স্বাধীনতার মাস
সাদেকুর রহমান : বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম উত্তাল সময়, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের তৃতীয় মাস মার্চের ১১ তারিখ আজ শনিবার। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক পর্বে ১৯৭১ সালে এদিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের এই দিনে দেশকে স্বাধীন করার আহ্বান জানিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে অসংখ্য মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধিকার আন্দোলনের মুক্তিকামী মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সব কিছুই চলছে তার নির্দেশে। সামরিক শাসকের নির্দেশ কেউ মানছে না। পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কখন যুদ্ধ শুরু হবে, সেই ক্ষণ গণনাও শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানী পতাকায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটতে থাকে।
একাত্তরের এদিন দেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের তদানীন্তন মহাসচিব উ থান্ট এক নির্দেশে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত জাতিসংঘের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী যেন সদর দফতরে ফিরে যান। এ নির্দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এ দেশের মানুষও এ পৃথিবীর বাসিন্দা। তাদের প্রতিও জাতিসংঘের দায়িত্ব রয়েছে।
এদিকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ব্যাংক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল রাখার জন্য অনেকগুলো নির্দেশ জারি করেন। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কঠোর শৃংখলা রক্ষা করতে হবে। তিনি অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সহযোগিতার জন্য জনসাধারণকে অভিনন্দন জানান। মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন ‘পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর, পৃথক রাষ্ট্র গঠন কর’ স্লোগান সংবলিত একটি লিফলেট বিলি করে। একই দিন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি দীর্ঘ টেলিগ্রাম পাঠান। তিনি সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে দুঃখ ও উদ্বেগের কথা জানান।
এদিকে দিন যতোই ঘনিয়ে আসছিলো ততোই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণ চলমান আন্দোলনে সর্বাত্মকভাবে অংশগ্রহণ করেছিলো। ফলে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতার প্রশ্নে অবিস্মরণীয় ঐক্যের সৃষ্টি হয়েছিলো। একাত্তরের এদিন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। অন্যদিকে করাচীতে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার ভাইস মার্শাল মোহাম্মদ আসগর খান বলেন, পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য হাতে আর মাত্র ক’টি দিন আছে। যদি ঢাকায় একটি গুলী চলে কিংবা সামরিক ব্যবস্থা নেয়া হয় তাহলে পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে।
২০১৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিসংগ্রামী লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী তার ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেন, “১১ মার্চ বরিশাল কারাগার ভেঙ্গে ৪০ জন কয়েদী পালিয়ে গেল। নিরাপত্তা কর্মীর গুলীতে ২ জন নিহত ও ২০ জন আহত হয়।”
আরেক মুক্তিসেনানী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম পিএসসি তার ‘বিদ্রোহী মার্চ ১৯৭১’ গ্রন্থে এদিনের ঘটনাবলী তুলে ধরে আরো উল্লেখ করেন-“এই সময় শোনা গেলো, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শীঘ্রই বাংলাদেশ সফরে আসছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই সময় এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাতের আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে তার ৬ মার্চের বেতার ভাষণ প্রত্যাহারের দাবি জানালো। ওয়ালীপন্থী ন্যাপ নেতৃবর্গ, মওলানা ভাসানী ও আতাউর রহমান খান এই সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের সভায় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে জোরদার করার জন্য জনতার প্রতি আহ্বান জানালেন। শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরাও চুপ করে বসে থাকলেন না। তারাও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করে দেশব্যাপী নানা অনুষ্ঠান করে চললেন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদ (শহীদ), আজীবন পল্লী গানের সাধক গীতিকার সুরকার-গায়ক আব্দুল লতিফ, ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’ ইত্যাদি গানের সুরকার শেখ লুৎফর রহমান, আপেল মাহমুদ, অজিত রায়, সৈয়দ আবদুল হাদী, খালিদ হোসেন প্রমুখ শিল্পী বজ্রশপথে অগ্রসর হলেন জনতার কাতারে। কামরুল হাসান প্রমুখ শিল্পীও রং-তুলি নিয়ে নেমে এলেন পথে। ঢাকাসহ সারা দেশে একই চিত্র দৃশ্যমান হলো।”
এদিকে, এদিন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে টিক্কা খানের শপথ নেয়ার কথা থাকলেও বিচারপতি বি.এ.সিদ্দিকী শপথ বাক্য পাঠ করাননি। এ নিয়ে চট্টগ্রামে আনন্দ মিছিল বের হয়। এরকম একটি মিছিল দেওয়ানহাট হয়ে হালিশহরের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ পথে অখন্ড পাকিস্তানকামীদের একটি গ্রুপ তলোয়ার আর গুলী নিয়ে মিছিলরত স্বাধীনতাকামী নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালীদের আক্রমন করে। পনেরো-বিশজন বাঙালী নিহত ও অর্ধ শতাধিক আহত হবার খবর আসে। প্রত্যুত্তরে কিছু বাঙালী যুবক টাইগার-পাসে দু’জন বিহারীকে গুলী করে। এ ঘটনার পর সন্ধ্যায় আর্মি সারা শহরে টহল দেয়। থমথমে হয়ে যায় পুরো শহর। পাকিস্তানী আর্মি আগ্রাবাদ মোড় হতে পাঁচ-ছয়জন বাঙালী যুবককে তুলে নেয়ার খবর পাওয়া যায়। তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।