বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

নারী নৈতিকতা

মোমতাহানা সুরভি : নারী মানব সভ্যতার অর্ধাংশ, সভ্যতার সূচনা ও বিকাশে এক অনবদ্য ভূমিকা পালনকারী, নারীর অবদান ছাড়া এই সভ্যতা অচল। একইভাবে একটি অনিবার্য সত্য এই যে, সমাজের নৈতিকতা রক্ষার মূল চাবিকাঠি নারীর হাতে নিহিত।
নৈতিকতা বিষয়টি নীতির অনুসরণের সাথে সংশ্লিষ্ট। আর এই নীতি হতে হবে শুদ্ধ ও সুস্থ। নারী ও পুরুষের উভয়ের নৈতিকতা রক্ষার মাধ্যমে সমাজের নৈতিক মান অর্জিত হয়। নারী ও পুরুষের সম্পর্কের নীতিমালার উপর সমাজের নৈতিক অকল্যাণের তারতম্য অনেকাংশেই নির্ভরশীল। একজন নারীর ভূমিকা এই জায়গায় অবশ্যই বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে। কোন কোন দিক থেকে নারীর অবস্থান সমাজের নৈতিকতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ তা একটু ভেবে দেখা যাক-
- নারী ও পুরুষের সম্পর্কের নৈতিকতা
- পারিবারিক নৈতিক শিক্ষায় একজন নারীর ভূমিকা
- ঘরে ও বাইরে নারীর নৈতিক অবস্থান (নিজেকে উপস্থাপন, আচরণ, কর্মক্ষেত্র)
নারী ও পুরুষের সম্পর্কের নৈতিকতা : একটি সমাজ ব্যবস্থার নৈতিক পবিত্রতার মূল বীজ নারী ও পুরুষের সম্পর্কের ভিতর নিহিত। মানব সমাজের নারী ও পুরুষের যৌন সম্পর্কেও স্বীকৃত বৈধ ভিত্তি স্থাপিত হয় বিয়ের মাধ্যমে। বিয়ে ব্যতিত বা বিবাহ বহির্ভূত অবাধ যৌনাচার মানবীয় নৈতিক দৃষ্টিকোন, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ উভয় দিক থেকেই একটি ঘৃণিত কর্মকা-। ইসলামসহ বেশির ভাগ ধর্মেই এই কাজটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে পরিগণিত করা হয়েছে। বিভিন্ন জাতি ও সভ্যতার ইতিহাস থেকে দেখা যায়, যে জাতি বা সভ্যতাতেই ব্যভিচারের জীবাণু প্রবেশ করেছে, যেই জাতি বা সভ্যতার সামাজিক, পারিবারিক নৈতিক ভিত্তি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে সেই সভ্যতাকে।
 নারী ও পুরুষের যৌন আকর্ষণ প্রাকৃতিকভাবেই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। কিন্তু যৌন আকর্ষণকে একটি সীমার মধ্যে না রাখলে তা মানবচরিত্রের নৈতিকতা বিরোধী এক উপকরণে পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবেই নারী ও পুরুষের সম্পর্কের নৈতিকতা রক্ষায় পুরুষের সাথে সাথে নারীর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ, বরং বলা যায় পুরুষের চেয়ে একটু বেশিই। নারী যদি অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পুরুষকে উৎসাহিত করে, তাহলে এই অনৈতিক কর্মের গতিশীলতা আরো অধিকগুণে তরান্বিত হয়ে যায়। যে সমাজে নারী তাঁর নৈতিক পবিত্রতা ও সতীত্ব রক্ষায় দৃঢ় থাকেনা, সেখানে ব্যভিচারের বীজ অনুপ্রবেশ করতে বাধ্য।
পারিবারিক নৈতিক শিক্ষায় একজন নারীর ভূমিকা : পরিবার গঠনে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। একজন নারী একটি পরিবারের কন্যা, জায়া বা জননী। পরিবারে স্বামীর সব কাজে অসুপ্রেরণার উৎস একজন স্ত্রী; সন্তানের সামনে সার্বক্ষণিক এক আদর্শ তার মা, পিতা, মাতা, ভাইদের কাছে পরমস্নেহ, ভালবাসার উৎস একজন বোন। সব দিক থেকে পারিবারিক শিক্ষায় মূল শিক্ষকের ভূমিকায় থাকেন একজন নারী। নেপোলিয়ান যথার্থই বলেছেন-“আমাকে একটি আদর্শ মা দাও আমি তোমাকে আদর্শ জাতি দিব।” একজন নারী যখন নৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত হোন, তার সন্তান শিক্ষা পায় সত্যভাষী হওয়ার, সৎচরিত্রের অধিকারী হওয়ার, অসৎকাজ থেকে বিরত থাকার, মানুষকে সাহায্য করার মতো চারিত্রিক গুণাবলী। একজন সৎ ও চরিত্রবান স্ত্রী কখনো স্বামী কে অবৈধ উপাজর্নের পথে পা বাড়ানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করেন না। একজন আদর্শ বোনকে দেখে ভাইদের মনে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অনুভূতি তৈরি হয়ে যায়। বিপরীত নৈতিকভাবে দেউলিয়াগ্রস্থ একজন নারী তার সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে হোন ব্যর্থ,স্বামীও সৎকাজের কোনো অনুপ্রেরণা অসৎ স্ত্রীর কাছ থেকে পায় না, সার্বিকভাবেই নৈতিক শিক্ষার বিস্তারে পারিবারিক সুশিক্ষার কোন বিকল্প নেই, আর এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক হিসাবে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
ঘরে ও বাইরে নারীর নৈতিক অবস্থান নিজেকে উপস্থাপন, আচরণ, কর্মক্ষেত্র : পরিবারে ও পরিবারের বাইরে একজন নারীর অবস্থান নৈতিকতা রক্ষার অন্যতম প্রধান নিয়ামক। বিষয়টি কিছুটা জটিল কিন্তু যথেষ্ট গুরুত্বের দাবী রাখে।
এই বিষয়টি বুঝার জন্য একজন নারীর মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের দিকে দৃষ্টিপাত করা জরুরি। প্রকৃতিগতভাবে নারী সন্তান ধারন, সন্তান প্রতিপালনের উপযোগী, স্নেহ মায়া মমতার উৎসস্থল এক মানবীয় সত্বা। পুরুষের সাথে নারীর পারিবারিক ও কর্মক্ষমতাজনিত পার্থক্য বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত একটি বিষয়, একজন নারীর ঋতুকালীন ও গর্ভাবস্থার সময়ে তার শারীরিক ও মানবিক কিছু দূর্বলতা থাকে যা পুরুষের নেই। প্রকৃতিগতভাবেই কর্মক্ষেত্র পৃথক করার মাধ্যমে ইসলাম নারীকে তার নৈতিক চরিত্র হেফাযত করাকে সহজ করেছে। তাই নারীর জন্য সন্তান প্রতিপালন, গৃহস্থালী কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও পুরুষের জন্য বহিরাঙ্গনের কাজ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ তথা অর্থ উপার্জনের কাজগুলোই যথোপযুক্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ থেকেই বুঝা যায় নারী ও পুরুষের কাজের মূল অঙ্গনও পৃথক ও ভিন্ন।
আর নারী ও পুরুষের মধ্যকার যৌন আকর্ষণ থাকাটা প্রকৃতিগত ভাবেই খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। আর নারী কিভাবে নিজেকে অন্য পুরুষের সামনে উপস্থাপন করছে, তার পোশাক, চলাফেরা, কথাবার্তা কেমন হচ্ছে এটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। একজন নারীর খোলামেলা পোশাক পরিধান, আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলা আরেকজন পুরুষের মনে অনৈতিক যৌন কামনা জাগিয়ে তুলতে পারে, এটাই স্বাভাবিক। আর এভাবেই ইভাটিজিং, যৌন নির্যাতন, ধর্ষণসহ নানা ধরণের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের, বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সূত্রপাত ঘটে।
জর্জ ব্যালেসুট তার theory of Prostitution গ্রন্থের এক স্থানে ইউরোপ-আমেরিকার ব্যভিচার, বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্কের কারণের ব্যাপারে বলেছেন “সমাজের মধ্যে যৌন স্বেচ্ছাচারিতার ব্যাপক প্রসার হওয়ার আর একটি প্রধান কারণ এই যে, মেয়েরা প্রতিদিন ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান,অফিস-আদালত ও বিভিন্নক্ষেত্রে চাকরি গ্রহণ করছে। এসব স্থানে রাতদিন পুরুষের সংগে তাদের অবাধ মেলামেশার সুযোগ হচ্ছে। এই সুযোগ নারী ও পুরুষের নৈতিক মান অতি নিম্নস্তরে নামিয়ে দিচ্ছে, পুরুষ অগ্রগামী হয়ে কিছু করতে চাইলে, তা রোধ করার ক্ষমতা নারীর থাকে না। ফলে উভয়ের মধ্যে যে যৌন সম্পর্ক গড়ে উঠে, তা নৈতিকতার সকল বাঁধ অতিক্রম করে”। বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকার মত দেশে কুমারী মাতার সংখ্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক এখন সেখানে স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তার ফলে সমাজের নৈতিক মানও নেমে গেছে অনেক নিচে।
নারী তার স্বাভাবিক প্রয়োজন পূরণের তাগিদে ঘরের বাইরে আসতে পারে, অর্থ উপার্জনের সুযোগও তার আছে। কিন্তু নারী ও পুরুষের পৃথক কর্মক্ষেত্র না থাকা, অবাধ মেলামেশার পরিবেশ থাকা, নারীর সৌন্দর্য প্রদর্শনের মানসিকতা অবশ্যই সমাজে নৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে।
নারীর নৈতিক অবস্থান রক্ষায় ইসলাম কি বলে?
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন প্রদত্ত ইসলাম একটি সর্বোত্তম জীবন ব্যবস্থা। এই দ¦ীনে নৈতিক মর্যাদা কিভাবে সমুন্নত করা হয়েছে তা একটু জেনে নেই Ñ
নারীর কর্মক্ষেত্র ও তার সীমা : নারীকে গৃহের রানী বানিয়ে দেয়া হয়েছে। স্বামী বৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন করবে এবং সেই অর্থে গৃহের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা করবে স্ত্রী। হাদীসে এসেছে- “নারী তার স্বামী গৃহের পরিচালিকা ও শাষিকা। এজন্য আল্লাহ্র নিকট তাকে জবাবদিহি করতে হবে।’’ (বুখারী)
 গৃহের পরিপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব নারীকে দেয়া হয়েছে। জুমআর নামাযও নারীর প্রতি ওয়াজিব নয়। জিহাদের ময়দানে যাওয়া তার জন্য ফরজ নয়, জানাযার নামাযে অংশ নিতে নারীকে নিষেধ করা হয়েছে। জামাতে নামায পড়াও নারীর জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়নি। অর্থ উপার্জনের বাধ্যবাধকতা নারীর উপড় নেই। নারী অনেক ধনী হলেও তার ভরণ-পোষণের জন্য পুরুষ বা স্বামীই দায়িত্বশীল থাকবে। এভাবে নারী ও পুরুষের কর্মক্ষেত্র পৃথক করার মাধ্যমে ইসলাম নারীকে তার নৈতিক চরিত্রের হেফাজত করা সহজ করেছে।
বিয়ের মাধ্যমে নারীর নৈতিক ও চারিত্রিক নিরাপত্তা : ইসলাম নারী ও পুরুষকে তাদের পাস্পারিক সর্ম্পককে এমন এক নিয়ম শৃংখলার অধীন করে যা তাদের চরিত্র সকল প্রকার কলুষতা থেকে সুস্থ করে নৈতিক অধঃপতন কে রোধ করে। এজন্য নারী ও পুরুষের সর্ম্পকের বৈধতার জন্য বিয়ে নামক প্রথা ইসলামে স্বীকৃত। কোরআনে বিবাহকে ‘ইহসান’ বলা হয়েছে যার অর্থ দূর্গ। বিবাহিতা নারীকে মুহছেনা বা সুরক্ষিতা নারী বলা হয়েছ্, যার অর্থ বিবাহিত নারী বিয়ে নামক দুর্গের মাধ্যেমে নিজের  নৈতিক চরিত্রকে সুরক্ষিত করে। তোমরা তাদের অভিবাবকদের অনুমতি নিয়ে তাদেরকে বিয়ে করো এবং ন্যায় সঙ্গত মোহর আদায় করো। এজন্য সেই নারী যেন মুহছেনা হতে পারে। ’এবং প্রকাশ্যে এবং গোপনে অবিচারে লিপ্ত হতে না পারে।’ (সূরা নিসা: ২৫)
পর্দার মাধ্যমে নারীর নৈতিকতার সুব্যবস্থা : ইসলামে শরয়ী পর্দার মূলনীতি হচ্ছে নারী চৌদ্দজন মাহরাম পুরুষের সামনে নিজের সতর আবৃত রাখবে ও এই চৌদ্দজন মাহরাম ব্যতিত আর কোনো পুরুষের সামনে তার সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না। “(হে নবী) তুমি মুমেনা নারীদের বলে দাও, তারা যেন (গায়ের মুহাররম পুরুষ) তাদের দৃষ্টি অবনমিত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানগুলোর হেফাজত করে চলে।
উপরন্তু তারা যেন নিজেদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, আর যা আপনাআপনি প্রকাশ হয়ে যায় তা ব‍্যতীত এবং তারা যেন চাদর দিয়ে বক্ষদেশ ভালোভাবে আবৃত করে রাখে এবং তারা যেন সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, এসব লোক ব‍্যতীত -স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, সৎপুত্র, ভাই, ভাইপো, ভাগ্নে, স্ত্রীলোক, যৌন বাসনা নেই এমন পুরুষ, যৌন বাসনা জাগ্রত হয়নি এমন বালক, উপরন্তু তাদের বল, তারা যেন পথ চলার সময়ে মাটিতে পায়ের পদাঘাত না করে যার দ্বারা তাদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশ হয়ে পড়ে।” (সূরা নূর-৩১)
এছাড়াও মুমিন পুরুষ ও নারী উভয়কেই তাদের দৃষ্টি সংযত রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে (নূর: ৩০)। হাদিসেও আমরা দেখি রাসূল (সাঃ) সাহাবাদের কোন অপরিচিত নারীর প্রতি একবার দৃষ্টি পড়লেও দ্বিতীয় বার আর না তাকাতে নির্দেশ দিয়েছেন। এভাবেই ইসলাম নারী ও পুরুষের নৈতিক সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।
সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া স্বাভাবিক যে, ইসলাম নারীর নৈতিক মর্যাদা সবচেয়ে উত্তমভাবে সংরক্ষিত করেছে। আর কোন ধর্ম, মত, সমাজ ব্যবস্থা তা পারেনি। মানবসমাজের নৈতিক সুরক্ষার মূল বিষয়গুলো অনেকাংশেই নারীর উপর নির্ভরশীল। তাই নারীর নৈতিক অবস্থান সকল সংশয়ের উপর স্থাপন করতে ইসলামী অনুশাসন অনুসরণ করা আজ সময়ের দাবী। নারী কোন নৈতিকতা বিনাশী উপকরণ নয়, বরং নারীই হতে পারে সমাজের নৈতিকতার সুঘ্রাণ ছড়ানো এক সুবাসী চুল।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ