শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ক্ষপ্ ক্ষুন্ ক্ষাপ্

আবুল হাসান মুহাম্মদ সাদেক : মেয়েটি রোমান্টিক অভিব্যক্তির মুচকি হাসিতে বললো; ‘সোয়াস্দি ক্ষা !’ সে রেশ ধরেই পাশে দাঁড়ানো যুবকটিও বললো ‘সোয়াস্দি ক্ষাপ্’! 

ব্যাংককের ‘মোভেন্পিক’ হোটেলের অভ্যর্থনা কাউন্টারে দাঁড়ানো তারা। এটাই তাদের স্বাগত জানাবার ভাষা ও অভিব্যক্তি। সোয়াস্দি মানে স্বাগত। আর বিনম্র ভদ্রতার নারীসুলভ অভিব্যক্তির প্রকাশ হলো ‘ক্ষা’। এটাকে নারীত্বের আত্মনিবেদনের অভিব্যক্তি বলা যায়। নর হলে শব্দটি হয়ে যায় ‘ক্ষাপ্’। সব ভাষায়ই নারী পুরুষের এ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। পুরুষ হলে বাংলা ভাষায় বলি ‘অধিকারী’, নারী হলে ‘অধিকারিনী’। হিন্দি ভাষায় পুরুষ বলে ‘যাওঙ্গা’, নারী বলে ‘যাওঙ্গী। নর হলে যেনো আওয়াজটি যায় উপরের দিকে, আর নারী হলে নিচের দিকে। সত্যি কি এ পার্থক্যের প্রয়োজন ছিল? সবাইকে একই অবস্থানে রাখলে অসুবিধা কী ছিল?

হঠাৎ জর্ডানের লা মেরিডিয়েন আম্মান হোটেলের অভ্যর্থনা কাউন্টারের মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেলো। মিষ্টি হাসিতে সে বলেছিল, ‘আহ্লান ওয়া সাহ্লান’। তার স্বাগত জানাবার ভাষাটির গভীরতা অনেক বেশি। ‘আহ্ল্’ থেকে ‘আহ্লান’। ‘আহ্ল্’ অর্থ পরিবার। আরবি ব্যাকরণে শুধু ‘আহ্লান’ বলা যায় না। তা তখনি বলা যায়, যখন তার পূর্বে আরো শব্দ থাকে, তা উল্লেখ করা হোক বা উহ্যই থাকুক। ‘আহ্লান’ এর পূর্বে নানা ধরনের স্বাগতমূলক শব্দ কল্পনা করা যায়। যে যা ইচ্ছা কল্পনা করতে পারে। তবে তার সারমর্ম দাঁড়াবে, ‘তোমার নিজ বাড়িতে স্বাগত’, ‘এটা তোমারই বাড়ি’, ‘পরিবার-সদস্যের মতোই তোমাকে স্বাগত’ ইত্যাদি। ‘সাহ্লান’ শব্দটিও তেমনি। ‘সাহ্ল্’ থেকে ‘সাহ্লান’, যার অর্থ সহজ, স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ, আনন্দঘন ইত্যাদি। অর্থাৎ সহজ, স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ও আনন্দঘন অবস্থায় তোমাকে তোমার নিজ বাড়িতে স্বাগত ও অভিনন্দন। এখানে তোমার অবস্থান সহজ ও মধুর হবে। কোন কষ্ট হবে না। 

আমি যখন ছাত্র হিসেবে লেখাপড়া করার জন্য প্রথম আমেরিকা যাই, তখন রেনু ভাই বলেছিলেন, এদেশে অভিভাদনের ভাষা হলো ‘হাই’ বা ‘হ্যালো’। আমি রসিকতা করে বলেছিলাম, আমাদের গাঁয়ের কোন মেয়েকে যদি বলা হয়, ‘ওই ব্যাটা কি তোমার হাই হয়?’ তা হলে তার বারোটা বেজে যাবে। কারণ ‘হাই’ দ্বারা জঘণ্য অশ্লীল কিছুর দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। লিলি আপা বললেন, আমাদের অভিভাবদনই তো আরো সুন্দর। আমরা বলি, ‘আস্সালামু আলাইকুম’। এটা তো গভীর অর্থবহ। এর অর্থ ‘তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক’। ভাবলাম, এখানেও তো কিছু একটা উহ্য আছে মনে হয়। তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, ‘আমার তোমার মধ্যে কোন বৈরিতা নেই, ঘোষণা করছি শান্তির সম্পর্ক’ ইত্যাদি। এ যেনো শুধু অভিভাদন নয়, বরং একের ভেতর অনেক। যিনি এমন পরিভাষার প্রচলন করেছেন তার প্রশংসা করতেই হয়। 

‘মোভেন্পিক’ এর মেয়েটি রেজিস্ট্রেশন শেষ করেই হোটেল কক্ষের চাবি দিয়ে আরেকবার মুচকি হাসিতে বললো, ‘ক্ষপ্ ক্ষুন্ ক্ষা’। পাশের যুবকটি সে রেশ ধরেই বললো, ‘ক্ষপ্ ক্ষুন্ ক্ষাপ্’। ‘ক্ষপ্ ক্ষুন্’ অর্থ ধন্যবাদ। সাথে  নারী ও নরের ‘ক্ষা’ আর ‘ক্ষাপ্’। এ হোটেলে আসার জন্য এভাবেই ধন্যবাদ দিয়ে হোটেল কক্ষের চাবি দিলো। মেয়েটি দেখতে পেয়েছে, আমি থাই বুঝি না। সে ইংরেজি ভাষায় ‘থ্যাংক ইউ’ বলতে পারতো। কিন্তু বলেনি। মাতৃভাষার প্রতি থাইবাসীদের ভালবাসা দেখলে মাথা হেট হয়ে আসে। ব্যাংকক শুধু একটা আন্তর্জাতিক শহরই নয় বরং একটা ব্যতিক্রমী শহর। অবাধ নারী আমেজের আকর্ষণে অগণিত ভ্রমর এখানে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। যার ফলে অগণিত হোটেল আকাশ ছুঁয়ে আছে। পথ ঘাট থাকে ফুলে ফুলারণ্য। তেমনি ঝাঁকে ঝাঁকে মধু আহরণের ভ্রমর। তারা থাই ভাষা জানে না। কিন্তু অবাক হতে হয়, ট্যাক্সীক্যাব বা টুকটুক চালকরা ইংরেজি ব্যবহার করে না বা ইংরেজি জানে না। দোকানেও একই অবস্থা। রেস্টুরেন্টেও তা। যেনো তারা বাধ্য করছে, দু’এটা থাই শব্দ জানতেই হবে। না জানলে গন্তব্যস্থানের ঠিকানা থাই ভাষায় লিখে টেক্সিওয়ালাকে দিতে হবে। রাস্তাঘাটের সাইনবোর্ডগুলোও থাই ভাষায়, দু’একটা ব্যতিক্রম ছাড়া। ভাবছি, এ জাতি মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেয়নি। তবু মাতৃভাষার জন্য এতো ভালবাসা কীভাবে সৃষ্টি হলো !

কালই দেশে ফিরতি ফ্লাইট। আজকের দিনটি বরাদ্দ ংরমযঃ-ংববরহম এর জন্য। চারটি দর্শনীয় স্থান বাকি রয়ে গেছে। আজকের মধ্যে এগুলো দেখার বায়না ধরেছে আনাস। একটা ট্যাক্সিক্যাব ভাড়া করা হলো সারা দিনের জন্য। সায়েন্স সেন্টার ফর এডুকেশনে প্ল্যানেটেরিয়ামের শো দেখা হলো। সৌরজগত ও ছায়াপথের সবকিছুই প্রায় বাস্তবতার মতো করে দেখালো। কিন্তু ধারা বর্ণনা ছিল থাই ভাষায়। তাই গোটা ‘শো’ ধরেই চললো আনাসের প্রশ্ন। ব্যাখ্যা করতে হলো অনেক কিছু। এ ‘শো’ ছাড়াও বিজ্ঞান ভিত্তিক শিক্ষামূলক তিনটি প্রদর্শনী আছে বিশাল, তিনটি মিলনায়তনে, যা বিরাট বিরাট এলাকায় বিস্তৃত। ছোট্টমনিরা এগুলো থেকে খেলা ও আনন্দের ছলে অনেক কিছুই শিখতে পারে। এগুলো না দেখলে বুঝা যায় না, আমাদের দেশেও এমন কিছুর প্রয়োজন কতো বেশি। 

এরপর ছিল ‘সী ওয়ার্ল্ড’-এ ‘সী লাইফ’ দেখার পালা। এটা যেনো বাস্তব সমুদ্র। যেন সাবমেরিনে সমুদ্র তটে গিয়ে সমুদ্রতটের প্রাণীজগত দেখা। অদ্ভুত সে জগত। স্থলভাগের কয়টি প্রাণীর কথাই আমরা জানি? চিড়িয়াখানায় গেলে হয়তো অনেক কিছু দেখা যায়। কিন্তু এ ‘সী ওয়ার্ল্ড’ দেখলে মনে হয়, স্থলভাগের চেয়েও বোশ প্রাণী রয়েছে জলে ও সমুদ্র তটে। ছোট থেকে ছোট আর বড় থেকে বড় কতো প্রাণী, তার ইয়ত্তা নেই। জেলি ফিশ্ ? সে এক অদ্ভূত সৃষ্টি! বেলুনের মতো ফুলে, আবার বুদবুদের মতো সংকুচিত হয়ে যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা যায় অপলক নেত্রে। অগণিত জলপ্রাণীর এটি মাত্র একটি। এক একটির প্রতি তীক্ষè পর্যবেক্ষণ করতে গেলে কতো দীর্ঘ সময় লাগতে পারে, সে হিসাব কষতেও হয়তো কয়েকদিন লেগে যাবে। কোরিয়ার সেজু দ্বীপের সাবমেরিনে সমুদ্র তটে যা দেখেছি, তারও অনেক বেশি আছে এখানে। 

মানব জীবন ক্ষণিকের। করণীয় কাজ সীমাহীন। সবকিছুতেই সে হিসাব মিলাতে হয়। এ হিসাব ভুলে গেলে জীবনটাই হয় মিছে। তাই বরাদ্দ সময়ে সমুদ্র তটের জগৎ দেখতেও ছুটতে হলো এদিক থেকে ওদিক। ওদিক থেকে সেদিক। বরাদ্দ সময়ের চেয়ে বেশি লেগেই গেলো। 

বেরিয়ে এলাম। দৌড়ে গেলাম সে স্থানে যেখানে ট্যাক্সী ড্রাইভার অপেক্ষা করার কথা। কিন্তু তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। ভাবলাম, হয়তো সে ওয়াশ রুম বা কোন জরুরী কাজে কোথাও যেতে পারে। কিন্তু সে ফিরে এলো না। গোটা এলাকা ঘুরে দেখলাম কয়েকবার। পেলাম না। তথ্য কেন্দ্রে খোঁজ নিলাম, কোন খবর আছে কি না। কিন্তু না, নেই। তার গাড়ি পার্ক করা হয়েছে বেইসমেন্টে, বেশ দূরে। খুঁজতে গেলাম সেখানে। সেখানেও তার গাড়ি নেই। আবার ফিরে এলাম, যেখানে তার অপেক্ষা করার কথা ছিল। কিন্তু কোথাও নেই। 

আমার বউ সালেহা। বউ বললাম, কারণ বউ কথাটিতে সে খুশি হয়। ডাক নাম খুকী। সে ট্যাক্সী ড্রাইভারের অপেক্ষার স্থানে ফ্লোরে বসে পড়লো। বললো, তাকে অর্ধেক দিন খাটিয়েছি। পয়সা দেওয়া হয়নি। তার অবশ্যি কোন অসুবিধা বা বিপদ হয়ে থাকবে। তাকে রেখে যাওয়া যায় না। সুতরাং আরো অপেক্ষা করলাম বহুক্ষণ। কিন্তু সে এলো না। সবাই বললো, আর অপেক্ষা করে লাভ নেই। হঠাৎ মনে হলো, সে একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়েছিল। কিন্তু আমাদের নিকট তো থাই সিম কার্ড বা থাই ফোন নেই। তথ্য কেন্দ্র থেকে বললো, সর্বোচ্চ ফ্লোরে গেলে পয়সা দিয়ে ফোনের ব্যবস্থা আছে। সেখানে গেলাম গিয়েও তেমন কোন ব্যবস্থা পেলাম না। কাজেই সেখানে একজনকে অনুরোধ করলাম, অর্থের বিনিময়ে তার ফোন ব্যবহার করা যায় কি না। সে অর্থ ছাড়াই কয়েকবার ফোন করলো। ফোনে ড্রাইভারকে পাওয়া গেলো না। কতক্ষণ পরপর আরো দু’জনকে এভাবে অনুরোধ করে চেষ্টা করলাম। লাভ হলো না। ফোনেও ড্রাইভারকে পেলাম না।

সময় গড়িয়ে গেলো অনেক। আর কোন দর্শনীয় স্থান দেখার সময় নেই। সুতরাং একটা ট্যাক্সী নিয়ে সোজা চলে গেলাম হোটেলে। হোটেল থেকেও কয়েকবার চেষ্টা করলাম। সারাদিনের জন্য ট্যাক্সী ড্রাইভারের যে ভাড়া ছিল, একেকটা টেলিফোনে হোটেল কর্তৃপক্ষ তার প্রায় ৪% চার্জ করলো। কিন্তু একজন মানুষ বিপদ ছাড়া তার পাওনা রেখে চলে যেতে পারে না। বিপদের খবর নেওয়া উচিত, এবং তার পাওনা তো দেওয়া হয়নি। তাই এতো চেষ্টা। শেষ পর্যন্ত সে ফোন ধরলো রাত সাড়ে দশটায়। বললো, অনিবার্য কারণে তাকে চলে যেতে হয়েছে। ভাঙা ভাঙা ভাষায় আরো বললো, তুমি কি ক্ষমা করবে? তোমার সব পরিকল্পনাই তো নষ্ট করে দিলাম। 

সকালে তার ট্যাক্সী দিয়েই এয়ারপোর্টে গেলাম। বিমান বন্দরে নামিয়ে দিয়ে সে বললো, আমি পয়সা নেবো না। এটাই আমার অপরাধের কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত। আমি গতকালের ভাড়াসহ আজকের ভাড়াও তার হাতে গুঁজে দিলাম। সে ফ্যাল ফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো। আবেগে যেনো  ভিজে উঠলো তার চোখের দু’টি পাতা। 

বিস্মিত হয়ে মৃদুকণ্ঠে তার মুখ থেকে শুধু বেরিয়ে এলো, ক্ষপ্ ক্ষুন্ ক্ষাপ্ ...। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ