শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর আরশে আযীম সফর

মাওলানা এ এইচ এম আবুল কালাম আযাদ : মিরাজ শব্দের অর্থ হল উর্ধ্বগমন। শবে মিরাজ মানে উর্ধ্বগমনের রাত। শব শব্দটি ফারসি যার অর্থ রাত। আরবীতে বলা হয় লাইলাতুল মিরাজ। রাসুল (সা.) এর জীবনের অন্যতম মুজেজা হল মিরাজ। দুনিয়ার সব নবী রাসুলকে আল্লাহ তায়ালা এমন কিছু অলৌকিক শক্তি ও বিশেষত্ব দিয়েছেন- যাতে তারা প্রচার কাজে সাহস সঞ্চার করেন এবং বিরুদ্ধবাদীরা দুর্বল হয়ে পড়ে। আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে যে কয়টি বিশেষত্ব ও অলৌকিকত্ব দিয়েছেন তন্মধ্যে মিরাজ একটি। মাক্কী জীবনে বিরুদ্ধবাদীদের হাতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) যখন দারুনভাবে বিপর্যস্ত, মুরুব্বী ও পরম আত্মীয়দের মধ্যে যখন চাচা আবু তালিব ইন্তিকাল করলেন, এবং এর কিছু দিনের মধ্যেই যখন তার প্রিয় জীবন সঙ্গিনী প্রথমা স্ত্রী খাদিজা (রা.) দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন, নবীজী (সা.) এর মন-প্রাণ যখন চিন্তাগ্রস্ত ও বিষাদময় হয়ে উঠছিল ঠিক তখনই ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে তাকে মহামহিম প্রভু সমুদয় কুদরতের আধার আল্লাহ তায়ালা আপন আরশ-কুরসি ভ্রমণে নিয়ে যান। ইতিহাসে সে ঘটনাই হলো মিরাজ।
রজব মাসের ২৭ তারিখ এক কৃষ্ণপক্ষের রাত। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এশার নামাজ সম্পন্ন করে হযরত উম্মে হানীর ঘরে নিদ্রায় মগ্ন। মক্কা নগরীর সবাই এমনকি পশু পাখিরাও যখন ঘুমের কোলে ঢলে পড়েছে, এমনই এক শান্ত শীতল মধুময় সময়ে হযরত জিব্রাইল (আ.) হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর শিয়রে হাজির হলেন। হাজির হয়ে শুভবার্তা জানালেন, হে আল্লাহর প্রিয় হাবীব (সা.)! আপনি জাগ্রত হোন এবং উঠে পড়ুন। আল্লাহ পাকের তরফ থেকে আপনার জন্য দ্রুতগামি বাহন বিদ্যুতের চেয়ে অধিক শক্তিমান বাহন নিয়ে এসেছি। আপনাকে সাদর সম্ভাষণ জানানোর জন্য সব ফেরেশেতা ও পূর্ববর্তী নবীগণ (আ.) অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। হযরত জিব্রাইল (আ.) এর এমন সুমধুর ডাক শুনে মহানবী (সা.) উঠে পড়েন এবং হাউজে কাউসারের পানি নিয়ে অজু করে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন।
শরহে ছদর বা সিনা চাক : তারপর হযরত জিব্রাইল (আ.) নবী (সা.) কে মহান আল্লাহর আনোয়ার  ও বরকতে তাজ্জাল্লী দ্বারা মহিমান্বিত করার উদ্দেশ্যে খানায়ে কাবার কাছে তার শরহে ছদর বা সিনা চাক করলেন এবং তার কলব মোবারক বের করে উহাকে যমযমের পানি দ্বারা তিনবার করে ধৌত করলেন। তারপর উহাতে মহান  আল্লাহর আনোয়ার ও বরকত এবং হেকমত ও ইলেম দ্বারা পরিপূর্ণ করে আবার তার সিনার মধ্যে রেখে দিয়ে উহা যেমনি ছিল তেমনিভাবে মিলায়ে দিলেন। তাতে করে মহানবী (সা.) এর সিনা মোবারক আল্লাহর নূর ও তাজ্জাল্লাী দ্বারা চন্দ্র সূর্য থেকেও বেশী উজ্জল ও রওশন হয়ে গেল এবং বিভিন্ন প্রকার হেকমত ও জ্ঞানে ভরপুর হয়ে গেল। যেমন মহান আল্লাহ সূরা আল ইনশেরাহ এর মধ্যে ইরশাদ করেন,  আমি কি আপনার শরহে ছদর করিনি? অর্থাৎ আপনার বক্ষকে আমার নূর ও তাজ্জাল্লী দ্বারা ভরপুর করিনি?
বোরাক : হযরত জিব্রাইল (আ.) হুজুর (সা.)  এর সিনা চাক বা শরহে ছদর করার পর হুজুর (সা.) কে নিয়ে পবিত্র হাতিমে কাবার বাইরে আসলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন যে, আমি খানায়ে কাবার আঙ্গিনায় একটি বাহন দন্ডায়মান অবস্থায় দেখতে পাই। যার শারীরিক গঠন কৌশল ছিল গাধা থেকে বড় এবং খচ্চর থেকে ছোট-মধ্যবর্তী সুন্দর ও আযীব প্রাণী। যার কপালে লেখাছিল “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ”। এ পবিত্র বাহনটি ছিল বেহেশত থেকে আনিত একটি আযীব জন্তু। যার সর্বাঙ্গ ছিল বেহেশতী অলংকারে সুসজ্জিত। তার কাঁধে ছিল হীরা মুক্তা জড়ানো। যার নয়ন যুগল ছিল কাল বর্ণের খুব বড় বড় সুরমাদার  চক্ষু বিশিষ্ট। তার বাজুতে ছিল মণিমুক্তা দ্বারা রঞ্জিত দুটি পাখা। আর পাখাগুলোর প্রতিটি পালকে বিভিন্ন রংযুক্ত “আল্লাহু আকবার” লেখা। তার গতি ছিল বিদ্যুৎগতি সম্পন্ন। হুজুর (সা.) এর নজর যতদূর বিস্তৃত ছিল- তার এক কদম থেকে অন্য কদমের দুরত্ব ছিল ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এমনিভাবের এক সৌন্দর্যমন্ডিত জন্তু নিয়ে হযরত জিব্রাইল (আ.) হুজুর (সা.) এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বললেন হে আল্লাহর নবী (সা.)! এ বোরাককে আপনি আপনার সওয়ারী হিসেবে কবুল করুন এবং আপনার সওয়ারী হিসেবে তার উপর আপনি উপবিষ্ট হউন।
ইসরা : রাসুল (সা.) বোরাকের উপর আরোহণ করলে জিব্রাইল (আ.) বোরাককে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার জন্য ইঙ্গিত করলেন। হাজার হাজার স্বর্গীয় ফেরেশতার পরিবেষ্টনে বোরাক ছুটে চলল। ক্ষণকাল পরে বিদ্যুৎ বেগে বোরাক এসে নামল প্যালেস্টাইন শহরের বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদ প্রাঙ্গণে। তাফসীরবীদগণ নবীজী (সা.) এর মিরাজ গমনকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। কাবা শরীফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত অংশকে ইসরা বা রাতের সফর এবং উর্ধ্বাকাশে আরোহণকে মিরাজ বলেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, সেই মহান প্রভু বড়ই পবিত্র। যিনি স্বীয় বান্দা মুহাম্মদ (সা.) কে একই রাতে মসজিদে হারাম হতে মসজিদে আকসা বায়তুল মাকদাস পর্যন্ত ভ্রমণ করায়েছেন। আর এ মিরাজ বা উর্ধ্বগমনের উদ্দেশ্য হল আমি তাকে আমার কুদরতে কামেলার আশ্চর্য নিদর্শন সমূহ অবলোকন করানো। নিশ্চয়ই মহান প্রভু সর্বশ্রোতা ও সব কিছু দেখেন  ও জানেন। (সূরা বানী ইসরাইল -১)
ইমামুল মুরসালিন উপাধী : হুজুর (সা.) ইরশাদ করেন, মিরাজ রজনীতে যখন আমার বোরাক মসজিদে আকসার একেবারে নিকটে পৌছে গেলো, তখন হযরত জিব্রাইল (আ.) এর ইঙ্গিতে বোরাক থেমে গেলো আমি বোরাক থেকে অবতরণ করলাম। অতঃপর জিব্রাইল (আ.) বোরাককে একটি পাথরের সাথে বেধে আমাকে সাথে নিয়ে মসজিদে আকসার মধ্যে প্রবেশ করলেন। আমি তথায় দেখতে পেলাম অনেক সুন্দর চেহারার বুযুর্গ ব্যক্তিগণ তথায় উপবিষ্ট আছেন। আমি হযরত জিব্রাইল (আ.) কে জিজ্ঞেস করলাম, হে ভাই জিব্রাইল! এই সুন্দর চেহারার লোকগুলি কারা? উত্তরে জিব্রাইল (আ.) বললেন এরা হচ্ছে আপনার পূর্ববর্তী নবীগণ (আ.)।
অতঃপর হুযুর (সা.) পূর্ববর্তী নবীগণের সাথে সাক্ষাত ও সালাম বিনিময় করলেন। সাক্ষাত ও সালাম বিনিময় শেষ হওয়ার পরে হযরত জিব্রাইল (আ.) “ছাখরাতু বাইতুল মুকাদ্দাস” নামক এক বিশেষ ধরণের পাথরের উপর দাড়িয়ে আযান দিলেন। তখন উক্ত  আযানের আওয়াজের সাথে সাথে আসমানের দরজা খুলে গেলো, আর অগনিত ফেরেশতা অবতরণ করতে লাগলো। এমনকি সমস্ত মসজিদে আকসা এবং মসজিদে আকসার সম্মুখস্থ সমস্ত মাঠ, সমস্ত খালি জায়গা আসমান থেকে যমীন পর্যন্ত ফেরেশতা আর ফেরেশতা দ্বারাই ভরপুর হয়ে গেল। তারপর বিরাট একটা জামাআতের আয়োজন হিসেবে কাতার বন্দী হওয়া শুরু হয়ে গেলো। সমস্ত নবী-রাসুল এবং সমস্ত মালায়েকায়ে মোকাররাবীন নিজ নিজ কাতার সোজা করে কিবলার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে গেল।
এমন সময় এ আযীমুশশান জামাআতের জন্য ইকামত বলা আরম্ভ হয়ে গেলো। অর্থাৎ হযরত জিব্রাঈল (আ.) নিজেই ইকামত দেয়া শেষ করে তাঁর কাতার থেকে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে গেলেন। ঐ সময় সবারই ধারণা হলো যে আজ হযরত জিব্রাঈল আমিন (আ.)-ই ইমাম হয়ে নামায আদায় করবেন। কিন্তু না- তা হল না। বরং হযরত জিব্রাঈল (আ.) আমাদের মধ্য থেকে আমার হাত ধরে ইমামের স্থানে নিয়ে দাঁড় করায়ে দিলেন। নবীদের নিয়ে দুই রাকাত নামাজের ইমামতি করায় তিনি হয়ে গেলেন ইমামুল মুরসালিন।
মিরাজ : বায়তুল মাকদাসে নামাজ শেষ করার পর প্রিয় নবী (সা.) বোরাকে আরোহণ করে নভোমন্ডল অভিমুখে যাত্রা করেন। সেখানে পৌছে তিনি বিভিন্ন অপরূপ দৃশ্য দেখে বিমোহিত হন।
মিরাজে রাসূল (সা.) যে সমস্ত বিষয় দেখেছিলেন : মিরাজের রাতে রাসূল (সা.) দেখতে পেলেন হযরত আদমকে ঘিরে আছে অনেক লোক। তিনি ডানে তাকালে হাসছেন আর বামে তাকালে কাঁদছেন। রাসূল (সা.) এ সম্পর্কে জানতে চাইলে, বলা হল এরা সবাই আদমের বংশধর। আদম (আ) তার নেক বংশধরদের দেখলে হাসতেন আর অসৎ বংশধরদের দেখলে কাঁদতেন। এরপর নবী (সা.) কে বিস্তারিত দেখার জন্যে সুযোগ করে দেওয়া হয়।
১. এক স্থানে তিনি দেখলেন কিছু লোক ফসল কাটছে, যত কাটছে ততই বাড়ছে। হুজুর (সা.) জিব্রাইল (আ.) কে প্রশ্ন করলেন ভাই এরা কারা? এ প্রশ্নের উত্তরে জিব্রাইল (আ.) বললেন এরা আল্লাহর পথে জিহাদকারী। ২. এরপর দেখলেন কিছু লোকের মাথা পাথর মেরে চূর্ণ করা হচ্ছে। এদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হল এরা ঐসব লোক যাদের অনিহা ও অসন্তোষ তাদেরকে নামাজের জন্যে উঠতে দিত না। ৩. এরপর তিনি এমন কিছু লোক দেখতে পেলেন যাদের কাপড়ের আগে পিছে তালি দেওয়া। আর তারা পশুর মত ঘাস খাচ্ছে। এদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হল, এরা তাদের মালের জাকাত আদায় করত না, দান খয়রাতও করত না। ৪. এরপর তিনি এমন একজন লোক দেখলেন যে ব্যক্তি কাঠ জমা করে বোঝা হিসাবে উঠাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও আরো বেশি কাঠ তার বোঝার সাথে যোগ করছে। এই লোকটির পরিচয় জানতে চেয়ে উত্তর পেলেন, এ ব্যক্তিটির ওপরে এতবেশি দায়িত্বের বোঝা ছিল যে, সে বহন করতে পারতো না। তা সত্ত্বেও বোঝা কামানোর পরিবর্তে আরো অতিরিক্ত দায়িত্বের বোঝা নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিত। ৫. এর পরের দৃশ্যে তিনি দেখলেন, কিছু লোকের ঠোট ও জিহ্বা কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছে। এদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলা হল, এরা ছিল কান্ডজ্ঞানহীন বক্তা। মুখে যা আসতো তাই বলতো। এই সমাজে ফেৎনা সৃষ্টি করতো ৬. তারপর একস্থানে একটি পাথর দেখা গেল, যার মধ্যে ছিল সামান্য ফাটল। তার মধ্য থেকে একটা মোটাসোটা বলদ বেরিয়ে এলো। পরে এর মধ্যে ঢুকতে চেয়ে পারল না। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বলা হল, এটা হল এমন দায়িত্বহীন ব্যক্তির দৃষ্টাস্ত  যে ফেৎনা সৃষ্টি করার মত উক্তি করে লজ্জিত হয়ে প্রতিকার করতে চায়, কিন্তু পারে না। ৭. এক স্থানে রাসূল (সা.) দেখলেন, কিছু লোক তাদের নিজেদের গোশত কেটে কেটে খাচ্ছে। তাদের পরিচয় বলা হল, এরা অন্যের বিরুদ্ধে মিথ্যা দোষারোপ ও কটূক্তি করতো। ৮. তাদের পাশেই এমন কিছু লোক ছিল, যাদের হাতে নখ ছিল তামার তৈরি তা দিয়ে তারা তাদের মুখ ও বুক আঁচড়াচ্ছিল। এদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হল, এরা মানুষের অসাক্ষাতে তাদের নিন্দা চর্চা করতো। তাদের সম্মানে আঘাত করতো। ৯. কিছু লোকের ঠোঁট দেখা গেল উঠের ঠোঁটের মত এবং তারা আগুন খাচ্ছে। তাদের সম্পর্কে বলা হল, এরা ইয়াতিমের মাল সম্পদ ভক্ষন করতো। ১০. এরপর রাসূল (সা.) এমন কিছু লোক দেখতে পেলেন, যাদের পেট ছিল অসম্ভব বড়ো এবং বিষাক্ত সাপে পরিপূর্ণ । লোকজন তাদেরকে দলিত মথিত করে তাদের ওপর দিয়ে যাতায়াত করছে। কিন্তু তারা কিছু করতে পারছে না। এদের পরিচয় সম্পর্কে বলা হল এরা ছিল সুদখোর। ১১. এরপর আল্লাহর নবী এমন কিছু লোক দেখলেন, যাদের একদিকে রাখা ছিল ভাল গোশত। অপর দিকে রাখাছিল পচা দুর্গন্ধযুক্ত গোশত। তারা ভাল গোশত রেখে পঁচা গোশত খাচ্ছিল। তাদের পরিচয়ে বলা হল, এরা ছিল এমন লোক যারা নিজেদের হালাল স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অবৈধভাবে যৌন বাসনা চরিতার্থ করতো। ১২. সেই সাথে এমন কিছু স্ত্রী লোক দেখলেন যারা তাদের স্তনের সাহায্যে লটকে ছিল। তাদের সম্পর্কে বলা হল যে, এরা ছিল এমন স্ত্রী লোক, যারা তাদের স্বামীর ঔরসজাত নয় এমন সন্তানকেও স্বামীর ঔরসজাত হিসেবে দাবি করতো।
এই সব দৃশ্যাবলী পর্যবেক্ষণকালে নবী (সা.) এর সাক্ষাৎ হয় এমন এক ফেরেশতার সাথে যাকে রুক্ষ এবং কাটখোট্টা মেজাজের মনে হচ্ছিল। নবী (সা.) জিব্রাইলকে (আ.) জিজ্ঞেস করলেন এতক্ষণ যত ফেরেশতার সাথে দেখা হল, সবাইকে তো খোশ মেজাজে দেখলাম। ইনি এমন কেন? জিব্রাইল (আ.) বললেন এর হাসি-খুশির কোনো কারবার নেই। এ যে জাহান্নামের দারোগা। একথা শুনে আল্লাহর রাসূল (সা.) জাহান্নাম দেখতে চাইলেন, তাৎক্ষণিকভাবে তার দৃষ্টির পথ থেকে পর্দা উঠিয়ে দেওয়া হল এবং জাহান্নাম তার ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভূত হল।
সপ্ত আসমান অতিক্রম করে আরশে আযীম সফর : প্রথম আসমানে হযরত আদম (আ.) এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। হযরত আদম (আ.) নবী মুহাম্মদ (সা.) কে সাদর অভ্যর্থনা জানান। এ সময় গোটা নভোমন্ডল থেকে ধ্বনি উঠে মারহাবা মারহাবা। এ স্তর পার হয়ে তিনি দ্বিতীয় আসমানে পৌছলেন। এখানে পরিচয় হল হযরত ইয়াহইয়া (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.) এর সাথে। তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হযরত মুসা (আ.) এর সাথে সাক্ষাৎ হলো। সপ্তম আসমানে পৌছে একটি আজিমুশান মহল  বায়তুল মামুর দেখলেন। এখানে অসংখ্য ফেরেশতা আসছিল-যাচ্ছিল। এখানে তার এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের সাথে সাক্ষাৎ হলো, যার সাথে তার সাদৃশ্য ছিল। পরিচয় জানতে পারলেন ইনি হলেন হযরত ইব্রাহিম (আ.)। এরপর আরো উপরে উঠতে শুরু করলেন। উঠতে উঠতে তিনি সিদরাতুল মুনতাহা পৌছে গেলেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন-সিদরাতুল মুনতাহার নিকট। যার নিকট অবস্থিত বাসোদ্যান ( সুরা নাজম- ১৪, ১৫)। এই সিদরাতুল মুনতাহা আল্লাহর উপস্থিতির দরবার ও সৃষ্টিজগতের মধ্যে সীমারেখা হিসেবে গণ্য। নিচ দিয়ে অতিক্রমকারীরা এখানে এসে থেমে যায় আর ওপর থেকে আহকাম ও কানুন সরাসরি এখানে আসে। এই জায়গার কাছাকাছি তাকে জান্নাত দেখানো হয়েছে। তিনি দেখলেন, আল্লাহতায়ালা তার সালেহ বান্দাদের জন্য সেই সব জিনিস তৈরী করে রেখেছেন, যা না কোন চোখ দেখেছে, আর না কোন কান শুনেছে, আর না কেউ এর ধারণা পর্যন্ত করতে পেরেছে!
সিদরাতুল মুনতাহা এসে জিব্রাইল (আ.) থেমে গেলেন। আর রাসূল (সা.) সামনে অগ্রসর হলেন। তার জন্যে রফরফ চলে আসলো, সেখানে আরোহণ করে আরশে আজীমে রওয়ানা হলেন একাএকি। তিনি উপরে উঠতে উঠতে এত উপরে উঠলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, অর্থাৎ তখন সে উর্ধ্ব দিগন্তে। অতঃপর সে তার নিকটবর্তী হলো, অতি নিকটবর্তী। ফলে তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইলো অথবা তারও কম। (সুরা নাজম- ৭,৮,৯)
সেখানে তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে  আরো অনেক কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। যেসব কথাবার্তা হয়েছিল আল্লাহ তায়ালার সাথে তার দু একটি তুলে ধরা হলো। ১. বান্দার শিরক ছাড়া অন্য যেকোন গুনাহ মাফ করে দেয়ার সম্ভাবনা প্রকাশ করা হয়েছে। ২. সুরা বাকারার শেষ দুটি আয়াত শিক্ষা দেয়া হয়েছে। ৩. যে ব্যক্তি নেক কাজের ইচ্ছা প্রকাশ করে, তার জন্যে একটি নেকি লেখা হয়। আর যখন সে বাস্তবে আমল করে তখন দশটি নেকি লেখা হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি পাপ কাজ করার ইচ্ছা করে তার বিরুদ্ধে কিছু লেখা হয় না। আর যখন সে তা বাস্তবে করে তখন তার জন্য একটি মাত্র পাপ লেখা হয়। ৪. প্রতিদিন ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয় যা পরবর্তীতে কমিয়ে ৫ ওয়াক্ত করা হয় এবং ঘোষনা দেয়া হয়- “মা ইউবাদ্দালুল কাওলু লাদায়্যী ওয়ামা আনা বিজল্লামিন লিল আবিদি” অর্থাৎ হে নবী (সা.)! আমার মহান সত্বার পক্ষ থেকে কোন কথা পরিবর্তন করা হয় না এবং আমি আমার বান্দাদের উপর বেশি কষ্ট দিতে চাই না। তাই আপনি এবং আপনার উম্মতগণকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে পাঁচ এর পরিবর্তে [৫১০=৫০] পঞ্চাশ ওয়াক্তই লেখা হবে। যেমন মহান আল্লাহ সূরা আনআমে এ ইরশাদ করেছেন- “মান জাআ বিলহাসানাতি ফালাহু আশারা আমছালিহা”
অর্থাৎ : হে নবী (সা.) যে আমার নৈকট্যের জন্য একটি নেকের কাজ করবে তার জন্য এক নেকির পরিবর্তে দশ নেকী লেখা হবে। (সুবহান আল্লাহ)
আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে কথাবার্তা  শেষ করে বিদায় নিয়ে চলে আসেন সিদরাতুল মুনতাহায়। সিদরাতুল মুনতাহা থেকে জিব্রাইল (আ.) সহ বোরাক যোগে বাইতুল মুকাদ্দাসে আসলেন। তারপর আবার বোরাকে আরোহণ করে মক্কা শরীফে চলে আসলেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে মিরাজ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন।।
লেখক : সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় মুফাসসির পরিষদ, টাঙ্গাইল জেলা।
Email: [email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ