মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

আবার সেই পদধূলি আর চরণামৃত!

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : বিষয়টা আমি প্রায় ৪৭ বছর আগ থেকে অর্থাৎ বিগত ১৯৭০ সাল থেকে ভুলেই ছিলাম। কিন্তু সুজিত সুচন্দন ও মাজহারুল ইসলাম নামে দুই ফেসবুক বন্ধু সেটা স্মরণ করিয়ে দিলেন। অনেক ধন্যবাদ তাঁদের দুজনকেই।
প্রথম জন সুজিত জানতে চেয়েছেন, আমি ঢাকায় থাকি কিনা। তিনি আমার চরণধূলি নিতে চান। অনুগ্রহ করে সময় দিলে তিনি তা গ্রহণ করে নিজেকে যেন ধন্য করতে চেয়েছেন। দ্বিতীয় জন মাজহার সুজিত সুচন্দনের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে জানতে চেয়েছেন, লিখেছেন, ‘স্যার, কি এখনও পদধূলি দেন?’ চমৎকার। তাঁরা দুজনই এমনভাবে জানতে না চাইলে হয়তো এ বিষয় আজ আমাকে উপস্থাপন করতে হতো না। তবে জনাব মাজহারের প্রশ্নটা আমার কাছে বেশ তির্যকই মনে হয়েছে।
হ্যাঁ, পদধূলি বা চরণামৃতের সঙ্গে এক সময়তো আমার সম্যক ধারণা ছিলই। কারণ পদধূলি এবং চরণামৃত দুটোই ধর্মবোধ ও বিশ্বাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এ দুইয়ের সংস্পর্শে না এলে কারুর পূর্ণতাপ্রাপ্তি হয় না। গুরুদেব বা কোনও পূজনীয় ব্যক্তির পদধূলি গৃহে পড়লে সে গৃহ এবং এর বাসিন্দারা গৌরবান্বিত বোধ করেন। সেজন্যই পায়ের ধূলোর এমন মর্যাদা দেয়া হয় হিন্দুসমাজে। অন্যকথায় একে লক্ষ্মী বললেও অত্যুক্তি হয় না।
‘চরণামৃত’ কি জিনিস তা মুসলিমসমাজের সকলের জানবার কথা নয়। তবে সংশ্লিষ্ট সমাজের প্রায় সবাই এ সম্পর্কে সম্যক অবহিত বলে আমি মনে করি। চরণামৃত (চরণ+অমৃত)। অর্থাৎ চরণধোয়া জল। বাড়িতে ব্রাহ্মণঠাকুর বা গুরুমহাশয় এলে তাঁর চরণ বা পা ধুয়ে দেয়া হয় যেজল দিয়ে সেজলই চরণামৃত। এ চরণামৃত অতীব পবিত্র মনে করা হয়। মাটিতে পড়তে দেয়া হয় না। গুরুঠাকুর বাড়িতে এলে কাঁসার বড় থালিতে দুধ ও তুলসীপাতা মিশ্রিত জলে তাঁর শ্রীচরণ ধুয়ে দেবার নিয়ম। এরপর নতুন কাপড় বা গামছা দিয়ে ঠাকুরের পদযুগল ধৌত করে নতুন খড়ম পরতে দেয়া হয়। এ পাধোয়া জল বা চরণামৃত বাড়ির সবাই ঠোঁটেমুখে, জিহ্বা ও মাথায় ছুঁইয়ে ঠাকুর বা গুরুভক্তি করবার প্রণালি আমি প্রত্যক্ষ করেছি।
অনেকেই জানেন, শৈশবটা আমার মামাবাড়িতে কাটে। সেই মামাবাড়িতে আগের দিনে গুরুঠাকুর আসতো। আর ঠাকুর এলে সেই পদধূলি আর চরণামৃতগ্রহণ চলতো। বাড়ির সবাই তা গ্রহণ করে। আমি কেন বাদ যাবো? যথারীতি আমার পালা। আমাকেও তা গ্রহণের জন্য বলা হয়। কিন্তু আমি বেঁকে বসি। আমি প্রশ্ন তুলি। কেন মানুষের পদধূলি নিয়ে তা মুখেঠোঁটে, জিহ্বায় আর মাথায় মাখতে হবে? ঠাকুর মানে ভগবান আর আমরা কি গরু-ছাগল নাকি? বড়মামা ভট্টরায় আমাকে বকাঝকা করেন। মারতেও উদ্যত হন একপর্যায়ে। ঠাকুর বলে ওঠেন, ‘ও ছোট মানুষ, থাক না। বুদ্ধি হলে ঠিক হয়ে যাবে।’ বড়মামা বলেন, ‘বড় হলে ঠিক না ছাই হবে। ওটা আমাদের কুলে ছাই দেবে। ডোবাবে সবকে।’
শুধু পদধূলি আর চরণামৃতই নয়, ঠাকুর তথা মানুষের পায়ে শির ঝুঁকিয়ে পাছুঁয়ে প্রণাম করাও মানবতার অবমাননা বলে সেই শৈশবেই অনুভব করেছি। এছাড়া ঠাকুরের পদধূলি অথবা চরণামৃতগ্রহণও সৃষ্টির সেরা মানুষের চরম অমর্যাদা বলেই আমার মনে হয়েছে সেই ছোটবেলা থেকেই। তাই আমি বাড়িতে ঠাকুর-পুরোহিত এলে ইচ্ছে করেই সরে থাকতাম বা অজুহাত দেখিয়ে অন্যত্র অবস্থান করতাম। এজন্য অবশ্য আমার কপালে ‘লক্ষ্মীছাড়া’ অভিধা জুটেছিল শৈশবকাল থেকেই।
পদধূলি বা চরণামৃত যেখানে ছিল সেখানে থাকলে আমার কিছু বলবার আবশ্যক ছিল না আদৌ। আমার পূর্বপুরুষদের মনোকষ্ট হয় এমন কোনওকিছু আমি বলতে বা আলোচনা করতে চাই না। ওরা ওদের বিশ্বাস-বোধ নিয়ে থাকতে পারেন। এতে কারুর হস্তক্ষেপ বা জোরজবরদস্তি মানবাধিকারের লঙ্ঘন নিশ্চয়ই।
কিন্তু যে পদধূলি আর চরণামৃত সাড়ে চার দশকেরও অধিককাল আগে আমি ফেলে এসেছি তা যেন আমাকে আবারও আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে চায়। যে আলোকবর্তিকা আমাকে ঘরছাড়া করেছে, আত্মীয়স্বজনকে অনাত্মীয় বানিয়েছে, সেই আলোকবর্তিকাই যখন আলো-আঁধারিতে ঢাকা পড়ে তখন বিস্ময়ে বিমূঢ় না হয়ে পারি না।
পদধূলির ঘনঘটা এখন মুসলিমসমাজেও ছড়িয়ে পড়েছে। কদমবুসিতো একশ্রেণির মুসলিম দ্বিধাহীনভাবে করে বসেন। পিরসাহেবদের মধ্যে এটা যেন এখন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। মাথা নুইয়ে, পাছুঁয়ে সালাম করা আজকাল প্রায়শ চোখে পড়ে। কদমবুসি আর পদধূলি নিয়ে প্রণামের মধ্যে তফাত মূলত নেই। ফারাক কেবল কথায়। কাজটা একই। কোনও কোনও মুসলমানতো সালাম ছেড়ে কদমবুসিরই প্রাধান্য দিচ্ছেন আজকাল। সালাম যায় যাক। কদমবুসি যাতে বাদ না পড়ে।
কনে দেখতে এসে হবু বউ যদি বরের বাবা-মাকে কদমবুসি না করে কিংবা বর কনের বাবা-মাকে পাছুঁয়ে সালাম না করে তাহলে বিয়ে ভেঙে যাবার ঘটনা ঘটছে মুসলিমসমাজের মধ্যে। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে আমার জানা নেই। অথচ ইসলামের মূল কেন্দ্রভূমি মক্কা-মদিনাসহ প্রায় দেশে এ কুপ্রথা নেই। রসুলুল্লাহ (স)-এর যুগেও কদমবুসি প্রথা ছিল না। তাহলে কদমবুসির ঘেরাটোপে মুসলিমসমাজ আটকে গেল কবে থেকে?
কদমবুসি করা আর পদধূলি নেয়া একই জিনিস। বলতে পারেন, মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। যেই লাউ সেই কদু। পিরসাহেব আর পুরোহিতঠাকুর যেমন প্রায় একই, তেমনই কদমবুসি করা আর পদধূলি একই। পদধূলি-চরণামৃত দেন ঠাকুর-পুরোহিত। গ্রহণ করেন শিষ্যরা। তেমন পদধূলিও দেন পিরসাহেবরা। কদমবুসির মাধ্যমে তা গ্রহণ করেন মুরিদরা।
এছাড়া দুর্গা আর দরগাহর মাঝেও তেমন ফারাক নেই। দুটোই ব্যবসাকেন্দ্র। দুর্গা ঘিরে থাকেন পুরোহিত। আর দরগাহ ঘিরে রাখেন পির। পির আর পুরোহিত। পুরোহিত এবং পির। বেশ মিল। অনুপ্রাসসমৃদ্ধ শব্দবন্ধ।
পুরোহিতঠাকুররা যেমন পূজোপার্বনের নামে জনগণকে চুষে খান, তেমনই পিরসাহেবরাও মুরিদানের অর্থকড়িতে পকেট ভর্তি করেন। পুরোহিত-ঠাকুররা সাধারণত নিরামিষভোজি হন। কিন্তু পিরসাহেবরা তা নন। বরং মাংসাশী। তাই তাদের আস্ত গরু, খাসি, এমনকি আমদানিকৃত উটও দরগাহ-মাযারে চলে আসে। তাই পদধূলি কদমবুসি পিরসাহেবরা ছেড়ে ব্যবসায়ে মার খাবেন কেন?
আমার ধর্ম ছেড়ে দীনাশ্রয়ের পর বেশ কয়েকজন বন্ধু খানকা বা দরগাহ কায়েম করে  পিরসাহেব সাজবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারাই সব করতেন। আমি রাজি হলেই চলতো। কিন্তু পুরোহিতগিরি বা পিরগিরির মধ্যে মৌলিক কোনও পার্থক্য না থাকায় সেপথ আমায় টানেনি।
যা হোক, আমাদের এদেশে পিরসাহেব ও পিরের দরগাহর কোনও শেষ নেই। জেলায় জেলায়, থানায় থানায় পিরসাহেব আছেন। পিরের মাযার বা দরগাহ আছে। আমদের উত্তরবঙ্গে ঘোড়াপির, তেনাপির, ঢেলাপিরের অভাব নেই। ঘোড়াপিরের মাযারে ঘোড়ার মূর্তি বানিয়ে স্তূপ করে রাখা হয়। তেনাপিরের মাযারে তেনা ফেলে অথবা গাছে বেঁধে রাখতে দেখা যায়। আর ঢেলাপিরের মাযারে মাটির ঢেলা ফেলতে ফেলতে পাহাড় পর্যন্ত গড়ে উঠতে দেখেছি আমি।
এমন অবস্থায় সুজিত সুচন্দন যদি আমার সঙ্গে সাক্ষাত করে আবারও পদধূলি প্রার্থনা করেন এবং সুজিতের প্রার্থনার প্রেক্ষিতে মাজহারুল ইসলামরা আমাকে উদ্দেশ কিংবা সুজিত সুচন্দনকে উপলক্ষ করে বলেন, ‘স্যার কি এখনও পদধূলি দেন?’ তবে কি তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যায়? ভাগ্যিস, বন্ধুদের পরামর্শে পিরসাহেব সেজে খানকা বা দরগাহ কায়েম করে বসিনি। এমন করলে নিশ্চয়ই কদমবুসি নিতে নিতে আর পদধূলি বা চরণামৃত দিতে দিতে আমার জীবনটা আরেক তমসায় আচ্ছন্ন হয়ে যেতো।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ