শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস ও আমার নীল রং এবং আলোর পাখি

সাবরীনা শারমিন বনি : ২ এপ্রিল ২০১৭ পালিত হলো ১০ম অটিজম সচেতনতা দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল স্বকীয়তা ও আত্মপ্রত্যয়ের পথে। এই দিন  সকল অটিজম পরিবারগুলো আমরা নীল রং ধারণ করে সব কিছুতে নীলকে প্রাধান্য দিয়ে ঘরের কোণে নীল আলোটি জ্বেলে সব হতাশাকে দূরে ঠেলে দিয়ে একরাশ স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে আলোর পথে পা বাড়াই। কিন্তু কেন এই নীল ? নীল হলো আশার প্রতীক। নীল হলো শান্তির প্রতীক। তাই তো ‘Autism Speaks” Light it up blue” GB thinking নিয়ে প্রতিবছর ২ এপ্রিল তাদের স্বাক্ষরতা অভিযান শুরু করে। উদ্দেশ্য সারা বিশ্বব্যাপী Autism সচেতনতা সৃষ্টি করা। এপ্রিল মাসটিকে Autism awareness month হিসাবে পালন করা হয়। সারা বিশ্বের হাজার হাজার মানুষ এই দিনটিতে Autism আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবারের সম্মানে নীল পোশাক পরে। অটিজম বান্ধব হবার জন্য সোসাল মিডিয়াতেও তারা নীলের আধিক্য ঘটায়। তাদের প্রোফাইল পিকচারটিকে নীল রং এ পরিবর্তন করে। বিভিন্ন গ্লোবাল ল্যান্ড মার্ক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বড় বড় সংস্থার দালান, নিজেদের বাড়ী ঘরে তারা ব্লু লাইট জ্বালায়। উদ্দেশ্য একটাই অটিজম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি।  সাগর নীল। আকাশ নীল। সাগরের গভীরতা আর আকাশের উদারতা নিয়ে অটিজম সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। ২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর কাতারে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬২তম সাধারণ সভায় বিশ্বে অটিজম সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২ এপ্রিলকে“ বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস হিসাবে পালনের উদ্যোগ নেয়া হয় এই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের ২ এপ্রিল প্রথম  বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। অটিজম সম্পর্কে সচেতন হতে হলে আমাদের জানতে হবে অটিজম কি? ১৯৪৩ সালে একজন আমেরিকান চিকিৎসক লিত্ত ক্যানার শিশুদের আচরণ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে ১১ শিশুর মধ্যে আচরনগত বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করেন এবং এই সমস্ত অস্বাভাবিক আচরণকারী শিশুদের রোগী হিসাবে আখ্যায়িত করেন। তিনিই এই রোগের নামকরন করেন অটিজম। পরবর্তী প্রায় বছর খানেক পর অষ্ট্রিয়ার চিকিৎসক হ্যান্স অ্যাসপারজার ও শিশুদের উপর গবেষণা করেন। কিছু শিশুদের মধ্যে আচরণগত বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করেন। মজার ব্যাপার হলো তিনিও এই রোগটির নামকরণ করেন অটিজম। এই নামকরণের আগে তারা কেউ কাউকে চিনতেন না। এবং নাম করণও করেছিলেন স্বতন্ত্রভাবেই। গ্রিক শব্দ ‘অটোস’ থেকে অটিজম শব্দের উৎপত্তি। অটোস শব্দের অর্থ নিজ। অটিজম আক্রান্ত রুগী সকল প্রকার সামাজিকতা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আত্মকেন্দ্রীক হয় বলে এই রোগকে অটিজম বলে। ২০১১ সালে ২৫ শে জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সুযোগ্য কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের পরামর্শে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তত্বাবধানে “Autism spectrum disorder and developmental disabilities in Bangladesh and South Asian” এর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১১টি দেশের অংশগ্রহণে ঢাকা ঘোষণা গৃহীত হয় যা অটিজম শিশুদের উন্নয়নে এক মাইলফলক হিসাবে ধরা হয়। তখন থেকেই অটিজম বিষয়ে সবার মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। শিশু মনোবিজ্ঞানী সায়মা ওয়াজেদ এর প্রচেষ্টায় ২০১১ সালের ২৫ জুলাই গঠিত হয়। South Asiam Autisn Network (SAAN) যার মাধ্যমে সবাই সচেষ্ট হয়। অটিষ্টিক শিশুদের উন্নয়নে কাজ করার জন্য।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ এ অটিজম সম্পর্কে বলা হয়েছে। যার মধ্যে এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হবে, তারা অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ব্যক্তি বলে বিবেচিত হবেন (ক) মৌখিক বা অমৌখিক যোগাযোগে সীমাবদ্ধতা (খ) সামাজিক ও পারস্পরিক আচার-আচরণ ও ভাব বিনিময় ও কল্পনাযুক্ত কাজ কর্মের সীমাবদ্ধতা (গ) একই ধরনের বা সীমাবদ্ধ কিছু কাজ বা আচরণের পুনরাবৃত্তি (ঘ) শ্রবণ, দর্শন, গন্ধ, স্বাদ স্পর্শ, ব্যথা, ভারসাম্য ও চলনে অন্যদের তুলনায় বেশী বা কম সংবেদনশীলতা  (ঙ) বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা বা অন্য কোনো প্রতিবন্ধিতা বা খিচুনী (চ) এক বা একাধিক নির্দিষ্ট বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতা এবং একই ব্যক্তির মাঝে বিকাশের অসমতা (ছ) চোখে চোখ না রাখা বা কম রাখা (জ) অতিরিক্ত চঞ্চলতা বা উত্তেজনা, অসংগতি পূর্ণ হাসি-কান্না স্বাভাবিক শারীরিক অংগভংগী (ঞ) একই রুটিনের চলার প্রচন্ড প্রবণতা (ট) সরকার কর্তৃক সময়ে সময়ে গেজেট নোটিফিকেশনের দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোন বৈশিষ্ট্য।
অটিজম কি কোন সমস্যা? হ্যাঁ এটা একটা সমস্যা। মনোবিকাশগত সমস্যা। অনেকে এটাকে রোগ বলে অভিহিত করেন। কিন্তু অটিজম কোনভাবেই রোগ নয়। এটা স্নায়ুগত বা মানসিক সমস্যা এই সমস্যাকে ইংরেজীতে নিউরো ডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার বলে। অটিজমকে সাধারণভাবে শিশুর মনোবিকাশগত জটিলতা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। অটিজমের লক্ষণগুলো একদম শৈশব থেকে ৩ বছরের মধ্যে প্রকাশ পায়। অটিজমে আক্রান্তরা সামাজিক যোগাযোগে দুর্বল হয়, পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কম সক্ষম হয়। মানসিক সীমাবদ্ধতা ও একই কাজ বারবার করার প্রবণতা দেখা যায় অটিস্টিক শিশু সমবয়সী বা অন্য কোনো বয়সীদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না, নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দেয় না। এরা অনেকেই আকার ইঙ্গিতে কথা বলতে পছন্দ করে। এই ধরনের শিশু আপন ভূবনে থাকতে পছন্দ করে নিজের ইচ্ছামত চলে। যখন যা ইচ্ছা করে তখন তা করতে না পারলে খিচুনীভাব হয়। এরা কারো চোখের দিকে তাকায় না। কারো সাথে নিজের ব্যবহৃত জিনিস পত্র শেয়ার করতে চায় না, কারো দিকে তাকিয়ে হাসে না কিংবা আদর করলেও তাতে সাড়া দেয় না। অনেকে আবার আদরও পছন্দ করে না। খেলনা নিয়ে অর্থপূর্ণ ভাবে organized way তে খেলতে পারে না। তারা একই কথা বার বার বলে। তবে সব অটিস্টিক শিশু একই আচরণ করবে এটা ঠিক নয়।
২৩ বছর আগে এই রকম এক অটিস্টিক শিশুকে সাথে নিয়ে দুর্গম পথে আমার আনন্দময় যাত্রা শুরু হয়। আমার ধৈর্য, আমার শক্তি আমার সাহস আমার আনন্দ আমার সাদেক জ্যাফরুল্লাহ নাহিন, “নাহিন” সৃষ্টি কর্তার পক্ষে থেকে আমার জন্য একটা Gifted child ১৯৯৪ সালে ২৯ শে সেপ্টেম্বর নাহিনের আগমনে আমার পরিবারে একটা আলোর ঝলকানী বয়ে গিয়েছিল। আগমনের আগেই তার বাবা ও আমি নিয়ত করেছিলাম তাকে আমরা কোরআনে হাফেজ বানাবো। এভাবেই শুরু হলো নাহিনের পরিচর্যা। নাহিন সময়মত বসতে শিখলো, হাঁটতে শিখলো। কথা বলতে শিখলো। যখন থেকে সে কথা বলতে শিখলো তখন থেকেই সে গান ও কবিতা মুখস্ত করে ফেলতো। এর ফলে ২-২.৫ বছর যখন তার বয়স তখন আরও প্রবল হলো তাকে কুরআনে হাফেজ বানানোর ইচ্ছাটা। হঠাৎ পৌনে তিন বছর বয়সে সে দূর্দান্ত চঞ্চল হয়ে উঠলো। কখনো স্টিলের আলমারীর মাথার উপরে উঠে লাফায়। কখনো ছাদের কার্নিশ দিয়ে হাঁটে। কখনো ওয়ার্ড্রোবের মাথার উপর বসে থাকে। প্রত্যেকেই আমাকে বলতে লাগলো প্রখর মেধাবী বাচ্চারা এই রকম দূর্দান্ত হয়। শেষে সবার পরামর্শে নাহিনকে স্কুলে ভর্তি করে দিলাম। তখন তার বয়স সাড়ে তিন বছর। প্রথমে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে pre-school-এ ভর্তি করলাম। সেই স্কুলে রাশিয়ান একজন ডাক্তার নাহিনদের MISS ছিলেন। উনি আমাকে বললেন, তোমার বাচ্চার সমস্যা আছে। তাকে আমরা আলাদা ক্লাশ রুমে One=One পদ্ধতিতে পড়াবো। কিন্তু আমি আমার পরিবার মানতে নারাজ যে, নাহিনের সমস্যা আছে। আমরা স্কুল কর্তৃপক্ষের উপরে বিরক্ত হলাম। আমাদের চিন্তা যে, নাহিনকে স্কুলে দিয়েছি সামাজিক বানানোর জন্য, কেন তারা তাকে Isolated করে রাখবে। আমার মেয়েরা ইসলাামিক এডুমেশন সোসাইটির একটি স্কুলে পড়তো। নাহিদকে সে স্কুলে শিশু ’ক’ এ ভর্তি করলাম। কিন্তু সেখানে গিয়েও একই অবস্থা। সে লাফ দিয়ে Teacher এর কোলে বসে যায়। দৌড় দিয়ে ক্লাশ রুম থেকে বের হয়ে স্কুলের ঘন্টা বাজিয়ে দেয়। Teacher যা বলে তাই সে রিপিট করে। কিছু দিন পর আবার স্কুল Change। এবার যে স্কুলে দিলাম সেখানে সে ক্লাশ রুমের  এক কোনে চুপ করে একা একা বসে থাকে। মনে হলো সে যেন একটা আলাদা জগত তৈরীতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। জন্মের পর থেকে তার eye-contact ও ঠিক ছিল এবং speech ও ঠিক ছিল। কিন্তু সাড়ে চার বছরে দেখলাম সে একটু কোনা করে তাকানো শুরু করেছে। আর ওকে কোন প্রশ্ন করলে উত্তর না দিয়ে প্রশ্নটাই রিপিট করে। হঠাৎ চঞ্চলতা, হঠাৎ নীরবতা সব যেন আমাকে অল্প সময়ের মধ্যে ভাবিয়ে তুললো। আমি তখন খুঁজতে লাগলাম এর সমাধান। অনেকের সাথে পরামর্শ করে জানলাম ওকে নিয়ে যেতে হবে পেডিয়াট্রিক্স নিউরোলজিষ্ট এর কাছে। নাহিনকে সাথে নিয়ে রওনা হলাম ঢাকায়, সাথে ওর বাবা ও দুই বোন। একটি নাম করা হাসপালে পেডিয়াট্রিক্স নিউরোলজিষ্টের কাছে তাকে দেখানো হলো। তিনি বললেন সাইকোলজিক্যাল এসেসমেন্ট ছাড়া কোন treatment দেয়া যাবে না। পরের দিন শিশু হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্রে তার সাইক্লোজিক্যাল এসেসমেন্ট হলো। সাইক্লোজিস্ট যিনি ছিলেন তিনি পরিবারের সকল সদস্যের সাথে আলাদা আলাদা ভাবে কথা বললেন। আবার প্রত্যেক সদস্যকে এক সাথে নিয়েও কথা বললেন। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কেও জানলেন। এরপর তারা প্রেসক্রিপশন দিলেন। প্রেসক্রিপশনের প্রথমে লিখলেন : বাবা মা-ই তার মেডিসিন। পযাপ্ত সময় বাচ্চাকে দিতে হবে।  (২) বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের স্কুলে তাকে ভর্তি করতে হবে। (৩) তাকে কাউন্সিলিং করতে হবে। (৪) অকপেশনাল থেরাপিস্টের কাছে নিতে হবে। (৫) সামাজিক পরিবেশগুলো চিনাতে হবে। (৬) পরিবারের সব সময় একটা হাসি-খুশি পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। সাইকোলজিষ্ট পরে আমাকে সুন্দর একটা পরামর্শ দিলেন যার কারণে আমি নাহিনকে নিয়ে এই দূর্গম রাস্তায় হাসি মুখে চলতে পারি। উনি আমাকে বললেন আল্লাহর কাছে বান্দার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস তার চোখের পানি “এই ছেলেটি আপনাকে আল্লাহর কাছে চোখের পানি ফেলার সুযোগ করে দিল। রাতের মধ্য ভাগের শেষে উঠে ওর জন্য আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ফেলবেন যেটা আপনার জন্য উপকার বাচ্চার জন্যও উপকার। তখন আমার অন্তরের মাঝে বেজে উঠল।
“নাহিন আমার আল্লাহর পক্ষ থেকে উপহার” ওকে নিয়ে ফিরলাম রাজশাহী যেটা একটা মফস্বল শহর। এখানে তখন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বাচ্চাদের ভালো কোন স্কুল ছিল না। সুইড বাংলাদেশের একটা স্কুল ছিল সেখানে নাহিনকে ভর্তি করলাম। কিন্তু খুবই স্বল্প জায়গা নিয়ে স্কুল। দিদিমনি খুব ভালো বাচ্চাদের ভালোবাসেন আবার মাদের সাথেও সম্পর্ক তার আন্তরিক। কিন্তু তার সাধ আছে সাধ্য নেই। বাচ্চাটাকে সেখানে রাখলাম আর একটি স্কুল করার চিন্তার মেতে উঠলাম। অটিজম বিষয়ে সেমিনার করলাম সমাজের মানুষদের এই বিষয়টি বুঝানোর চেষ্টা করলাম। তবে সহযোগীতা একটু কমই পেলাম। আমাদের বেশির ভাগ মানুষরে ধারনা। এদের জন্য এত কিছু করে লাভ কি। এর মধ্যে ঢাকার ভালো একটি Special need School এর শাখা রাজশাহীতে খোলা হলো। নাহিনকে সেখানে ভর্তি করলাম। আমার ছেলে God gifted way তেই গান গাইতে পারতো আর ছবি আঁকতে পারতো। স্কুলের সহযোগিতা ও  আমাদের প্রচেষ্টায় সর্বোপরি আল্লাহর কৃপায় আর্ট ও গানে অনেক পারদর্শিতা অর্জন করলো। দৃক গ্যালারীতে আর্ট এক্সিবিশনে তার ছবি গেল। সে ওয়াল ম্যাট তৈরী করা শুরু করলো। তাকে ব্লক বুটিকের কোর্সে ভর্তি করে দিলাম।
এটিএন বাংলায় ছোটদের অনুষ্ঠানে নাহিনকে নিয়ে একটি সেগমেন্ট হলো। নাহিন গান গাইলো। ছবি আকলো কম্পিউটারে সে গ্রাফিক্সের কাজ করলো ওর বাবা ও আমি সেই অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করলাম। এর পর আস্তে আস্তে সে ১৬ বছর পার করলো। আমি এবার খুঁজতে লাগলাম এমন একটা স্কুল যেখানে ওর বয়সী ছেলেদের উপযুক্ত শিক্ষক আছে। পেয়ে গেলাম FWCA প্রয়াস সেন্টারের আনন্দ ধারা স্কুল। বর্তমানে সেখানে সে ভকেশনালের ছাত্র। এরই মাঝে ওকে নিয়ে গেলাম ইন্ডিয়া। সেখানেও একই পরামর্শ ওকে সময় দিতে হবে। সামাজিক ভাবে সব কিছুর সাথে পরিচিত করাতে হবে। ওর যোগ্যতাকে ফুটিয়ে তুলতে হবে। কলকাতার সবচেয়ে বড় স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ইন্দ্রানী বসু উনার সাথে ও যোগাযোগ করলাম একই পরামর্শ। নাহিনকে ছোট বেলা থেকেই আমি সাথে করে সব জায়গাতে নিয়ে যেতাম আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধব প্রতিবেশীদের বাসায়, সভা সেমিনার বিয়ে শাদীর অনুষ্ঠানে যদিও সেখানে তাকে স্থির  রাখতে অনেক কৌশল করতে হতো অনেক ধৈর্য ধরতে হতো। কিন্তু আমি পিছ পা হয়নি একবার দেখলাম আনন্দঘন পরিবেশ গুলোতে খাপ খাওয়াতে পারে। কিন্তু মৃতের বাসায় পরিবেশ সে বুঝে না। ছুটির একটা দিনে ওকে সাথে নিয়ে রিক্সা করে বের হলাম। কবরস্থান দেখলাম। ওকে বুঝালাম আল্লাহ যখন আমাদের ডাক দেয় তখন আমাদের তার কাছে চলে যেতে হয়। আমরা যদি ভাল কাজ করি তবে আল্লাহর বাসায় আমাদের আপেল-আঙ্গুর খেতে দিবেন। এজন্য কাউকে থুথু দেয়া যাবে না। ধাক্কা দেয়া যাবে না। আম্মুর কথা শুনতে হবে। আমার সাথে নামাজ পড়তে হবে।
নাহিনের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন রাজশাহীতে তালি’মুল কুরআন ক্লাশ শুরু হয়। আমি সে কোর্সে অংশগ্রহণ করি। তালি’মুল কুরআন ক্লাশের যে সুরেলা পদ্ধতি সেটা নাহিনের শিক্ষক হওয়ার জন্য আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। সেই সুরে সুরে নামাজের সকল দোয়া ও পাঁচটা সূরা মুখস্ত করিয়েছি। তালি’মুল কুরআনের ছন্দে এবং Art এর ফর্মুলায় নাহিদকে অক্ষর শিখিয়েছি। নাহিন এখন পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পাশ করে সার্টিফিকেট পেয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তার যেন প্রতিদিন যোগাযোগ ঘটে এজন্যে আমি নাহিনের আরবী শিক্ষক, গানের শিক্ষক, পড়াশুনার জন্য শিক্ষক, আর্ট এর শিক্ষক রেখে ছিলাম। স্কুল টাইম বাদে তারা টাইম টু টাইম বাসায় আসতো এবং ওর সাথে সামাজিক যোগাযোগ গড়ে তুলতো। নাহিন এখন মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে পারে। ঈদের জামাতে যায়। সবকিছুর পরিবেশ সে বুঝে এবং স্থির থাকে।
নাহিন আমার সম্পদ, নাহিন আমার স্বপ্ন। ২০০৮ সালে সে আর্টে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার পায়। ২০১৬ সালে C.T.S.B এর পক্ষ থেকে নাহিন আর্টে একটি ক্রেস্ট পেয়েছে। ২০১৭ সালে মিলেনিয়াম গ্রুপের পক্ষ থেকে ভাষা দিবস উপলক্ষে আর্ট কম্পিটিশনে একটি ক্রেস্ট পেয়েছে। নাহিন বাংলাদেশ বেতার  রাজশাহীতে মাঝে মাঝে গান গাই। মহান স্বাধীনতা দিবসে নাহিন রাজশাহীর ঐতিহাসিক ভূবন মহন পার্কে গান গেয়েছে। রাজশাহী শিল্প কলা একাডেমী, মুক্ত মঞ্চ, লালন মঞ্চে নাহিন প্রোগ্রাম করে। সে হামদ্, নাত্, নজরুল সংগীত, রবীন্দ্র সংগীত পল্লীগীতি ও দেশাত্মবোধক গান গাইতে পারে।
নাহিনের এই পথ চলার কাহিনী বলার উদ্দেশ্য হলো নাহিন আর আমার দূর্গম পথের আনন্দময় যাত্রাটি যদি অন্য বাবা-মার পথ চলার ক্ষেত্রে কিছুটা উপকারে আসে।
অটিজম পরিবারের প্রতিটি বাবা-মাকে ধৈর্যের অনুশীলন করতে হবে। এক মাদকাসক্ত সন্তানের বাবা-মার চেয়ে আমরা অনেক ভাল আছি। কখনোই নাহিনেরা মিথ্যা বলবে না, দূনীর্তি করবে না। কাউকে প্রতারণা করবে না। এই পৃথিবীতে অন্ধকার জগতকে তখনোই চিনবে তারা আমাদের নীল রংঙের আলোর পাখি।
লেখক : প্রভাষক - ইংরেজী বিভাগ, ইসলামিয়া ডিগ্রী কলেজ, বিনোদপুর বাজার, মতিহার, রাজশাহী।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ