বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মঙ্গল যাত্রায় অমঙ্গলের ধ্বনি

হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত বঙ্গীয় শব্দকোষ অভিধানে ‘মঙ্গল’ শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ‘যথাবিধি মঙ্গলাচরণ পূর্বক বরণ করা বা পূঁজা করা। জলধারা দিয়া মঙ্গল হাঁড়ি প্রদক্ষিণ করা, গোঁসাই পিথিবি মঙ্গলিল।’ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বোঝানো হচ্ছে ‘মঙ্গল’ শব্দটি মূলত পূঁজা-অর্চনার সাথে যুক্ত, তা মঙ্গল ঘটই হোক বা মঙ্গল শোভাযাত্রাই হোক। দেবতাগণের প্রতি ভক্তি বা প্রণতি প্রকাশের উদ্দেশ্যে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা। এর সবগুলোই পূঁজা সম্পর্কিত। বিশেষ করে হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মে পূঁজা একটি প্রধান অনুষঙ্গ। দেখা যায়, এই পূঁজা-পার্বনের সাথেই ‘মঙ্গল’ শব্দটি ওঁতপ্রোতোভাবে জড়িত। এ ধারাবাহিকতায়ই মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মঙ্গল কাব্য নামে একটি নবধারার উদ্ভব হয়েছিল। দেবতাগণের মাহাত্ম্য কীর্তনই ছিল এ কাব্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। যেমন মনসা মঙ্গল, কলিকা মঙ্গল, চ-ী মঙ্গল, ধর্ম মঙ্গল, অন্নদা মঙ্গল, কাব্যগুলোর শিরোনাম পাঠেই বুঝতে অসুবিধা হয় না এদের বিষয়বস্তু ধার- প্রকৃতি কোন্ মঙ্গলকে আবাহন করতে উচ্চকণ্ঠ। 

ধ্যান-ধারণায় পার্থক্য থাকতেই পারে। পৃথিবীর সব মানুষ এক রকম ভাবে না, আচার-বিচারেও বেমিল স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক কেবল সব অনুভবকে একাকার করার চেষ্টা। ইদানীং বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে এমন অতিকথন এবং এমন উদ্ভট আচরণ শ্রবণ এবং দৃষ্টিকে জ্বালাতন করছে অহরহ। লেখালেখি হচ্ছে, ঘোষণা হচ্ছে বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি। হাজার বছর কেন শত বছরের ইতিহাসেও এমন জন্তু-জানোয়ার সেজে নর্তন-কুর্দনের আলামত পাওয়া দুষ্কর। তবে পহেলা বৈশাখে নতুন হালখাতা খুলতো ব্যবসায়ীগণ। পুরানো বছরের হিসাব চুকিয়ে নতুন হিসাবে ঢুকতো তারা। এ উপলক্ষে সম্প্রদায় ভেদে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। মিঠাই মণ্ডা বিলি হতো। কোনো দোকানে গনেশ পূঁজা, কোনো দোকানে মিলাদ-দোয়া। এর সবগুলোই হতো হৃদ্যতার সাথে। মেলা-বান্নি বসতো গ্রামের কোনো বড় বটগাছ তলায়। সে মেলায় যোগ দিতো মুসলিম-হিন্দু উভয় সম্প্রদায়। অতীতে বাংলা বর্ষবরণের উৎসবটা ছিল এমনটাই। ভালো-মন্দ খাবারের রেওয়াজটাও ছিল কমবেশি সামর্থ্য অনুপাতে। বাঙালি সংস্কৃতি বা সর্বজনীন সংস্কৃতি এমন কোনো ঘোষণা উচ্চারিত হতো না তখন। কারণ উভয় সম্প্রদায় একটা নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতো। অনুপ্রবেশ ঘটা বা ঘটানোর চেষ্টা করতো না কেউই। একে অপরের আচার-বিচারকে মান্য করতো। বিশেষভাবে গ্রামীণ সমাজে।

বাংলা সন আদতে কৃষির সাথে সম্পর্কিত। কৃষকের দুঃখ আনন্দকেই ধারণ করে বৈশাখ থেকে চৈত্র। তাই বাংলা নববর্ষের উপায়-উপকরণ আয়োজন যতদিন ওদের অনুভবে যুক্ত ছিল ততদিন ছিল মধুময়-হাস্যোজ্জ্বল। বর্ষ শুরুতে আনন্দের হিল্লোল বইতো গ্রামীণ সমাজে। এছাড়া চৈত্রের শেষদিনে পালিত হতো চৈত্রসংক্রান্তি, বাঙালি হিন্দুসম্প্রদায়ে। যা তাদের ধর্মীয় পালা-পার্বণ অন্তর্ভুক্ত। এদিনটিতেও উৎসব করতো তারা। বান্নিমেলারও আয়োজন হতো। বালক বয়সে এসব দেখেছি গ্রামে। কিন্তু যখনই শহুরে শিক্ষিত সমাজ কুবুদ্ধিসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীগণ এই আয়োজনে নাকগলাতে গেলো তখনি নেমে এলো সর্বনাশ। রাজনীতির ঘোরে জড়িয়ে পড়লো বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। নব্যধনীরা একদিনের বাঙালি সাজার রেওয়াজ চালু করলো। পান্তা-ইলিশের নামে গ্রামের কৃষকদের প্রতি করলো ব্যাঙ্গ-বিদ্রƒপ। হাজার বছরের সংস্কৃতির নাম করে এই শ্রেণির কুবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষগুলো ইতিহাস-ভূগোল পাঠদানে ব্যস্ত হয়ে পড়লো যা কিনা মোটেও ইতিহাসসিদ্ধ নয়, এক দেশদর্শি চিন্তাচেতনা মাত্র। তাই গ্রামীণ সমাজের বৈশাখী অনুষ্ঠান আর নাগরিক সমাজের বৈশাখী অনুষ্ঠানে ব্যাপক পার্থক্য ধরা পড়ে। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে এবং মঙ্গল শোভাযাত্রা দিয়ে যে বর্ষবরণের সূচনা হয় তা বাঙালি হিন্দু সমাজে স্বাভাবিক হলেও বাঙালি মুসলিম সমাজ বা সংস্কৃতিতে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ মঙ্গল বা মাঙ্গলিক ভাবনাটিই বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় চিন্তার অংশ।  কুবুদ্ধিজাড়িত একশ্রেণির বুদ্ধিমানরা যাকে বলতে চাচ্ছে ‘সর্বজনীন’ অনুষ্ঠান বা সংস্কৃতি। আসলে সংস্কারের মনোভঙ্গিটি আসে যার যার ধর্মীয় বিশ্বাসকে স্পর্শ করে। এক সম্প্রদায় যাকে স্বাভাবিক বলে মান্য করে অন্য সম্প্রদায় তাকে মান্য নাও করতে পারে। এতে তো দোষের কিছু থাকতে পারে না। এখানে রাগগোস্যার কি আছে। তবে গোস্যার উদ্রেক হয় তখনি যখন দেখা যায় জোর-জবরদস্তি করে সংস্কৃতি গিলানোর চেষ্টা চলে। ইতিহাস, ভূগোল শিখানোর উসিলায় বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোশেশ হয়।

জন্তু-জানোয়ার বা পেঁচা বা হাঁস-মুরগির আদলে নিজেদের সাজানোর মধ্যে একটা অন্যরকম আনন্দ থাকতেও পারে। যে জন্য মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম করে বাংলা নববর্ষকে উদযাপন করার ব্যবস্থা হয়, বেশ ক’বছর থেকে। যাত্রা শুভ হোক বা অশুভই হোক তাতে কারোর কোনো আপত্তি বা নারাজী থাকার বিষয় নয়। আসলে আপত্তি বা নারাজীটা হলো অন্যত্র। প্রতিবেশী সমাজের একটি ধর্মীয় আচার-আচরণকে ‘সার্বজনীন’ সংস্কৃতি বলা বা ঘোষণায়। প্রথমতো ‘মঙ্গল’ শব্দটি বাঙালি হিন্দু সমাজের ধর্মীয় অনুভবকে উচ্চকিত করে। দ্বিতীয়ত এই শোভাযাত্রায় যেসব পশুপাখি বা জন্তু-জানোয়ার বহন করা হয় বা মুখোশ লটকানো হয় তার অধিকাংশই পৌরানিক কাব্য-কাহিনীকেই তুলে আনে। যা বাঙালি মুসলিমদের চিন্তা-চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক। এই বিভ্রান্তিকর ‘শোভা’যাত্রাকে সম্প্রদায়গত মেলবন্ধনের উসিলা ভাবাটা সুখকর বা শোভনও নয়। অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠান এমন উদ্ভট চিন্তায় ‘দুরবুদ্ধি’র গন্ধ উৎকটভাবেই ছড়িয়ে পড়ছে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মঙ্গল’ শব্দের যে অর্থ তুলে এনেছেন তার অভিধানে তাতে মঙ্গল শোভাযাত্রার ব্যাখ্যা দাঁড়ায় পূঁজা-অর্চনার জন্য যে যাত্রা তাকেই বলতে হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। যে যাত্রার লক্ষ্যই হলো পূঁজা বা প্রণতি তাও আবার দেব-দেবীদের উদ্দেশে, এহেন অনুষ্ঠানকে অসাম্প্রদায়িক বা সর্বজনীন বলাটা দুরভিসন্ধিমূলক বা মূর্খতাকেই প্রকাশ করে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ