শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

মার্কিন-চীন ‘বাকযুদ্ধ’ শেষাবধি ‘মারাত্মক যুদ্ধে’ রূপ নিলে কে জিতবে?

সোলায়মান আহসান : দক্ষিণ-চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে মার্কিনীদের সঙ্গে চীনের ‘বাকযুদ্ধ’ চরম এক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ বাকযুদ্ধ যেকোন সময় মারাত্মক সংঘর্ষে রূপ নিতে পারে এমন হুমকি-ধামকিও চলছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত রেক্স টিলারসন সিনেটের এক বৈঠকে মন্ত্রব করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে দক্ষিণ-চীন সাগরের বেইজিংয়ের নির্মিত কৃত্রিম দ্বীপসমূহে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়া।’
এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত দুটি চীনা পত্রিকায় তীব্র নিন্দা ও হুমকি ছুঁড়ে দেয়। পত্রিকা ‘গ্লোবাল টাইমস’ সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হলে ‘বিশাল আকারের যুদ্ধ’ শুরু হবে। পত্রিকা ‘চায়না ডেইলি’ বলেছে, টিলারসনের বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি চীন-মার্কিন সম্পর্কের ব্যাপারে অজ্ঞ এবং সার্বিকভাবে ক’টনীতিই বোঝেন না। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি যদি তার ঐ বক্তব্যের বাস্তবায়ন করতে চান তখন ‘মারাত্মক সংঘাত’ বাঁধবে বলে দৈনিকটি সতর্ক করে দেয়। ্
উল্লেখ্য, চীনের পররাষ্ট্র বিষয়ক নীতির অনেকটা প্রতিফলিত হয় এসব রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পত্রিকায়।
চীনের সঙ্গে মার্কিনীদের ঠাণ্ডা লড়াই বা বাকযুদ্ধ শুধু দক্ষিণ-চীন সাগর নিয়ে নয়, আরো আরো অনেক বিষয়ে পুঞ্জিভ’ত হয়েছে। মোটের ওপর ধারণা করা হচ্ছে, চীনের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক অগ্রগতি, সামরিক শক্তিতে পরাশক্তি হয়ে উঠার স্বল্পকালের ইতিহাসটা সত্যিই জাদুকরী ভেলকির মতই, মার্কিনীরা তা সহ্য করতে পারছে না। তাই, বহুদিন ধরেই তক্কে তক্কে আছে চীনকে সাইজ করা যায় কিভাবে। সে কারণেই মার্কিনীরা দক্ষিণ-চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ও চীনের আধিপত্যকে উপলক্ষ করে অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমনিতেই নির্বাচনের আগে ও পরে বিতর্কের কেন্দ্র হয়ে উঠেছেন। খোদ আমেরিকার দায়িত্বশীল মহল থেকেও বিশ্বের সকল মহল হতেই আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে ‘বেপরোয়া’ মেজাজের ওই ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হিসেবে বসে কী করেন না করেন। সেই ট্রাম্প গদিতে বসার আগেই তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েনের সঙ্গে ফোনালাপে চীনদের বিরাগভাজন হলেন। শুধু তাই নয়, নির্বাচনের পর পর তিনি ‘এক চীন নীতি’ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার ইঙ্গিত দিলেন। চীনাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ‘অনৈতিক’ আখ্যা দিয়ে তার লাগাম টেনে ধরার কথাও বলেন তিনি নির্বাচনের আগে। এসব কিছুই রাজনীতিতে একজন অনভিজ্ঞ ব্যক্তির যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশের প্রেসিডেন্ট পদ অলঙ্কৃত করার ইঙ্গিত।
উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালে তাইওয়ানের সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিন্ন করার মাধ্যমে ‘এক চীন নীতি’র সমর্থন দানের পর এই প্রথম কোন মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনালাপ করলেন তাও প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার আগেই। স্বাভাবিকভাবেই এতে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে অতিউৎসাহ প্রকাশ পেয়েছে। চীন এ ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি সফররত তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন টেক্সাসের হাইস্টানে যাত্রাবিরতি নিয়ে বিপালিকান নেতাদের সঙ্গ বৈঠক করায়ও চীন নিন্দা জানায়।
উল্লেখ্য, এক চীন নীতির আলোকে তাইওয়ানকে নিজের অংশ বলে মনে করে চীন। যুক্তরাষ্ট্রও তাইওয়ানকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা দেয় না। তবে তাইওয়ানকে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে চীনকে চাপের মধ্যে রাখার নানা কায়দা-কানুন করে থাকে। সামরিক সহায়তা দিতে গিয়ে তাইওয়ানকে এফ-১৬ (অত্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান) দেওয়া ছাড়াও অর্থনীতিতে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তাইওয়ান নয়, দক্ষিণ-চীন সাগরের সন্নিহিত দেশসমূহ (আসিয়ানভুক্ত) নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র বহুদিন ধরে খেলছে। কিন্তু এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র বুঝি বা এ অঞ্চল হতেও পাততাড়ি গুটাতে বাধ্য হবে। সে বিষয় পরে বলছি। কিন্তু শংকা দেখা দিয়েছে, তাদের খেলা সাঙ্গ হবে কি একটি মারাত্মক যুদ্ধের মাধ্যমে?
ট্রাম্প চীনকে বাগে আনতে ব্যবহার করতে চান সেই পুরনো অস্ত্র তাইওয়ান, দক্ষিণ-চীন সাগর দ্বন্দ্ব ইত্যাদি ব্যবহার করে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু সেটা কি এখন সম্ভব? সেটা তিনি খেলোমেলাই বলেছেন, ‘বাণিজ্যসহ অন্যান্য বিষয়ে আমাদের সাথে তারা যদি কোনো চুক্তি না করে তাহলে আমি বুঝি না কেন এক চীন নীতিতে আমাদের সমর্থন অব্যাহত রাখতে হবে।’
কিন্তু ট্রাম্প বর্তমানকালের চীনকে মূল্যায়ন করতে বুঝি ভুল করছেন। আজকের চীন শুধু অর্থনীতিতে এক নম্বর পরিজশন হিসেবে দখলের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, এক নম্বর সামরিক শক্তিধর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক প্রাধান্যকে রুখে দেয়ারও অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। কিভাবে? পরে বলছি।
ট্রাম্প প্রশাসন ‘এক চীন নীতি’ হতে সরে আসার প্রক্রিয়া শুরু করলে চীনের সঙ্গে মার্কিনীদের সবচেয়ে স্পর্শকাতর সম্পর্কে হাত পড়বে যা দুটি দেশের মাঝে চরম তিক্ততা ছড়িয়ে দেভে। মূলত তিন কারণে এক চীন নীতি সমর্থন করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রশত, বেইজিংয়ের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা, দ্বিতীয়, তাইওয়ানকে রক্ষা ও সহযোগিতা করে গণতন্ত্রের পথ রক্ষা এবং তৃতীয়ত, চীনের সাথে যুদ্ধ পরিস্থিতি এড়িয়ে চলা।
১৯৭২ সালের সমঝোতার সাথে সঙ্গতি রেখে ৪৪ বছরে এক চীন নীতি ভেঙে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গ ফোনালাপ করে ট্রাম্প ভীমরুলের চাকে খোঁচা দিলেন?
চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পত্রিকা ‘গ্লোবাল টাইমস’ হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, এক চীন নীতি বজায় রাখাটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের প্রতি চীনের খামখেয়ালিপূর্ণ অনুরোধ নয়, এটি এশিয়া-প্যাসিফিকের বিদ্যমান আদেশকে সম্মান জানানো এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বজায় রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা।’ আর এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে, চীন কখনও মার্কিনীদের কোন চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না বরং চীন ‘মারাত্মক সংঘর্ষকে আমন্ত্রণ জানাবে।  স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছর ১২ জুলাই নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরের আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক ফিলিপাইনের পক্ষে স্প্রাটলি আইল্যান্ডের অধিকারের রায় ঘোষিত হলে দক্ষিণ-চীন সাগরে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়। যুক্তরাষ্ট্র ওই আদালতের রায়কে মেনে নিতে আহ্বান জানায়, নইলে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার হুমকি দেয়। চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কি কিয়াং জানান, হেগের আদালতী রায় তারা মানবেন না। আর চীনা উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিউ ঝিনসিন যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ট্রাইব্যুনালের রায়ের ওপর ভরসায় কোনো দেশ দক্ষিণ-চীন সাগরে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়, চীন তা বরদাশত করবে না, পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। বাস্তবে করেছেও তাই।
সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিমান দক্ষিণ-চীন সাগরের ওই বিতর্কিত অঞ্চলের রণতরী ‘লিয়াওনিং’ হতে মেরিন দুটি যুদ্ধ বিমান (জে-১০) উড়ে এসে ধাওয়া করে তাড়িয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, ঐ অঞ্চলে সে সময় চীনা মেরিন সেনার যৌথ সুসজ্জিত বাহিনী প্রকৃত যুদ্ধের লাগাতার মহড়া চালায়।
(চলবে)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ