শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

স্বাগতম ১৪২৪ সন

ড. এম এ সবুর : স্বাগতম ১৪২৪ সন। নববর্ষ উদযাপন একটি ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। তবে কবে থেকে নববর্ষ বা বর্ষ গণনা শুরু হয়েছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। মানব সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ রাত দিন গণনা শুরু করেছিল সূর্য উদয়-অস্তের ভিত্তিতে। কিন্তু তারা মাস গণনা শুরু করেছিল চাঁদের ভিত্তিতে। অর্থাৎ মানুষ চাঁদের বৃদ্ধি-হ্রাস দেখে মাস গণনা করতো। তারা এক শুক্ল পক্ষ থেকে অন্য শুক্ল পক্ষ কিংবা এক কৃষ্ণপক্ষ থেকে অন্য কৃষ্ণপক্ষ পর্যন্ত সময়কে একমাস ধরে মাস গণনা করতো। এভাবে ১২ চান্দ্র মাসে এক বছর গণনা করা হতো। পরবর্তীতে সৌর বছর দিয়ে বর্ষ গণনা করা হয়। তাই বর্ষ গণনার ভিত্তি এক নয়। কেউ গণনা করে চন্দ্রের ভিত্তিতে কেউ আবার সূর্যের ভিত্তিতে। প্রত্যেক জাতি- দেশের বছর গণনা শুরু হয়েছে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে। আর বর্ষ গণনার ভিত্তি অনুযায়ী বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। যেমন ইরানের নববর্ষ ‘নওরোজ’ পালিত হয় বসন্তের পূর্ণিমায়। অন্যদিকে জুলিয়ান ক্যালে-ার অনুযায়ী ১লা জানুয়ারিতে ঐধঢ়ঢ়ু ঘবি ণবধৎ উদযাপিত হয়। গ্রীষ্মের শুরুতে অর্থাৎ ১লা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয়। আর মুহররমের ১লা তারিখে হিজরি নববর্ষ পালিত হয়। সব জাতির বর্ষ গণনা যেমন এক নয় তেমনি সব জাতির নববর্ষের উৎসবও অভিন্ন নয়। প্রত্যেক জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতির ভিত্তিতে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। বাংলা নববর্ষ উৎসবও পালিত হওয়া উচিৎ বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিতে। কৃষি নির্ভর বাঙালি জাতির নববর্ষ উদযাপন দরকার কৃষি সংস্কৃতির ভিত্তিতে। 

নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস অনেক পুরনো। প্রায় ৫ হাজার বছর আগে পারস্যে ১১ দিন ব্যাপী নববর্ষ উৎসব ‘নওরোজ’ পালিত হতো। ব্যবিলনে নববর্ষ উৎসব উদযাপিত হতো প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বছর আগেও। প্রায় একই সময়ে রোমনরা ব্যাবিলনীয়দের নিকট থেকে বসন্তকালের নববর্ষ উদযাপন শিখেছিল। যিশু খ্রিস্ট জন্মের অনেক আগ থেকেই ইহুদিরা নববর্ষ উৎসব ‘রাশ হুশনা’ পালন করতো। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে  গ্রেগ্রিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১লা জানুয়ারি ঐধঢ়ঢ়ু ঘবি ণবধৎ পালিত হয়ে আসছে অনেক দিন থেকে। হিজরি নববর্ষ উৎসবের কোন আড়ম্ভরতা না থাকলেও আরবসহ গোটা মুসলিম বিশ্বে প্রায় শুরু থেকেই এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে বাংলা নববর্ষ ‘পয়লা বৈশাখ’ কয়েক শতক ধরে উদযাপিত হচ্ছে। উৎসবমুখর পরিবেশে নববর্ষ উদযাপনের জন্য সরকারি বেসরকারি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বিভিন্ন সংগঠন-সংস্থা নানা কর্মসূচি গ্রহণ করছে। ‘বৈশাখী মেলা’ এ উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ হয়েছে। আগের দিনে নববর্ষ উপলক্ষে আমানি, রাজপূণ্যাহ, হালখাতা, গাজনের গান ইত্যাদি গ্রামীণ অনুষ্ঠান মাস জুরে চলেছে। 

বাংলা সনের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। তাই বাংলা নববর্ষ উৎসবের সংস্কৃতিও খুব পুরনো নয়। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন যুগে তো নয়ই এমনকি মধ্যযুগেও (১২০১-১৮০০ খ্রি.) বাংলা নববর্ষভিত্তিক কোন সাহিত্য নাই। আধুনিক যুগের প্রথম শতকের (১৮০১-১৯০০ খি.) সাহিত্যেও বাংলা নববর্ষভিত্তিক কোন রচনা পাওয়া যায় না। বিশ শতকের প্রথমার্ধেও নববর্ষ বাংলা সাহিত্যে তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে নাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা-গানে ‘বৈশাখ’ ‘পূণ্যাহ’ বিষয় থাকলেও বাংলা ‘বর্ষবরণ’ বা নববর্ষ উৎসবের বিষয় নাই। একইভাবে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে পারস্যের ‘নওরোজ’ অনুষ্ঠানের উল্লেখ থাকলেও বাংলা নববর্ষ বা ‘বর্ষবরণ’ উদযাপনের বিষয় নাই। অবশ্য তখন যে নববর্ষ বা বর্ষবরণ ছিল না বিষয়টি তেমন না। তবে তৎকালে বর্ষবরণ বা নববর্ষ উদযাপন ছিল অনাড়ম্ভরপূর্ণ ও জৌলুসহীন। ঘরোয়া পরিবেশে পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেই নতুন বছরের প্রথম দিনে ভালো খাবার আয়োজন-আপ্যায়ন এবং নতুন পোশাক পড়ার বর্ষবরণ বা নববর্ষ উদযাপন সীমাবদ্ধ ছিল। বর্তমানের মতো এতো জমকালো অনুষ্ঠান তৎকালে ছিল না। মিষ্টান্ন বা মিঠা জাতীয় দ্রব্য দিয়ে ‘মিঠামুখ’ করানো এবং অপেক্ষাকৃত ভালো খাবারের আয়োজন করা হতো ‘বর্ষবরণ’ বা নববর্ষ দিনে। তৎকালীন বাঙালি সমাজে প্রচলিত ধারণা ছিল বছরের শুরুর দিনে ‘মিঠামুখ’ করলে সারা বছর মুখ মিঠা থাকবে এবং এদিন ভালো খাবার খেলে সারা বছর অনুরূপভাবে ভালো খাবার খাওয়া যাবে। কুসংস্কার হলেও বাঙালিরা এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে ‘নববর্ষ’ দিনে অপেক্ষাকৃত ভালো খাবারের আয়োজন ও ভালো পোশাক পরিধান করতো। কালের পরিক্রমায় বছরের প্রথম দিনে ভালো খাবারের আয়োজন-আপ্যায়ন, নতুন পোশাক পড়া, হিন্দুদের পূজা-অর্চনা, মুসলমানদের মিলাদ-মাহফিল-দোয়া অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ ‘বর্ষবরণ’ উদযাপনের উৎপত্তি ঘটে। আর ইংরেজ শাসন অবসানের পর কালক্রমে নববর্ষ উদযাপন উৎসবে পরিণত হয়েছে। ১৩৭২ সনে (১৯৬৫ খ্রি.) রমনা বটমূলে ছায়ানট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মাধ্যমে নববর্ষ বরণ উৎসব শুরু করে। পরবর্তীতে বর্ষ বরণের এ উৎসব প্রাণবন্ত ও বিস্তৃত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে রমনা পার্কে কয়েক জন সাংবাদিকের আড্ডাচ্ছলে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার বিষয়টি বর্তমানের নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হয়েছে। আর ১৯৮৬ সালে যশোরের উদিচি উদ্ভাবিত ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট ১৯৮৯ সাল থেকে অব্যাহত রেখেছে এবং ক্রমান্বয়ে এর ব্যাপ্তিও  বেড়েছে। অতি সম্প্রতি নববর্ষ উৎসবে সারা দেশে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ করার জন্য সরকারি নির্দেশ জারি হয়েছে! 

অতীত ও বর্তমানের নববর্ষ উৎসব বা বর্ষবরণের পার্থক্য সুস্পষ্ট। বিশ্বায়নের ফলে আধুনিক যুগের বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মনোহরি চাকচিক্য বাড়লেও আন্তরিকতার অভাব যথেষ্ট। বর্তমানে নববর্ষ উদযাপনে পান্তাভাত ও ইলিশ ভাজাসহ মুখরোচক অনেক খাবারের সমারোহ ঘটালেও এতে প্রাণের স্পর্শ পাওয়া যায় না। এতে ধনী ও বিলাসী মানুুষের বিনোদনের ব্যবস্থা হলেও দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের অন্তরে সুখ আসে না। আধুনিক যুগের শহুরে মানুষদের প্রাণহীন জমকালো বর্ষবরণের কৃত্রিমতায় নিবিড় পল্লীর প্রীতিপূর্ণ ছোট ছোট উৎসব ঢাকা পরে যায়। অধিকন্তু শিল্পপতি, বড় চাকুরিজীবী ও টাকাওয়ালাদের উৎসবের তা-বতায় বাঙালি কৃষকদের নববর্ষ উৎসব পিষ্ট হয়। অথচ বাংলা নববর্ষের সূচনাই হয়েছে বাঙালি কৃষকের সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে। নির্দিষ্ট সময়ে কৃষকের কাছ থেকে জমিদারের খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বাংলা সনের প্রবর্তন করা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলা নববর্ষের মূলে কৃষক ও কৃষি। তাই বাংলা নববর্ষ উৎসব সব বাঙালির হলেও আমেজটা কৃষকের একটু বেশি। 

মুসলিম ঐতিহ্যের হিজরি সনকে ভিত্তি করেই বাংলা সনের উৎপত্তি হয়েছে। মুঘল সম্রাট আকবর বাংলার কৃষকদের সুুুবিধার্থে এবং তার সিংহাসন আরোহনের বছরকে স্মরণীয় রাখতে সভাজ্যোতিষী আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজীর (দৈবে দশমরতœ) পরামর্শে হিজরি ৯৬৩ সনকে বাংলা ৯৬৩ সন ধরে বাংলা সন গণনার নির্দেশ দেন। অধিকন্তু পারস্যের (ইরানের) নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠান ‘নওরোজ’ এর আদলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সূচনাও করেন। তার আনুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হতো। ‘নওরোজ’ অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ‘মিনা বাজার’। আর এ মিনা বাজারের আদলে বাংলা নববর্ষ উৎসবে যোগ হয়েছে ‘বৈশাখী মেলার’। উৎপত্তিগত দিক দিয়ে বাংলা সনের সাথে যেমন মুসলিম ঐতিহ্য জড়িত তেমনি নববর্ষ উৎসবের সাথেও পারসিয়ান মুসলিম সংস্কৃতি জড়িত। মুসলিম ঐতিহ্যের ভিত্তিতে বাংলা নববর্ষ চালু হলেও মুসলমানদের উদারতার কারণে তা সার্বজনীন অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু বাঙালি মুসলিম সমাজের অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতা, সংস্কৃতিবিমুখতার কারণে মুসলিম ঐতিহ্যম-িত বাংলা নববর্ষ উৎসব বিজাতীয় সংস্কৃতিতে ঢাকা পড়েছে। অধিকন্তু মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের  মোড়কে সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি ও আমাদের দেশের ‘এলিট শ্রেণী’ খ্যাত কিছু অর্ধবাঙালি বাংলা নববর্ষ উদযাপনে ঐধঢ়ঢ়ু ঘবি ণবধৎ এর আদলে হোটেল-পার্কে জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। যা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে দুর্বল ও অপদস্ত করছে। তাই নববর্ষ উদযাপনকে সা¤্রাজ্যবাদ-বিশ্বায়নের বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত করতে নতুন প্রজন্মকে শেকড় সন্ধানী হতে হবে। আর আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়িয়ে ধরতে হবে। তাহলেই বাংলা নববর্ষ উদযাপন সার্থক হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ