শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বোরোর চাষাবাদে বিদ্যুৎ

বোরো ধানের চাষাবাদ শুরু হতে না হতেই দেশজুড়ে আবারও বিদ্যুৎ সংকট মারাত্মক হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রের খবরে জানা যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যুতের উৎপাদন হাজার হাজার মেগাওয়াট বাড়ানোর গালগল্প শোনানো হলেও প্রকৃতপক্ষে বেশ কিছুদিন ধরেই লোডশেডিং-এর কবলে পড়েছে জনগণ। রাজধানীসহ সব নগরী-মহানগরী ও শহরে তো বটেই, গ্রামাঞ্চলেও এখন লোডশেডিং হচ্ছে যখন-তখন। কোনো কোনো এলাকায় এমনকি ১০-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হচ্ছে। ফলে জনগণের কষ্টের কোনো শেষ থাকছে না।
বর্তমানে কথা উঠেছে বিশেষ করে বোরো ধানের চাষাবাদ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশংকার কারণে। গতকাল দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, চলতি বোরো মওসুমে তিন লাখ ৫৩ হাজার সেচযন্ত্র বিদ্যুতে চালানো হবে। এজন্য বিদ্যুৎ লাগবে দুই হাজার ২৩৬ মেগাওয়াট। শুধু তা-ই নয়, আগামী দুই মাসে বিদ্যুতের চাহিদা সাড়ে নয় হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড রয়েছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ নিশ্চিতভাবেই অন্তত আড়াই হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুতের ঘাটতির কবলে পড়বে দেশ। ওদিকে চাহিদা পূরণের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের প্রয়োজন পড়বে এক হাজার পাঁচশ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু এই পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে না বলে এরই মধ্যে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা। সংস্থাটি বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ৯১৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতে পারে। তবে সেচ মওসুমে এক হাজার ১১৪ মলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এবারের সেচ মওসুমে পেট্রোবাংলার পক্ষে এক হাজার ২৬০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এর ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যাহত হবে আর বিদ্যুতের ঘাটতি হলে বাধাগ্রস্ত হবে বোরোর চাষাবাদ।
উল্লেখ্য, ফেব্রুয়ারি মাসে বোরো চাষাবাদ শুরু হলেও বিদ্যুতের চাহিদা বেশি বেড়ে যায় এপ্রিল ও মে মাসে। গত বছর ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল সাত হাজার ৫৭১ মেগাওয়াট। চলতি বছর সে চাহিদা সাড়ে নয় হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে গত বছর প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা যেখানে ছিল এক হাজার ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট সেখানে সরবরাহ করা হয়েছিল এক হাজার ১২ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ ঘাটতি ছিল ২৩৮ মিলিয়ন ঘনফুটের। এ বছর গ্যাসের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে দেড় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে কম পক্ষে এক হাজার ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস অবশ্যই সরবরাহ করা দরকার। কিন্তু পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, এত বিপুল পরিমাণ গ্যাস সংস্থাটি সরবরাহ করতে পারবে না। যার অর্থ, চলতি বছরের বোরো চাষাবাদ মূলত গ্যাস ও বিদ্যুতের কারণে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। ওদিকে নিশ্চিত ঘাটতির সম্ভাবনার মধ্যেও এবার সাত হাজারের বেশি সেচযন্ত্রে নতুন সংযোগ দেয়া হয়েছে। এর ফলে সেচযন্ত্রের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৫৩ হাজার ১৮৬টিতে। একযোগে বেড়ে গেছে বিদ্যুতের চাহিদাও। কিন্তু একদিকে পেট্রোবাংলা আগেই অক্ষমতার কথা জানিয়ে দিয়েছে, অন্যদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থাও এমন আশ্বাস দিতে পারছে না যে, তাদের পক্ষে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে। ফলে বোরোর চাষাবাদই শুধু বাধাগ্রস্ত হবে না, একযোগে সারাদেশেও বিদ্যুৎ সংকট মারাত্মক হয়ে উঠবে। লোডশেডিং-এর যন্ত্রণা মানুষকে দিশেহারা করে ফেলবে।
আমরা মনে করি, এমন অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। কারণ, বিদ্যুতের সঙ্গে চাষাবাদ ও শিল্পের উৎপাদন থেকে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া পর্যন্ত প্রতিটি বিষয় জড়িত। এই সময়ে এমনিতেই মানুষ পুড়ছে প্রচণ্ড গরমে। প্রসঙ্গক্রমে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, সরকার যে ১০ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের গালগল্প শুনিয়ে থাকে সে বিদ্যুৎ তাহলে গেলো কোথায়? পর্যালোচনায় দেখা যাবে, বাস্তবে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের নামে দলীয় লোকজনকে ব্যবসা পাইয়ে দেয়ার এবং পকেট ভারি করার ব্যবস্থাই শুধু করা হয়েছে। এজন্যই একদিকে সরকার দফায় দফায় গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে চলেছে অন্যদিকে দলীয় লোকজনকে বছরে ভর্তুকি দিচ্ছে ২৪ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়ার পরও সংকটের সমাধান হচ্ছে না। কারণ, কোনো রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রই চাহিদা বা চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ করতে পারছে না।
আমরা মনে করি, বোরোর চাষাবাদের জন্য চাহিদার পাশাপাশি তীব্র সংকটের এই সময়ে সরকারের উচিত জনগণের কষ্ট ও ভোগান্তিকে প্রাধান্য দেয়া এবং রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সম্পাদিত অসম চুক্তি বাতিল করা। সরকারকে একই সঙ্গে গ্যাসভিত্তিক প্রচলিত সকল কেন্দ্র সংস্কার করে সেগুলোর মাধ্যমে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। নাহলে মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তি তো বাড়বেই, কৃষির বিকাশ ও শিল্পায়নের সঙ্গে সামগ্রিক সমৃদ্ধিও বাধাগ্রস্ত হবে। তাছাড়া পবিত্র মাস রমজানও এগিয়ে আসছে। এখনই ব্যবস্থা না নেয়া হলে রোজার মাসে সাহরী, ইফতার ও তারাবিহর সময় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কষ্ট সীমা ছাড়িয়ে যাবে। সুতরাং বিদ্যুতের সংকট কাটিয়ে ওঠার পদক্ষেপ নিতে হবে এখনই। বিশেষ করে বোরোর চাষাবাদ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় সে লক্ষ্যে ব্যবস্থা নিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ