এক খাদেমের উদারতা

ইকবাল কবীর মোহন : এক অনন্য সাহাবী আবদুল্লাহ বিন জাফর তৈয়ার (রাঃ)। উদারতার জন্য তাঁর বেশ সুনাম ছিল। একদা তিনি এক খেজুর বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। বাগানের এক খাদেমের দিকে জাফর (রাঃ)-এর চোখ পড়ল। তাই কি মনে করে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। খাদেমের কাজ লক্ষ্য করছেন তিনি। খাদেম বাগানের খেজুর এক জায়গায় জমা করছিল। মাঝে মাঝে সে অন্যান্য কাজও করছিল। এই ছেলেটির কাজ জাফর (রাঃ)-এর খুব পছন্দ হলো। তাই সাহাবী ছেলেটির কাজকর্ম দেখতে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করলেন। ইতোমধ্যে বাগানের মালিকের এক ছেলে এসে বাগানে ঢুকলো। সে খাদেমের জন্য খাবার নিয়ে এলো এবং তাকে সেটি খেতে দিল। আর বাগানের মালিকের ছেলে একটু দূরে গিয়ে তার খাবার খেতে বসে পড়লো।
খাদেম ছেলেটিও খেতে বসেছে। তাঁর হাতে ছিল দু’টি রুটি। এমন সময় খাদেম দেখলো একটি কুকুর তার দিকে এগিয়ে আসছে এবং সে লেজ নাড়াচ্ছে। এটা দেখে ছেলেটি একটি রুটি সেই প্রাণীটির সামনে দিলো।
কুকুর রুটিটি খুব দ্রুত খেয়ে ফেললো এবং হা করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছিল। খাদেমের এতে খুব মায়া হলো। কুকুরটি খুব ক্ষুধার্ত এটা বুঝতে খাদেমের বাকি রইলো না। তাই সে দ্বিতীয় রুটিটিও কুকুরের সামনে ফেলে দিল। কুকুর মজা করে রুটি খেয়ে তার ক্ষুধা মেটালো।
কিন্তু খাদেম! সে আর কিছুই খেল না। তার যা খাবার ছিল তা সে কুকুরকে দিয়ে দিয়েছে। এখন সে উপোসই রয়ে গেল। তবে তার মনে ছিল ভীষণ আনন্দ। একটি ক্ষুধার্ত কুকুরকে খেতে দিতে পেরে তার মন জুড়িয়ে গেল। এবার সে না খেয়েই আবার নিজের কাজে লেগে গেল।
হযরত জাফর ছেলেটির সবকিছু এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে অবলোকন করছিলেন। তিনি ছেলেটির আচরণ দেখে বিস্মিত হলেন। হযরত জাফর (রাঃ)-এর বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটে না। এমন উদার হতে পারে মানুষ! কিছুক্ষণ পর জাফর (রাঃ) ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, ‘হে খাদেম! তোমার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কি থাকে শুনি?’
ছেলেটি জবাবে বলল, ‘কিছুক্ষণ আগে আপনি যা দেখলেন, তা-ই আমি খাই।’
‘আচ্ছা বুঝলাম। তুমি তো দু’টি রুটি নিয়ে খেতে বসেছিলে। তুমি এগুলো না খেয়ে কুকুরকে কেন দিয়ে দিলে?’
জবাবে ছেলেটি বললো, ‘জনাব! আমাদের এই এলাকায় কুকুর নেই। আমার মনে হয়, এই কুকুরটি ক্ষুধার তাড়নায় অন্য কোনো এলাকা থেকে ছুটে এসেছে। কুকুরটিকে খুবই ক্ষুধার্ত বলে মনে হলো। আমার মনে হলো আমার চেয়েও তার ক্ষুধা অনেক বেশি। তাই আমি না খেয়ে রুটি দু’টি তাকে দিয়ে দিলাম।’
আবদুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ রাতে তুমি কি খাবে?’
খাদেম বললো, ‘আজ রাতে খাবার মত আমার আর কিছুই নেই। তাই রাতে আমি ক্ষুধার্ত থাকব।’
খাদেম ছেলেটির কথা শুনে আবদুল্লাহ জাফর (রাঃ) মনে মনে বললেন, ‘লোকেরা আমাকে অনেক উদার জানে। আসলে এই ছেলেটি আমার চেয়ে আরও বেশি উদার।’ হযরত জাফর (রাঃ) ছেলেটির ব্যবহার ও উদারতায় মুগ্ধ হলেন। তিনি ভাবলেন, এই ছেলেটিকে মুক্ত করা দরকার। তার মালিক রাজি হলে ওকে কিনে নিতে তিনি মনস্থ করলেন। তাই তিনি খাদেমের মালিকের কাছে ছুটে গেলেন। জাফর (রাঃ) বললেন, ‘ভাই, আমি আপনার খাদেমকে কিনে নিতে চাই। আপনি তাকে বিক্রি করে দিন।’
বাগানের মালিক বললো, ‘আচ্ছা ভাই, জানতে পারি কি, আপনি এই ছেলেকে কেন কিনতে চান?’
আবদুল্লাহ জাফর (রাঃ) এবার মুখ খুললেন। তিনি তাঁর দেখা সব ঘটনা খাদেমের মালিকের কাছে খুলে বললেন। তিনি বললেন, ‘আমার মন চায় আমি তাকে কিনে মুক্ত করে দিই। আমি আরও চাই, এই বাগানটি আমি কিনে নেব। আর এটিও আমি তাকে উপহার হিসেবে দিয়ে দেব। আমার বিশ্বাস, এতে ছেলেটি আরামে জীবনযাপন করতে পারবে।’
খাদেমের মালিক এবার বললেন, ‘ভাই, এই ছেলেটির একটিমাত্র গুণ দেখে আপনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন এবং তার ওপর দয়াবান হলেন। অথচ আমি তো প্রতিদিন তার অনেক গুণ দেখি। আমি আপনাকে সাক্ষী রেখেই বলছি, আমি আল্লাহ্ সন্তুষ্টির জন্য এই ছেলেকে মুক্ত করে দিলাম। আর এই বাগানও আমার পক্ষ থেকে তাকে উপহার হিসেবে দিয়ে দিলাম।’
উদারতার মহৎ গুণ ও এর পুরস্কার যে কতটা মহান, তা আমরা এই ঘটনা থেকে শিখতে পারি।