শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

গণপরিবহণ সংকটের সুযোগ নিয়ে রাজধানীতে ভাড়া নৈরাজ্য চলছেই

ইবরাহীম খলিল : গণপরিবহনের সংকটের সুযোগ নিয়ে রাজধানীতে চলছে ভাড়া নৈরাজ্য। কি বাস, কি সিএনজি সব বাহনেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়। ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে যেন নিয়ম নীতির কোন বালাই নেই। মালিকদের সিদ্ধান্তই যেন শেষ কথা। আর এসব বিষয় যাদের দেখভাল করার কথা তারা বলছেন দায়সারা কথা। 

যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, নগরীতে চলাচল করা বাসের সংখ্যা ৮ হাজার থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজারে, হিউম্যান হলার ২০ হাজার থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজারে, সিএনজি চালিত অটোরিকশা ১৩ হাজার থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজারে। সংগঠনটির হিসেব মতে রাজধানীতে যে পরিমাণ গণপরিবহনের দরকার, তার চেয়ে ৪০ শতাংশ কম রয়েছে। বেড়ে যাচ্ছে ব্যক্তিগত পরিবহন, কমছে গণপরিবহন। এজন্য রাস্তায় জ্যাম দেখা গেলেও যাত্রীরা গাড়ি পান না। গণপরিবহনগুলোতে থাকে উপচে পড়া ভীড়। বিশেষ করে অফিসে আসা যাওয়ার সময় ভোগান্তিটা ব্যাপক আকার ধারণ করে। 

প্রাত্যাহিক হলেও গতকাল সোমবার সকাল থেকে নগরীর ফার্মগেট, মহাখালী, মিরপুর, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টন ও কারওয়ানবাজার এলাকায় এ দুর্ভোগ বেশি দেখা গেছে।। গণপরিবহন সংকটে ভোগান্তির শিকার হাজার হাজার অফিসগামী, কর্মস্থলমুখী ও ছাত্র-ছাত্রীসহ রাজধানীতে চলাচলকারীরা।

 তেঁতুলিয়া পরিবহনের মালিক আব্দুল মতিন গণপরিবহন সংকটের কথা স্বীকার করে বলেন, কয়েক বছর আগেও একটি বাস বা মিনিবাস দিনে ১৫০ থেকে ১৭০ কিলোমিটার চালানো সম্ভব ছিল। সেখানে বর্তমানে যানজটের কারণে ৭০/৮০ কিলোমিটারের বেশি চালানো সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে নতুন উদ্যোক্তারা পরিবহন ব্যবসায় আসতে চান না। এর ফলে গণপরিবহনের সংকট দেখা দিয়েছে।

এদিকে গণপরিবহণ সংকটের সুযোগ নিয়ে নিজের ইচ্ছামত ভাড়া আদায় করছে মালিক পক্ষ। জাতীয় প্রেস ক্লাবের বাস কাউন্টারগুলো থেকে যাত্রীদের যে টিকিট দেওয়া হয়, তাতে লেখা আছে ১০ টাকা। এখানে যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ১৫ টাকা। তা হালাল করতে অবশ্য টিকিটের বুকে রাবার স্ট্যাম্পে সিল মেরে ১০ টাকা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৫ টাকাই নাকি তাদের সর্বনিম্ন ভাড়া। অথচ সরকার নির্ধারিত কম দূরত্বের ভাড়ার ক্ষেত্রে ছোট বাসের জন্য নেওয়ার কথা পাঁচ টাকা, আর বড় বাসে আদায় করা হবে সাত টাকা। তার মানে প্রেসক্লাবের কাউন্টার বাসগুলো দ্বি-গুণ ভাড়া নিচ্ছে স্বল্পদূরত্বের যাত্রীদের কাছ থেকে। কেন দ্বি-গুণ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ? এমন প্রশ্নে এটিসিএলের কাউন্টার ম্যানেজার বলেন, আমাকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। মালিক যেভাবে টিকিট দিয়েছে, সেভাবেই বিক্রি করছি।

 আর সিএনজি চালিত অটোরিকশাতো বেশি টাকা ছাড়া এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায় না। গবেষণা বলছে. ৮০ ভাগ ড্রাইভার মিটারে যায় না। বেশিরভাগ চালক অতিরিক্ত টাকা আদায় করে। 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, দুই বছর আগে সিএনজির দাম বাড়ায় ঢাকা ও আশপাশের চার জেলার অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী বাসের ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ১০ পয়সা বাড়ানো হয়। তাতে প্রতি কিলোমিটারে বড় বাসে ভাড়া নির্ধারিত হয় ১ টাকা ৭০ পয়সা, আর মিনিবাসে ১ টাকা ৬০ পয়সা। তবে বড় বাসে সবচেয়ে কম ভাড়া ধরা হয় ৭ টাকা, আর মিনিবাসে ৫ টাকা। কিন্তু সিটিং ও কাউন্টার সেবার নামে অনেক বাসই এই ভাড়া মানছে না। ফলে স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের পকেট থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে যাচ্ছে। হাফ পাস বা ভাড়া নেয়ার কথা থাকলেও অতিরিক্ত ভাড়া হতে রেহাই পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরাও। তাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে যাত্রীদের সমান টাকা। এ নিয়ে প্রায়শই দেখা দেয় বাক বিতন্ডা। 

এবিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক বলেন, আগে থেকেই মালিকরা নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি নিতেন। ভাড়া বৃদ্ধির পর পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। 

 খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানী ঢাকার বেশিরভাগ বাসে নেই ভাড়ার তালিকা। মিরপুর-মতিঝিল রুটে চলাচলকারী রাষ্ট্রায়ত্ত বিআরটিসির বাসে উঠেও দেখা যায়, তাতেও ভাড়ার তালিকা নেই। চালক জানালেন, ডিপো থেকে তালিকা দেওয়া হয়নি। এই সরকারি বাসেও ভাড়া বেশি নেওয়ার অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।

যাত্রীদের অভিযোগ, যেমন খুশি তেমন ভাড়া তো আদায় করতে লোকাল বাসকে রাতারাতি সিটিং বাসে রূপ দেওয়া হচ্ছে। আবার সিটিংয়ের নামে ভাড়া বাড়িয়ে যেখানে- সেখানে যাত্রী উঠানো-নামানোর চিত্রও আছে। বিশেষ সিটিং নামের বাসেও অনেক ক্ষেত্রে যাত্রীদের রড ধরে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। বিপরীত চিত্রও আছে। যাত্রীর চাপ বেশি থাকলে বাসকর্মীরা লোকাল বাসকে সিটিং হিসেবে রূপ দিয়ে বেশি ভাড়া আদায় করে থাকে। এতে করে বাস সংকট আরো বেড়ে যায়। 

রাজধানীতে গণপরিবহনে নৈরাজ্যের বিষয়ে বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুজিত হাওলাদার বলেন, বিআরটিএর মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে অভিযুক্তদের জরিমানা করা হচ্ছে। কিন্তু আগের দিন যে পরিবহনকে জরিমানা করা হয়েছে, পরের দিন দেখা যায়, ওই পরিবহনও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ করেনি।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলামের অভিমত, ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজালে দুর্ভোগ কমে আসবে। সঙ্গে বাড়াতে হবে গণপরিবহন। এজন্য বেসরকারি সেক্টরের পাশাপাশি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে বিআরটিসিকেও।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ