শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

প্রতারণার ডিজিটাল ফাঁদে নিঃস্ব হচ্ছে বহু মানুষ

নাছির উদ্দিন শোয়েব: সময়ের সাথে বাড়ছে প্রতারণার ধরন, বাড়ছে প্রতারকের সংখ্যা। দেশব্যাপী সাধারণ মানুষ ডিজিটাল প্রতারণার ভয়ঙ্কর ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। ইন্টারনেট, ইউটিব, সোস্যাল মিডিয়া ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়ার এই চক্র বেড়েই চলছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একজন ব্যক্তির আপত্তিকর ছবি পোস্ট করে তাকে ব্ল্যাকমেইল করা, অশ্লীল লিংক ছড়িয়ে ব্যবহারকারীকে বিব্রত করা, কারও ফেসবুক বা ই-মেইল আইডি হ্যাক করে অর্থ দাবি করা, মোবাইলে লটারি জেতার কথা বলে বিকাশের মাধ্যমে অর্থ আদায়সহ প্রতারক চক্র বিভিন্নভাবে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। সাধারণ মানুষ অনেক সময় বুঝে উঠতে পারেন না ওদের প্রতারনার কৌশল। 

এছাড়া ওয়েবসাইট, নিউজ পোর্টাল তৈরি, আউট সোর্সিং, ইউটিবে একাউন্ট করে আয়ের প্রলোভন ও ফেসবুক লাইক বিক্রির নামেও টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বৈধভাবে আয়ের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চটকধারী বিজ্ঞাপন দিয়ে বেকার-তরুণ যুবকদের কাছ থেকে কৌশলে টাকা আদায় করা হচ্ছে। অথচ বৈধভাবেই আউট সোসির্ংসহ ইন্টারনেটে যেসব আয়ের পথ রয়েছে প্রতারকরা সে উপায় না দেখিয়ে ভ্রান্তপথে নগদ টাকা হাতিয়ে নিয়ে কেটে পড়ছে। এভাবে প্রতিদিন অসংখ্য ব্যক্তি প্রতারিত হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনেকে লজ্জিত হয়ে বিষয়টি চাপা দেয়ায় প্রতিকারও পাচ্ছেন না। 

এ ব্যাপারে গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র জানায়, ইন্টারনেটের বৈধ ব্যবহারকে যারা প্রতারণার ফাঁদ হিসাবে ব্যবহার করবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। যথাযথ অভিযোগ পাওয়া গেলে এদের বিরুদ্ধে আইসিটি এ্যাক্টে মামলা করার সুযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ওয়েব পোর্টাল নির্মাণের নামে টাকা হাতিয়ে নেয়া , আউটি সোর্সিং ও ফেসবুক লাইক বিক্রি চরক্রর বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ আসছে। এধরনের কয়েকটি চক্রের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নিয়েছে এবং আরো কয়েকজনকে খুঁজছে গোয়েন্দারা। 

জানা গেছে, দ্রুত সময়ে এবং কম টাকায় নিউজ পোর্টাল,বা ব্লগ তৈরি করে দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে, ফেসবুকে, মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠিয়ে প্রলোভন দেখানো হয়। এরপর গ্রাহকদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অংকের টাকা নিয় পোর্টালের আংশিক কাজ করে ঝুলিয়ে রেখে আরো কয়েকগুণ টাকা দাবি করা হয়। বাড়তি টাকা না দিলে বা চাহিদামত টাকা না পেয়ে কাজ ঝুলিয়ে রেখে হয়রানি করা হয়। এছাড়াও ‘সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশনের’ (এসইও) নামে আরো টাকা দাবি করা হয়। ওয়েব সাইটের আ্যলেক্স্রা রেংকিয়ের নামে ‘এসইও’ করার কথা বলে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অনেক অভিযোগ আছে। টাকা বেশি দিলে সাইটের র‌্যাংক কমবে এমন প্রতিশ্রতির পর গ্রাহকের কাছ থেকে কয়েকগুন বেশি টাকা আদায় করারও অভিযোগ আছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক স্বনামধন্য নিউজ পোর্টালের কর্ণধার জানান, বর্তমানে ওয়েব ডেভেলপারের নামে দেশে ‘চিটার’ এর সংখ্যা বাড়ছে। এদর অধিকাংশই ডেভেলপারের কাজে অনভিজ্ঞ। সামান্য বিদ্যার্জন করেই প্রতারণা করে অল্প সময়ে বেশি আয়ের লোভে পড়ে। এরা শুধু সাধারণ মানুষকেই নয়-সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকেও হয়রানি করছে বলে জানা গেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটাল হিসাবে গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়ে বিভিন্ন খাত থেকে টাকা লুটেরও ভুল পথ খুঁজে দিচ্ছে এরা। আর এসব ফাঁদে পা দিয়ে প্রশাসনের কয়েকটি বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা সমস্যায় রয়েছেন। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল, ফকিরাপুল, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পান্থপথ, কলাবাগান, ধানমন্ডি, কাওরানবাজার, আরকে মিশন রোড, মালিবাগ, উত্তরা এলাকায় গড়ে ওঠছে কয়েককশত ডিজিটাল প্রতারক চক্র। এদের নেই নির্দিষ্ট ঠিকানা, অফিস থাকলেও কয়েকদিন পরপরই পরিবর্তন করে থাকে। শুধু ল্যাপটপ ও সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমেই চলে এদের কাজ। 

আউট সোসিং: এমন একটি শব্দ যেটি শুনলেই মনের গহীনে এক অজানা ভয় কাজ করে। টিভি চ্যানেলের সামনে বসলে কিংবা পত্রিকার পাতা খুললেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। ঘরে বসেই বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে টাকা ও ডলার উপার্জনের প্রতারণাপূর্ণ আহ্বানে সাড়া দিয়ে এরই মধ্যে নিঃস্ব হয়েছেন দেশের লাখ লাখ যুবক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে রাজধানীর বিভিন্ন অলিগলি ড়িয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও পৌঁছে গেছে এসব প্রতারকের কালো থাবা। অল্প সময়ে কম বিনিয়োগ ও শ্রমের বিনিময়ে ঘরে বসে মোটা টাকার মালিক হওয়ার লোভে দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেকার যুবক ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অর্থ ও মেধা নিয়ে। তবে তাদের শর্টকাটে বড়লোক বনে যাওয়ার অঙ্কুরিত স্বপ্ন আর পল্ল¬বিত হতে পারেনি। লাখ লাখ বেকার যুবকের কোটি কোটি টাকা নিয়ে প্রতারকরা এরই মধ্যে সটকে পড়ছে। এরই মধ্যে অনেক প্রতারক তাদের বাড়িঘর ফেলে গ্রাহকদের মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে আত্মগোপন করেছেন। এসব অনলাইন প্রতারণার বিষয়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অনেক আগে অবহিত করার পরও তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি- এমন অভিযোগ সংশি¬ষ্টদের। 

ঘরে বসেই অনলাইনের মাধ্যমে টাকা ও ডলার উপার্জনের কথা বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় দেখা যায়। কিন্তু এখানেও প্রতারক চক্র সক্রিয়। এই ধরনের আশ্বাসের মাধ্যমে অল্প সময়ে কম বিনিয়োগ ও শ্রমের বিনিময়ে ঘরে বসে মোটা টাকার মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে সাধারণের টাকা। যদিও অনলাইনে আউটসোর্সিং করতে প্রয়োজন শ্রম ও মেধা। এ জন্য কোনো অর্থ বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া মোবাইলে ক্ষুদে বার্তায় বা ফোন দিয়েও একজন গ্রাহককে ‘আপনি লটারি জিতেছেন’ এমনটি জানিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। এ জন্য ভুক্তভোগীদের বিশাল অঙ্কের টাকার লোভ দেখিয়ে প্রতারকরা সেই টাকা পেতে তার কাছ থেকে নিবন্ধন ফি হিসেবে বিভিন্ন পরিমাণ অর্থ একটি নম্বরে বিকাশ করে দেওয়ার কথা বলেন। 

প্রযুক্তিবিদরা বলেন, সামাজিক মিডিয়ার অপরাধ প্রতিরোধে আমাদের কোনো ফরেনসিক ল্যাব গড়ে ওঠেনি। এ জন্য ফেসবুকে সংগঠিত বিভিন্ন অপরাধ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের পক্ষে শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এমনকি প্রযুক্তি সংক্রান্ত অপরাধের জন্য দেশে যে আইন রয়েছে সেটিও বিশেষায়িত নয়। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হতে হবে। ডিজিটাল প্রতারণার মধ্যে ফেসবুকে ফটোশপের মাধ্যমে একজনের ছবির সঙ্গে আরেকজনের ছবি জুড়ে দিয়ে অসাধু কিছু ব্যবহারকারী দীর্ঘদিন ধরে সাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এক্ষেত্রে নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। সাধারণত কোনো পর্নো ছবির নায়িকার দেহের সঙ্গে একটি নারীর চেহারা জুড়ে দিয়ে এমন ছবি তৈরি করা হয়। পরে এই ছবি আপলোড করার হুমকি দিয়ে তাকে ব¬্যাকমেইল করে অর্থ আদায় করা হয়। কিছুক্ষেত্রে প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হলে প্রতিশোধ নিতে এবং বিকৃত আনন্দ পেতে বখাটেরা এ ধরনের কুরুচিপূর্ণ কাজ করে। এরআগে ডিএমপির ডিবি (পশ্চিম) বিভাগের একটি টিম এমন একটি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে। 

ওয়েব সাইট, নাকি প্রতারণা: এদিকে যে দেশে ১৫ দিনে ইংরেজি শিখুন, ৩০ দিনে ডাক্তারী শিখুন, এমন কি ৩০ দিনের কোর্স করে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায় সে দেশে নামমাত্র টাকায় ওয়েব সাইট বানানো অসম্ভবের কি? যদি ৪০০/- টাকায় কম্পিউটার শেখা যায় তবে বছরের পর বছর কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকবেন কেন? ট্রেন, বাস, পাবলিক টয়লেটসহ বিশেষ করে ঢাকায় ৩০০০/- টাকায় ওয়েব সাইট বানিয়ে দেয়ার ব্যানার পোস্টার দেখা যায়। এতে করে আমাদের প্রফেশনালদের মার্কেট যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমন করে গ্রাহকরা পরছেন বিপাকে। আমনুল নামে একজন বলেন, প্রতি বছর ওয়েব সাইট এর ডোমেইন হোস্টিং নবায়ন বাবদ টাকা পে করতে হবে । এই সমস্ত নব্যপ্রতারক ব্যবসায়ীরা আপনার ওয়েব সাইটের জনপ্রিয়তা দেখে আপনাকে বিভিন্ন বাহানায় টাকা পে করতে বলবে। যেহেতু আপনার সাইটের সমস্ত চাবিকাঠি ডেভেলপারের কাছে থাকবে। এই সমস্ত প্রতারকদের কাছে নবায়ন করার জন্য টাকা পে করে এদের মোবাইল নাম্বার বন্ধ পাওয়ার ঘটনা একটা দুইটা না। কেননা এদের কোন অফিস নেই, নেই অনলাইনে ভালো কোন প্লাটফর্ম।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ