বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর প্রথম শাহাদাত বার্ষিকী আজ 

 

সামছুল আরেফীন : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর প্রথম শাহাদাত বার্ষিকী আজ বৃহস্পতিবার। গত বছরের ১০ মে দিবাগত রাত ১২টা ১০ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ১১ মে সকালে পাবনার সাঁথিয়ায় মনমথপুরে গ্রামের বাড়ি সংলগ্ন কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়। 

মৃত্যুদ- কার্যকরকে কেন্দ্র করে ১০ মে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন এলাকায় নেয়া হয় ৩ স্তরের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এ সময় আশপাশের সড়কগুলোতে সকল প্রকার যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। সন্ধ্যায় মাওলানা নিজামীর সাথে শেষবারের মতো দেখা করেন তার পরিবারের সদস্যরা। সকাল থেকেই কারাগার এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। দুপুরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের বাইরে ও আশপাশ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। কারাগারের সামনে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত র‌্যাব ও পুলিশ। 

রিভিউ খারিজের রায় কারাগারে : মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর রিভিউ (পুনর্বিবেচনার) আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় ৯ মে প্রকাশের পর তা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে। সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে রায়ের অনুলিপি কারাগারে পৌঁছে ট্রাইব্যুনাল থেকে। 

এর আগে বেলা সোয়া ৩টার দিকে আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে করা মাওলানা নিজামীর রিভিউ আবেদন খারিজের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ২২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় লিখেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তার সঙ্গে একমত পোষণ করে অপর তিন বিচারপতি রায়ে সই করেছেন। 

৫ মে মাওলানা নিজামীর রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন খারিজ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ রায় দেয়। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তখন “ডিসমিসড” এই এক শব্দে রিভিউ আবেদন খারিজের আদেশ দিয়েছিলেন সর্বোচ্চ আদালত। ফলে আপিলে তিনটি অভিযোগে দেয়া মৃত্যুদ-ের রায় বহাল থাকে। 

এর আগে ৩ মে সকাল ৯টা ২৫ মিনিট থেকে ১০টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত যুক্তি উপস্থাপন করেন মাওলানা নিজামীর প্রধান কৌসুলি ও সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন। এরপর ১০ মিনিট এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রসিকিউশন পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। মাঝে আধা ঘণ্টার বিরতি শেষে এটর্নি জেনারেল তার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন। এরপর আদালত রায়ের জন্য ৫ মে দিন ধার্য করেন। ওইদিন আদালত ‘ডিসমিসড’ বলে সংক্ষিপ্ত রায় দেন। 

আদালতে শুনানিতে খন্দকার মাহবুব হোসেনকে সহায়তা করেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান, ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিকী ও ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন।

আপিল ও মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ : ২৯ মার্চ মাওলানা নিজামীর আইনজীবীরা খালাস চেয়ে আপিলের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। ৭০ পৃষ্ঠার মূল রিভিউর আবেদনের সঙ্গে মোট ২২৯ পৃষ্ঠার নথিপত্রে ৪৬টি (গ্রাউ-) যুক্তিতে খালাস চান তার আইনজীবীরা। রিভিউ আবেদনের এডভোকেট অন রেকর্ড ছিলেন আইনজীবী জয়নুল আবেদীন তুহিন। 

এর একদিন পরেই সরকার পক্ষে শুনানির দিন নির্ধারণের জন্য আবেদন করে। সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে ৩০ মার্চ আপিল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে ৩ এপ্রিল দিন নির্ধারণ করেন। ওইদিন ডিফেন্সপক্ষে ৬ সপ্তাহ সময় চেয়ে আবেদন করা হলে আদালত এ সপ্তাহে নয় বলে আদেশ দেন। মামলার প্রধান আইনজীবী ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের ব্যক্তিগত অসুবিধার কারণে সময় চাওয়া হয়।

১৫ মার্চ আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ আবেদন করতে হয়। সে হিসেবে ৩০ মার্চ পর্যন্ত রিভিউ করার সময় ছিল। তার আগেই মাওলানা নিজামীর পক্ষে তার আইনজীবীরা সংশ্লিষ্ট শাখায় এই আবেদন করেন। 

২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর মাওলানা নিজামীর মামলায় রায় ঘোষণা করেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। রায়ে ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে মাওলানা নিজামীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-ের রায় দেয়া হয়। অপর চারটি অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করা হয়। এছাড়া বাকি আটটি অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মাওলানা নিজামীকে অভিযোগগুলো থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

ট্রাইব্যুনালের দেয়া এ রায়ের বিরুদ্ধে একই বছরের ২৩ নবেম্বর সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন তিনি। ছয় হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার আপিলে মৃত্যুদ-ের রায় বাতিল করে খালাসের আরজি জানান মাওলানা নিজামী। মোট ১৬৮টি যুক্তি দেখিয়ে এ আপিল করা হয়। 

২০১৩ সালের ১৩ নবেম্বর প্রথমবারের মতো এই মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়। কিন্তু রায় ঘোষণার আগেই অবসরে চলে যান ট্রাইব্যুনাল-১-এর তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনাল অধিকতর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে দ্বিতীয় দফায় ২৪ মার্চ মামলার রায় অপেক্ষমাণ রাখেন। 

২০১০ সালের ২৯ জুন কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় মাওলানা নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট এক আবেদনে তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।

সকলকে ধৈর্য্য ধারন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন মাওলানা নিজামী: ১০ মে সন্ধ্যায় মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করেন পরিবারের সদস্যরা। এ সময় তিনি তার পরিবারসহ সকলকে ধৈর্য্য ধারন করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আল্লাহ যেন সবাইকে হেফাজত করেন। 

পরিবার সূত্রে জানা যায়, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সাথে যখন স্বজনরা সাক্ষাত করতে কারাগারে প্রবেশ করেন, তখন তিনি নামাজ পড়ছিলেন।  তার পড়নে ছিল সাদা পাঞ্জাবী, লুঙ্গি আর মাথায় টুপি। 

স্বজনরা যখন কারাভ্যান্তরে প্রবেশ করেন, তখন তিনি নামাজ পড়ছিলেন। নামায শেষে উনার নাতি ‘দাদা ..দাদা’ বলে ডাক দেয়। এ সময় তিনি ফিরে তাকান। তাদের কাছে টেনে নিয়ে আদর করেন। 

তিনি সে সময় শক্ত ছিলেন। স্বাভাবিক ছিলেন। তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেন। তিনি এ সময় বলেন, শাহাদাত সারা জীবনই কাম্য ছিল। যুদ্ধ না করেও যদি শাহাদাত বরণ করা যায়, তার চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে? তিনি বলেন, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। আল্লাহ যেন সবাইকে হেফাজত করেন।  

এর আগে নিয়মিত সাক্ষাতের অংশ হিসেবে পরিবারের সদস্যরা কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে সাক্ষাত করেন। সে সময় মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী পরিবারের সদস্যদেরকে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রেখে ধৈর্য ধারণ করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা। যে সব এলাকার ঘটনার কথা উল্লেখ করে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে সে সব এলাকায় ১৯৮৬ সালের আগে আমি কখনো যাইনি। ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঐ এলাকায় আমি প্রথম যাই। এলাকার জনগণ প্রতিটি নির্বাচনে আমাকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছেন। এলাকার জনগণ সাক্ষী আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু নয়। 

মাওলানা নিজামীর সংক্ষিপ্ত জীবনী: মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ছিলেন বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের নেতা, দেশের গণমানুষের নেতা। দেশের গনতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের অগ্রসেনানী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে গণমানুষের কল্যাণে নিবেদিত এই ব্যক্তিত্ব মুক্তিকামী ও মজলুম মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মাওলানা নিজামীর বলিষ্ঠ ভূমিকা বাংলাদেশের মর্যাদাকে বহির্বিশ্বের কাছে উজ্জ্বল ও উন্নত করেছে।

মাওলানা নিজামী দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে পর্যায়ক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দু’টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সফলভাবে পালন করে দেশের ইতিহাসে সৃষ্টি করেছেন এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। মাওলানা নিজামী কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এ দায়িত্ব পালনকালে তিনি যে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন এবং মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমকে গতিশীল ও সার্থক করে তুলতে যে যোগ্যতা ও  সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তা এক অনন্য ও অনুসরণীয় অধ্যায়। মন্ত্রণালয় পরিচালনায় তার বিরুদ্ধে সামান্যতম দুর্নীতিও অভিযোগ উঠেনি।

মাওলানা নিজামী ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে পাবনার সাঁথিয়া-বেড়া এলাকার গণমানুষের প্রতিনিধি তথা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ৩৭ হাজার ৮শ ৬৯ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে তিনি দ্বিতীয়বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদে যোগদান করেন।

মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ১৯৪৩ সালের ৩১ মার্চ পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার মনমথপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মর-ম লুৎফর রহমান খান একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও খোদাভীরু লোক ছিলেন। ফলে বাল্যকাল থেকেই মাওলানা নিজামী ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের আলোকে গড়ে ওঠার সুযোগ লাভ করেন। নিজগ্রাম মনমতপুর প্রাইমারি স্কুলে তাঁর লেখাপড়ার সূচনা হয়। এরপর তিনি সাঁথিয়ার বোয়াইলমারী মাদরাসায় ভর্তি হন। অল্প বয়সেই মাওলানা নিজামীর মধ্যে সুপ্ত নেতৃত্বের গুণাবলী শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রখর মেধার অধিকারী নিজামী বরাবরই বিভিন্ন পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৫৫ সালে তিনি দাখিল পরীক্ষায় ১ম বিভাগ লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে পাবনার শিবপুর ত্বহা সিনিয়র মাদরাসা থেকে ১ম বিভাগে সমগ্র বোর্ডে ষোলতম স্থান অধিকার করে আলিম পরীক্ষায় কৃতিত্ব অর্জন করেন। ১৯৬১ সালে একই মাদরাসা থেকে তিনি ফাজিল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

শিবপুর ত্বহা সিনিয়র মাদরাসায় ফাজিল শ্রেণীতে অধ্যয়ন করার সময় মাওলানা নিজামী বেশকিছু উদ্যোগী ও মেধাবী ছাত্র নিয়ে একটি সংগঠন কায়েম করেন। 

লেখাপড়া ও সাংগঠনিক কার্যক্রমÑ উভয় দিকেই তিনি সাফল্য অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে কামিল পরীক্ষায় ফেকাহ শাস্ত্রে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৬৭ সালে কৃতিত্বের সাথে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী লাভ করেন।

ছাত্রআন্দোলন: ১৯৬১ সালে ইসলামী ছাত্রসংঘের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে তিনি ছাত্রআন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে থাকেন। ঐ সময় মাদরাসা-ছাত্ররা তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য আন্দোলন করছিল। ১৯৬২-৬৩ সালে এ-আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। কামিল শেষবর্ষের ছাত্র মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী মাদরাসা-ছাত্র হিসেবে মাদরাসা-ছাত্রদের ন্যায্য দাবী আদায়ের লক্ষ্যে এ-আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ১৯৬২-৬৬ সাল পর্যন্ত ইসলামী ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় অফিস সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে মাওলানা নিজামীর উপর পূর্বপাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতির দায়িত্ব অর্পিত হয়। এ-সময় দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল সংঘাতমুখর। পরপর তিন বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি তৎকালীন অবিভক্ত পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় সভাপতি (নাজেমে আ’লা) নির্বাচিত হন। পর পর দু’বছর তিনি এ-দায়িত্বে অধিষ্ঠিত থাকেন।

মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর নেতৃত্বে পরিচালিত শিক্ষা-আন্দোলন বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ১৯৬৭-৬৮ সালে ছাত্রদের উদ্যোগে শিক্ষাসপ্তাহ পালিত হয়। এ-উপলক্ষে ‘শিক্ষাসমস্যা-শিক্ষাসংকট’ ও ‘শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন’ সংক্রান্ত দু’টি পুস্তিকা বের হয়। নিজামীর নেতৃত্বাধীন গঠনমূলক এ-আন্দোলন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শিক্ষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করায়, ছাত্রসংঘ ছাত্র-জনতার কাছে ক্রমে আরো প্রিয় সংগঠনে পরিণত হতে থাকে।

জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান: ছাত্রজীবন শেষে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন। তিনি পর্যায়ক্রমে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর আমীর ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য হিসেবে ১৯৭৯-১৯৮২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি সংগঠনের এ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারী জেনারেল মনোনীত হন এবং ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এ-দায়িত্বে অধিষ্ঠিত থাকেন। ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত একটানা ১২ বছর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০০ সালের ১৯ নভেম্বর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত হন।  ২০০১-২০০৩, ২০০৪-২০০৬, ২০০৭-২০০৯ সেশনে আমীরের দায়িত্ব পালনের পর ২০১০-২০১২ সেশনের জন্য তিনি পুনরায় আমীর নির্বাচিত হন। আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায়ই ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার হন তিনি। 

গণআন্দোলনে মাওলানা নিজামী: স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রতিটি গণআন্দোলনে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮২-৯০ সাল পর্যন্ত তদানীন্তন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে যে-প্রচ- গণআন্দোলন গড়ে ওঠে, এ-আন্দোলনে মাওলানা নিজামী বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন। ফলে একাধিকবার তিনি স্বৈরশাসকের আক্রোশের শিকার হন। তাঁর সাহসী নেতৃত্বের কারণে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে প্রচ- গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠে এবং ১৯৯০ সালে জাতি অপশাসনের হাত থেকে মুক্তি লাভ করে। ১৯৯১ সালে জামায়াতে ইসলামী প্রদত্ত ফর্মুলা অনুযায়ী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে প্রশংসিত হয়। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের এই ধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে কেয়ারটেকার সরকারের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য জামায়াতে ইসলামীর সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে সংসদে মাওলানা নিজামী বিল উত্থাপন করেন। পরবর্তীতে সংসদের ভিতরে ও বাইরে জামায়াতে ইসলামীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে কেয়ারটেকার সরকারের বিধান সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী দু:শাসনের বিরুদ্ধে মাওলানা নিজামীর সংগ্রামী ভূমিকা জাতির মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় দেশের ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী শক্তিসমূহ আওয়ামী দু:শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। ১/১১ জরুরী সরকারের সময়েও তিনি এর বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা পালন করেন। তিনিই প্রথম এ ধরনের সরকারের বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদদের মধ্যে প্রথম কথা বলেন। 

টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে দেশব্যাপী গড়ে উঠা আন্দোলনেও নেতৃত্ব দেন মাওলানা নিজামী।  

জাতীয় সংসদে: মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী ১৯৯১ সালে পাবনা-১ (সাঁথিয়া-বেড়া) নির্বাচনী এলাকা থেকে ৫ম জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদে গঠনমূলক ও ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য তিনি বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বিভিন্ন ইস্যুতে জাতীয় সংসদে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর যুক্তি ও তথ্যভিত্তিক বক্তব্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়ে তিনি একজন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে দেশবাসীর নিকট খ্যাতি লাভ করেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে তিনি পার্লামেন্টে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। তার বুদ্ধিবৃত্তিক, তথ্য-যুক্তি ও সময়োপযোগী বক্তব্য পার্লামেন্টে সকলের সমর্থন লাভ করে। এ-সময় তিনি জামায়াতে ইসলামীর সংসদীয় দলনেতার দায়িত্ব পালন করেন। 

উল্লেখ্য, ২০০১ সালে সাঁথিয়া-বেড়ার জনগণ মাওলানা নিজামীকে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে। জামায়াতে ইসলামীর সংসদীয় দলের নেতা এবং সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী হিসেবে জাতীয় সংসদে পূর্বের চেয়ে কার্যকর ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।

তিনি ৫ বছর সফলতার সাথে কৃষি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। 

শিক্ষার ইসলামীকরণ ও মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে মাওলানা নিজামী: দেশব্যাপী প্রচলিত শিক্ষ-ব্যাবস্থার সংস্কার, উন্নয়ন ও মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে মাওলানা নিজামী পালন করেন আন্তরিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা। কওমী মাদরাসার স্বীকৃতি ও মান প্রদান এবং ফাজিল কামিলের মান প্রদানের মতো চারদলীয় জোট সরকারের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের পেছনে মাওলানা নিজামীর তাৎপর্যপূর্ণ ভূূূমিকার কথা সকলেরই জানা। এ সংক্রান্ত মন্ত্রী সভা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। 

বিশ্বরাজনীতিতে মাওলানা নিজামী: জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমীর এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে বিশ্বরাজনীতির সাথে মাওলানা নিজামীর রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। নানান গুরুত্বপূর্ণ আর্ন্তজাতিক রাজনৈতিক ইস্যুতে মাওলানা নিজামীর ভূমিকা প্রসংশিত হয়েছে। 

২০০২ সালের ২৭ মার্চ মুসলিম দুনিয়ার বিখ্যাত চিন্তাবিদ ও দার্শনিক ডক্টর ইউসুফ আল কারযাভীর নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের দশজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা নিজামীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। 

২০০২ এর ১১ এপ্রিল মাওলানা নিজামী রাবেতা আল আলম আল ইসলামীর সম্মেলনে যোগদান করেন এবং সৌদি গেজেট পত্রিকায় সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। এসময় মাওলানা নিজামীসহ মুসলিম বিশ্বের ৫২জন বিশিষ্টি চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবি আরব ও মুসলিম বিশ্বের জনগণের প্রতি ইসরাইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত আহবান জানান। 

২০০৩ সালের ১৫-১৭ অক্টোবর চীনে অনুষ্ঠিত ঝঁংঃধরহবফ ঊষরসরহধঃরড়হ ড়ভ ওড়ফরহব উবভরপরবহপু উরংড়ৎফবৎ শীর্ষক সম্মেলনের তৃতীয় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী।

২০০৬ সালে মাওলানা নিজামী ইংল্যা-ের শীর্ষ বৈদেশিক ও কূটনৈতিক নীতিনির্ধারণী বিশেষজ্ঞ ফোরাম চেথম হাউজের আমন্ত্রণে ‘বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহ : জামায়াতের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে তিনি এ-সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এ বৈঠকে বৃটেনের বিশিষ্ট নীতিনির্ধারক বুদ্ধিজীবি, কূটনৈতিকবৃন্দ, পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। মাওলানা নিজামী উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। 

উল্লেখ্য যে, চেথম হাউজ বৃটেনের অন্যতম শীর্ষ নীতিনির্ধারণী বিশেষজ্ঞ ফোরাম, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রেখে থাকেন। মাওলানা নিজামী প্রথম বাংলাদেশী নেতা, যিনি চেথম হাউজের আমন্ত্রণে সেখানে বক্তব্য রাখেন।

২০০৬ সালে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত রাবেতা আল আলম আল ইসলামী কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক ওলামা সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করেন। তিনি মুসলিম ওয়াল্ড লীগ (রাবেতা), সেন্ট্রাল কো-অর্ডিনেশন কমিটির স্থায়ী সদস্য। মুসলিম উম্মায় তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের ২০০৯ সালের ইউএসএ ভিত্তিক “দ্যা রয়েল ইসলামিক স্ট্যোটেজিক স্টাডিজ সেন্টার কর্তৃক বিশ্বের শীর্ষ ৫০জন ব্যক্তিত্বের মধ্যে মাওলানা নিজামীকে নির্বাচন করেন।

পারিবারিক জীবন: ১৯৭৪ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর শামসুন্নাহারের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। শামসুন্নাহার নিজামী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগ থেকে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনিও ছাত্র জীবন থেকে ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মহিলা বিভাগের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর ৪ ছেলে ও ২ কন্যা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ