত করা চলবে না।
নব্বই-পরবর্তী সময়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদগুলোতে রাজনৈতিক বিবেচনায় বাড়তি ও অযোগ্য জনবল নিয়োগ, নিয়ম লঙ্ঘন করে দফায় দফায় পদোন্নতি এবং স্বজনপ্রীতিসহ নানা অব্যবস্থাপনার জের ধরে বাসসের আর্থিক সক্ষমতা ও গুণগত মান এমনিতেই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তার ওপর প্রশাসনিক এ সংকটে বাসস ক্রান্তিকালে পড়েছে।
নির্দিষ্ট বয়স অতিক্রম করা প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ জন সাংবাদিক-কর্মচারী বিভিন্ন সময়ে বাসসে নিয়োগ পেয়েছেন। ২০১১ সাল পর্যন্ত এখানে চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে বেশি বয়সের ৪৮ জন সাংবাদিক ও ১৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১২ সালে পরিচালনা বোর্ডের ১৩০তম সভায় তাঁদের নিয়োগকালীন বয়স মানবিক দৃষ্টিতে মার্জনা করে নির্দিষ্ট বয়সের বেশি কাউকে ভবিষ্যতে নিয়োগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
নিজের তৈরি সেই সিদ্ধান্তও মানেনি বাসস। ২৩ জুলাই ২০১৪ ৫৮ বছর বয়স্ক একজন সাংবাদিককে ১ নম্বর গ্রেডে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং তিনি তথ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। আবার বয়স বেশি হওয়ার কারণ দেখিয়ে একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। (চলবে)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ