শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

প্রসঙ্গ : নীল কমল ও মেলান্দহের মানবসেতু

চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার নীলকমল ওসমানিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উৎসবে শিক্ষার্থীর পিঠের ওপর দিয়ে একজন প্রতিনিধির হেঁটে যাওয়া নিয়ে যখন তোলপাড় ও প্রতিবাদের ঝড় চলছে ঠিক সেসময়েই জামালপুর জেলার এক জমিদাতা স্কুলের ছাত্রদের তৈরি মানবসেতুর ওপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে একই রকম সমালোচনার মুখে পড়েছেন। হাইমচরে শিশুদের মানবসেতুর ওপর দিয়ে যিনি হাস্যোজ্জ্বল মুখে হেঁটেছেন তিনি হলেন নূর হোসেন পাটওয়ারী। তিনি সেখানকার উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকও। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে স্থানীয় সরকার বিভাগ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এদিকে শিশুদের শরীরের ওপর দিয়ে জুতাপায়ে হেঁটে যাওয়া নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাবিদ প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, একজন জনপ্রতিনিধির এ রকম কর্মকা- দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং বর্বরোচিত। এর উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার। স্কুলের প্রধানশিক্ষক ও সংশ্লিষ্টরা অবশ্য এ ঘটনাকে এতোটা সিরিয়াসলি নেননি। তারা বলতে চেয়েছেন এটা একটা নিছক খেলা এবং বিনোদন। এ স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এমনটি বিগত প্রায় ১০ বছর ধরে চলে আসছে। এর আগে একজন সাবেক প্রধানশিক্ষক, একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারও শিশুদের তৈরি মানবসেতুর ওপর দিয়ে হেঁটেছেন। অপরদিকে জামালপুর জেলার মেলান্দহে স্কুলের জমিদাতা জনৈক দিলদার হুসেন প্রিন্সও একইরকম মানবসেতুর ওপর দিয়ে হেঁটেছেন। ছবি দু’টো গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথমপৃষ্ঠায় পাশাপাশি ছাপা হয়েছে। মেলান্দহে এসএসসি পরীক্ষার্থী ও একজন শিক্ষকের বিদায় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি দিলওয়ার হুসেন প্রিন্স স্কুলছাত্রদের তৈরি মানবসেতুর ওপর দিয়ে হাঁটেন। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনও অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিকে বরণ করে নেবার আরও অনেকরকম আয়োজন অনেকেরই দেখা। সাধারণত ফুলের মালা পরিয়ে, মিছিল করে, আহ্লান সাহ্লান, শুভেচ্ছা স্বাগতম এমন স্লোগান দিয়ে অনুষ্ঠানের অতিথিদের বরণ করতে আমাদের প্রায় সকলের দেখা। কিন্তু শিশুদের কাঁচাধারা পিঠের ওপর দিয়ে জুতা পায়ে অতিথিদের অভিনব কায়দায় হেঁটে যাবার এমন নিয়ম করতে হবে কেনÑ তা আমাদের বোধগম্য নয়। শিশু  শিক্ষার্থীদের ওপর দিয়ে জুতা পায়ে হেঁটে যাবার ঘটনা কি সভ্যসমাজে কোনও কাক্সিক্ষত আচরণ? নিশ্চয়ই না।
এলাকার যিনি নেতা বা দানশীল ব্যক্তি তিনি অবশ্যই সম্মানিত ও গণ্যমান্য এবং প্রভাবশালী। নেতৃত্বের গুণাবলী যেমন সবার থাকে না, তেমনই সবাই দানশীলও হতে পারেন না। ধণাঢ্য হলেই সবাই দানশীল বা দাতা হতে পারেন না। এজন্য মানসিকতা ও ঔদার্যের প্রাচুর্য থাকতে হয়। এলাকার শিক্ষার জন্য, ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তা বা মসজিদের জন্য অকাতরে দান করবার মানসিকতা সবার না থাকলেও কারুর কারুর তো নিশ্চয়ই থাকে। অনেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েও স্থানীয় স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ বা রাস্তাঘাটের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়ে সহায়তা করতে পারেন না। আবার এমন লোকও দেখা যায় যে, নিজের কষ্টার্জিত সম্পদের সিংহভাগই এলাকার উন্নয়নের জন্য বা গরীব-দুঃখীর কল্যাণে অনায়াসে দান করে দিতে পারেন। তবে এজন্য কোনও দাতা এলাকার কোনও মানুষের ঘাড়ে বা পিঠে উঠে জুতাপায়ে হাঁটবার মানসিকতা পোষণ করেন বলে আমাদের জানা নেই। এমন কাজ কোনও দাতার এমন কি নেতার জন্যও কল্যাণকর বা শোভনীয় হতে পারে না। কোনও প্রকৃত দাতা বা সভ্যতার আলোকপ্রাপ্ত কোনও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মানুষের ঘাড়ে বা পিঠে উঠে নিজের কৌলিন্য জারি পরাকাষ্ঠা দেখাতে কাক্সিক্ষত থাকেন এমন মানসিকতা কারুর থাকে বলে আমাদের তেমন ধারণা নেই। তবে হাইমচরের নীলকমলে এবং জামালপুরের মেলান্দহের যেখবর ও ছবি আমরা প্রত্যক্ষ করলাম তা সত্যিই বিস্ময়কর এবং সভ্যসমাজের জন্য অনাকাক্সিক্ষত। নীলকমলের উপজেলা চেয়ারম্যান ও সরকারদলীয় স্থানীয় নেতা এবং মেলান্দহের জমিদাতার শিশুদের পিঠে বা ঘাড়ে উঠে জুতাপায়ে হাঁটবার কোনও মানসিকতা ছিল বলে মনে হয় না। তাঁরা হয়তো স্কুলের অনুষ্ঠানে গিয়ে আয়োজকদের আগ্রহেও মানবসেতুতে হাঁটবার জন্য বাধ্য হতে পারেন। নীলকমলের স্কুলশিক্ষকের ভাষ্য থেকেও তেমনই বক্তব্য আমরা পেয়েছি। তবে আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ভাইরাস হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে তেমনটা হয়তো সংশ্লিষ্টরা অনুধাবন করেননি। নীলকমল ও মেলান্দহে অনুষ্ঠানের আয়োজকদের অতি উৎসাহও মানবসেতুর ওপর দিয়ে হাঁটানোর জন্য অনেকখানি দায়ী বলে আমরা মনে করি।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তথা নেতা বা দানবীর নিশ্চয়ই এলাকার প্রতিষ্ঠানে সম্মানিত হবেন। মর্যাদা পাবেন। কিন্তু এজন্য কোনও পক্ষেরই অতিরিক্ত কিছু করা ঠিক নয়। একমণ দুধে যেমন সামান্য চনা দিলে তা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তেমনই কোনও নেতা বা দাতার ছোটখাটো ভুল বা অসৌজন্যমূলক আচরণও মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। হাইমচরের নেতা এবং মেলান্দহের জমিদাতা যে ভুল করেছেন, তার বিড়ম্বনা হয়তো তাদের অনেকদিন ভোগ করতে হবে। দেশবাসীকেও এ ঘটনা করবে বহুদিন আন্দোলিত।
-ইসমাঈল হোসেন দিনাজী

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ