বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

এমপিদের নিরাপত্তায় নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেব - প্রধানমন্ত্রী

সংসদ রিপোর্টার : গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটনের মৃত্যুতে শোক আলোচনায় গণমাধ্যমকে দুষেছেন সংসদ সদস্যরা। তারা বলেছেন, একজন কিশোর গুলীবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার সঙ্গে লিটনকে পরিকল্পিতভাবে জড়ানো হয়েছে। এতে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে বিভিন্ন গণমাধ্যম। তাদের প্রচারণার কাছে আমরা হেরে গেছি। প্রকৃত তথ্য জানলেও লিটনের জন্য কিছুই করা সম্ভব হয়নি। উল্টো তার কাছ থেকে লাইসেন্স করা অস্ত্র নিয়ে নেয়া হয়েছিলো। এমপি লিটনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এমপিদের নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত হয় সে ব্যবস্থা করব। লিটনের হত্যার সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই ধরব এবং শাস্তি নিশ্চিত করব। এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে এটাই আমরা চাই।’
শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় আরও অংশ নেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া, চিফ হুইপ আসম ফিরোজ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, জুনাইদ আহমেদ পলক, হুইপ মাহাবুব আরা গিনি, এ কে এম শামীম ওসমান, মীর শওকত আলী বাদশা ও জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ। বক্তাদের বেশিরই হত্যাকাণ্ডের শিকার মনজুর”ল ইসলাম লিটনকে নিয়ে গণমাধ্যমের কিছু গণমাধ্যমের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন। আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে শোক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।
গতকাল রোববার জাতীয় সংসদে মনজুরুল ইসলাম লিটনের মৃত্যুতে আনা শোকপ্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠকে শোকপ্রস্তাবটি পাস হয়। এরপর মরহুমের সম্মানে সংসদের বৈঠক কিছুক্ষণের জন্য মুলতবি রাখা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেখানে বিএনপি-জামায়াত কত মানুষকে যে হত্যা করেছে তার কোনো হিসাব নেই। এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সে রুখে দাঁড়িয়েছিল। এটাই বুঝি তার কাল হয়ে গেল। সেখানকার মানুষের জীবনে লিটন শান্তি ফিরিয়ে এনেছিল। এলাকার মানুষের জীবনে স্বস্তি এনেছিল। এটিই তার কাল হয়েছে।’
এমপি লিটন শিশু সৌরভকে গুলী করেনি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি কেন একজন শিশুকে গুলী করতে যাবেন? লিটনের বাবা তো আওয়ামী লীগ করত। কিন্তু এ কারণে তার গুলী সিজ করে নেয়া হয়।’ শেখ হাসিনা বলেন,‘আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি। এর প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। এজন্য লিটনকে হত্যা করা হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার নিজেরই খুব কষ্ট লাগছে। লিটন এমন একটি এলাকা থেকে নির্বাচিত যে এলাকা সন্ত্রাসীদের আখড়া, জামায়াত-শিবিরের আখড়া। ২০১৩ সালে ওই এলাকায় ব্যাপক সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট পুড়িয়ে তা-ব চালায়। উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান একজন মহিলা, তার বাড়িতে হামলা চালায়। এরপরই দুজন পুলিশ হত্যা করা হয়। এরপর ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত মিলে শত শত স্কুল পুড়িয়ে দেয়। জামায়াত সেখানে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের বির”দ্ধে যেভাবে কঠোর অবস্থা নিয়েছি, তেমনিভাবে অবশ্যই লিটন হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশ যখন সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, গোটা বিশ্বের দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমরা যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি- তখনই যেন প্রতিশোধ নিতেই এসব কর্মকান্ড ঘটানো হচ্ছে। এটাই হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের নমুনা। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে সেজন্য সব ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
এমপি লিটনের নির্বাচনী এলাকা জামায়াত অধ্যুষিত উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনের বানচালের নামে বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্য দিবালোকে অস্ত্র নিয়ে হাজার হাজার গাছ কেটে রাস্তায় অবরোধ করে সারাদেশের মতো ওই এলাকাতেও বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। যখন ওই এলাকার জনগণ বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বির”দ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুললো, তখন এমপি হিসেবে নয়, একজন এলাকার সাধারণ মানুষ হয়ে মনজুর”ল ইসলাম লিটন নেতৃত্ব দিয়েছে। এটাই যেন এমপি লিটনের জীবনে কাল হয়ে দেখা দিলো। তাদের অগ্নিসন্ত্রাস লিটন র”খে দিয়ে ওই এলাকায় মানুষের মধ্যে শান্তি ও স্বস্তি ফিরিয়ে দিয়েছিল। এটা যেন ছিল লিটনের বড় অপরাধ। এজন্যই তাঁকে টার্গেট করা হলো।
শিশু সৌরভ গুলীবিদ্ধ হওয়া নিয়ে ওই সময় কিছু গণমাধ্যমের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংসদ সদস্য লিটন কেন একটি শিশুকে গুলী করবে? শিশু সৌরভের পরিবারও তো আওয়ামী লীগ করতো। লিটনকে হত্যার জন্য ওই সময় এ্যামবুশ করে বসেছিল। এটা দেখে লিটন নিজের জীবন বাঁচাতেই ফাঁকা গুলী করে। এটা নিয়ে কিছু পত্র-পত্রিকাগুলো এমনভাবে লিখলো, কিন্তু কেউ সত্য ঘটনাটি লিখলো না।
তিনি বলেন, আমার কষ্ট হয় এজন্য তার অস্ত্রটাও সিজ করা হলো। সে বারবার বলছিল যেখানেই যাই সেখানেই নিজের নিরাপত্তা নিজেকেই দিতে হয়। নইলে আমাকে মেরে ফেলা হবে। কিন্তু তার, স্ত্রীসহ সবার অস্ত্র সিজ করা হলো। নির্বাচনের কথা বলে পুলিশের নিরাপত্তাও তুলে নেয়া হলো। এই সুযোগেই হত্যাকারীরা বাড়িতে ঢুকে নির্মমভাবে লিটনকে হত্যা করে।
সংসদ সদস্যদের প্রবল দাবির মুখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, গোয়েন্দাদের একটি চৌকষ দল ছাড়াও পুলিশ বাহিনী খুনীদের ধরতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অবশ্যই হত্যাকারী ও মুল পরিকল্পনাকারীদের ধরে তাদের মুখোশ জাতির সামনে উন্মোচন করা হবে। তিনি বলেন, এমপি লিটন যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বির”দ্ধে জনগণের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। গোলাম আযমকে তাঁর এলাকায় ঢুকতে দেয়নি। এসবও মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তবে তদন্তেই আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদ সদস্য মনজুর”ল ইসলাম লিটনের হত্যাকান্ডকে ‘পরিকল্পিত’ উল্লেখ করে বলেন, এটা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। পরিকল্পিতভাবেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। অবশ্যই এ হত্যাকাণ্ডের মুল রহস্য উদঘাটন এবং খুনীদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত এলাকায় লিটনকে রাজনীতি করতে হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাস-নাশকতার ও ৪ পুলিশ হত্যার বির”দ্ধে লিটন জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রূখে দাঁড়িয়েছিল। এটাই ছিল যেন তাঁর অপরাধ। তিনিও দ্র”ত খুনীদের গ্রেফতারের দাবি জানান।
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এমপি লিটন হত্যাকাণ্ডের জন্য বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে দায়ী করে বলেন, সন্ত্রাস-নাশকতা-সাম্প্রদায়িকতার বিরদ্ধে যুদ্ধ করে গেছেন এমপি লিটন। এই হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোট ও তাদের নেত্রী খালেদা জিয়া। এজন্য অবশ্যই তাকে জবাব দিতে হবে। অগণতান্ত্রিক অপশক্তির নেত্রীই হচ্ছেন খালেদা জিয়া।
ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, ‘লিটনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। তাকে গুলী করে পাখির মত হত্যা করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘লিটন কোনো শিশুকে গুলী করেনি। কিন্তু আমরা মিডিয়ার কাছে হেরে গিয়েছিলাম। কারণ লিটন সেই সময় আত্মরক্ষার জন্য গুলী করেছিলেন। মিডিয়ায় তা আসেনি। শিশু সৌরভের পায়ে লাগে। এরজন্যলিটন দায়ি না।’ ডেপুটি স্পিকার বলেন, ‘কী পরিকল্পনায় তাকে হত্যা করা হয়েছিল আমরা তার সঠিক তদন্ত চাই।’
চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ বলেন, ‘যাকে নিয়ে আলোচনা করছি তাকে কিন্তু এই সংসদে অনেকেই চেনেন না। কারণ তিনি নীরবে সংসদে আসতেন, নীরবে বাসায় চলে যেতেন।’ তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পরও কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাদের হত্যা করা হয়েছে। তার বাসায় পুলিশি পাহারা ছিল। কিন্তু নির্বাচনের কথা বলে পুলিশ তুলে নেয়া হলো। তার অস্ত্র ছিল। কিন্তু সেটাও সিজ করে নেয়া হয়েছে। তাই এটি একটি গভীর ষড়যন্ত্র।’ সংসদ সদস্যদের নিরাপত্তার জন্য সরকারকে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে আসমফিরোজ বলেন, ‘শিশু সৌরভের পায়ে গুলীর ঘটনায় এক শ্রেণীর মিডিয়া লিটনকে দোষারোপ করেছে। কিন্তু লিটন ছিলেন নির্দোষ।’
একই জেলার এমপি হুইপ মাহবুব আরা গিনি বলেন, ‘তাকে আমরা কোনো সাহায্য সহযোগিতা করতে পারিনি। একজন এমপি হওয়া সত্ত্বেও শিশুকে গুলী করার অপরাধে তাকে অন্তর্র্বতীনকালীন জামিন নিতে হয়েছে। মিডিয়াও তার প্রতি সুবিচার করেনি।’

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ