বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ক্ষমতা নিয়ে যথেচ্ছাচারের কারণেই হাওরে মহাবিপর্যয় ঘটেছে -সুলতানা কামাল

স্টাফ রিপোর্টার : ক্ষমতা নিয়ে যথেচ্ছাচারের কারণেই হাওরে মহাবিপর্যয় ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার নেতা সুলতানা কামাল। একইসঙ্গে হাওর অঞ্চলকে জাতীয় দুর্যোগপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করার দাবি জানান বিশিষ্টজনেরা। ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের রক্ষায় দ্রুত রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ নেয়ার দাবিও জানিয়েছেন তারা।

গতকাল সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘হাওরে মহাবিপর্যয় উদ্বিগ্ন নাগরিকবৃন্দ’ শীর্ষক এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে হাওরবাসীর ক্ষতির সার্বিক চিত্র তুলে ধরে দুর্নীতি রোধে বাস্তব পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান। 

 তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্ট সুলতানা কামাল বলেন, হাওরে ২৪ লাখ কৃষক বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীল। তাঁদের সব ধান তলিয়ে গেছে। দেশের অনেক মাছ নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁদের সবার জন্য সহযোগিতা দরকার। কিন্তু সরকার তাঁদের মধ্যে থেকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কৃষক পরিবারকে কীভাবে নির্বাচন করে সহায়তা দেয়ার ঘোষণা করল, তা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন। তাঁর অভিযোগ, এখানেও দুর্নীতির গন্ধ রয়েছে। এই বরাদ্দকে হাওরবাসীর সঙ্গে সরকারের প্রহসন হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, তিন লাখ মানুষকে ৩০ কেজি করে চাল দেবে সরকার। কিন্তু আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ২৪ লাখ থেকে কমে তিন লাখ হলো কীভাবে। এখানে কৃষি ব্যাংকও এগিয়ে আসতে পারে। আমাদের কৃষি ঋণ রয়েছে। কিন্তু সেটা পায় কৃষি সংশ্লিষ্ট বড় বড় উদ্যোক্তারা। কৃষকদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।

হাওরের বাঁধগুলো মেরামত ও নতুন করে নির্মাণে দুর্নীতির কারণেই ফসলহানি বলে অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতির এই অভিযোগ অনুসন্ধানেও নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। হাওরে বাঁধ নির্মাণে বিভিন্ন অনিয়ম এবং নকশাগত ত্রুটির কথাও বলেন সুলতানা কামাল।

তিনি বলেন, এমনভাবে বাঁধ বানানো হয় যে, কৃষকরা তা কেটে দিতে বাধ্য হন। এই তথ্যগুলো ভালোভাবে নেয়া উচিত। উন্নয়নে মানুষকে সম্পৃক্ত করা উচিত। এই ঘটনাগুলো আর যাতে না ঘটে।

সুলতানা কামাল বলেন, আমরা রামপালের কারণে সুন্দরবনে ক্ষতির কথা বললে সরকার বলে আমাদের বাসার বিদুৎসংযোগ বন্ধ করে দেবে। সরকারের মন্ত্রী বলেন, কৃষকেরা হাওরের বাঁধ কেটেছে।

তিনি আরও বলেন, হাওরের জলাভূমি জনগণের সম্পদ। একে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের কাছে ইজারা দিয়ে দেয়া হচ্ছে। এসব আচরণ অসাংবিধানিক। জনগণের সম্পদ নিয়ে এ ধরনের যথেচ্ছাচারই হাওরে এত বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।

সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন হাসনাত কাইয়ুম। তিনি ২৪ লাখ কৃষককে খাদ্য সহায়তা দেয়া, হাওরে রেশনিং ব্যবস্থা চালু, সরকারি-বেসরকারি সব ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ ও বিনা সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, জলমহালের ইজারা বাতিল করে উন্মুক্ত জলাশয়ে সবার মাছ ধরার অধিকার দেয়া, হাওরের পরিবেশদূষণের প্রকৃত কারণ নির্ণয়, বাঁধ নির্মাণে জড়িত দুর্নীতিবাজদের শাস্তির ব্যবস্থা করার দাবি তোলেন।

লেখক ও সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণায় এত অনিচ্ছা কেন? সেখানে ২৪ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা অনেক দেশের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। এরপরও এটা জাতীয় দুর্যোগ না হলে কখন হবে?

হাওরের ঘটনায় এ পর্যন্ত সরকারের নেয়া পদক্ষেপ এবং ভবিষ্যতে কী পদক্ষেপ নেয়া হবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দাবি করেন আবুল মকসুদ।

তিনি উল্লেখ করেন, এই দুর্যোগে হাওরের জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা সেইভাবে আমরা দেখছি না। আক্রান্ত এলাকায় ২৫-৩০ জন সংসদ সদস্য আছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত ১০ জনও এলাকায় গিয়েছেন কি না আমরা সে খবর পাইনি। 

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাাহ চৌধুরী বলেন, এই বিপর্যয়ের জন্য সরকার দায়ী না। তবে এ ধরনের দুর্যোগের পর সরকার জেগে জেগে ঘুমানোর ভান করে। জাতীয় দুর্যোগ কেন হবে না? অর্বাচিন সচিব বলে- এত শতাংশ মানুষ মারা না গেলে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করা হবে না। এখন মানুষের খাদ্য দিতে হবে, গরুর খাদ্য দিতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

আক্রান্ত এলাকার জলমহাল ইজারা না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দ্রুত ওই এলাকার জন্য এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ এবং পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। সব উন্নয়ন পরিকল্পনায় এলাকার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

সাংস্কৃতিক সংগঠক মো. সেলিম বলেন, বড় বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ অনাদায়ী থেকে যায়। অনেক সময় ঋণ মওকুফও করা হয়। সেখানে কৃষকদের ঋণ মওকুফ করা যাবে না? তাদের ঋণ মওকুফ করতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, পরিবেশগত দিকসহ এত স্বল্প সময়ে এত বিশাল ক্ষয়ক্ষতির নজির সারা পৃথিবীতে আর একটাও নেই।

কিন্তু আমাদের সরকার, বিরোধী দল, এনজিও, সিভিল সোসাইটি এবং মিডিয়া কোনো পক্ষই ঘটনার গভীরতা ও ব্যাপকতা বিবেচনায় নিয়ে এই বিপর্যয় মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয়ার কথা ভাবছে না।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, রোববার পর্যন্ত হাওর অঞ্চলের ৮০ ভাগ জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। টাকার অঙ্কে এ ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি। আগাম বন্যায় বাঁধ ভেঙ্গে ফসলহানিতে প্রতি বছরই কৃষকেরা সর্বস্বান্ত হয়। দুর্নীতিবাজদের শাস্তির দাবিতে মিছিল-মিটিং হয়। কিন্তু সাজা হয় না।

মাছের প্রজনন মৌসুমে এ ধরনের দুর্ঘটনায় হাওর মাছ শূন্য হয়ে পড়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে উল্লেখ করে হাসনাত কাইয়ুম বলেন, মাছের প্রজনন মৌসুমের আগে আগাম বন্যা প্রজননকে সহায়তা করে। কিন্তু এবারের ঘটনা শুধু বিপরীতই নয়, নজিরবিহীনভাবে বিধ্বংসী।

মাছ মারা যাওয়ার হিসাব কোনোভাবে করা সম্ভব হলেও কত জীব-অণুজীব চিরতরে ধ্বংস হয়েছে বা ধ্বংসের পথে তা সন্ধানের উদ্যোগ কেউ নিয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।

সাংবাদিক সম্মেলনে বোরো চাষের উপর নির্ভরশীল ২৪ লাখ পরিবারকে খাদ্য সহায়তার নিশ্চয়তা এবং হাওরের সবার জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালুসহ বিভিন্ন দাবি জানানো হয়। সাংবাদিক সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ