শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

থানার গাফিলতি-অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের তদন্ত কমিটি

 

তোফাজ্জল হোসেন কামাল : রাজধানীর বনানীতে ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনায় মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব ও দায়িত্বে গাফিলতির বিষয়টি তদন্তে গঠিত কমিটি আরও তিনদিন সময় নিয়েছে। গতকাল রোববার কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার কথা থাকলেও তারা তিনদিনের সময় চেয়েছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে তারা প্রতিবেদন দাখিল করবেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মাসুদুর রহমান। 

জানা গেছে, এ পর্যন্ত তদন্তে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে কিছু অনিয়ম ও অসংগতি পেয়েছে কমিটি। জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে কিছু অনিয়ম ও অসংগতি নজরে এসেছে। এসব অনিয়ম ও অসংগতি পূর্ণাঙ্গভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তে গাফিলতির প্রমাণ মিললে অবশ্যই শাস্তির সুপারিশ করা হবে। 

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে , বনানীর হোটেলে দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় মামলা, ধর্ষিতাদের সঙ্গে আচরণ এবং আসামিদের গ্রেপ্তারে থানা পুলিশের গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে পুলিশেরই তদন্ত কমিটি। তদন্তে থানা পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা নিতে গড়িমসির অভিযোগ, পুলিশ আসামিদের কাছ থেকে কোনো সুবিধা নিয়েছে কি না, আসামিদের গ্রেপ্তারে তাদের ভূমিকা কী ছিল এবং ‘ভিকটিমদের’ সঙ্গে তাদের আচরণের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বলে জানান কমিটি প্রধান। তদন্তে কী পাওয়া গেছে তা এই মুহূর্তে বলা ঠিক হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যেসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে দোষ প্রমাণিত হবে, তাদের শাস্তি পেতেই হবে।”

জন্মদিনের পার্টির কথা বলে গত ২৮ মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে নিয়ে ঢাকার দুই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে গত ৬ মে বনানী থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। বাংলাদেশে স্বর্নালঙ্কারের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ ও তার দুই বন্ধু এবং তার দেহরক্ষী ও গাড়িচালককে এই মামলায় আসামি করা হয়। 

এই মামলা নিতে বনানী থানা পুলিশ গড়িমসি করে দুই দিন পার করে দেয় এবং তাদের হয়রানি করে বলে অভিযোগ করেন ওই দুই শিক্ষার্থী। বনানী থানার ওসি ফরমান আলীর বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ থেকে মোটা অংকের টাকা নেওয়ার অভিযোগও আসে সংবাদমাধ্যমে। 

পুলিশের ওই ভূমিকার সমালোচনা করে এই বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। 

এই প্রেক্ষাপটে মামলা তদন্তের ভার বনানী থানা থেকে পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশনে দেয়ার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে কমিটি করেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।  

মামলার তদন্তের দায়িত্ব উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশনে দেয়ার দুই দিনের মাথায় ১১ মে সিলেট থেকে সাফাত ও তার বন্ধু সাদমান সাকিফকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই ঘটনায় ‘দোষ স্বীকার’ করে এরইমধ্যে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন তারা। পরে মামলার অপর তিন আসামিকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। 

বনানী থানা পুলিশের বিরুদ্ধে গঠিত ওই তদন্ত কমিটিতে সদস্য হিসেবে আছেন মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় (ক্রাইম) ও যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) আব্দুল বাতেন। এই কমিটিকে সহায়তার জন্য গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) শেখ নাজমুল আলম, উপ-কমিশনার (উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন) ফরিদা ইয়াসমিন, উপ-কমিশনার (গুলশান) মুস্তাক আহমেদকে দায়িত্ব দেয়া হয়। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির একজন সদস্য গতকাল রোববার বিকালে বলেন, তদন্ত সংশ্লিষ্ট প্রায় সবার সঙ্গে কথা বলেছেন তারা। “তদন্তে বনানী থানা পুলিশের বেশ গাফলতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ মুহূর্তে এর বেশি কিছু বলার নেই।”

ধর্ষণের কথা স্বীকার নাঈম আশরাফের

তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বনানীতে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলার আসামি নাঈম আশরাফ ওরফে হালিম। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে মামলার বাদীর বান্ধবীকে ধর্ষণের বিষয়টি স্বীকার করে নাঈম। এরপরই তাদের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন তদন্ত তদারক কর্মকর্তারা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন। 

তদন্ত তদারকিতে থাকা দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘গ্রেফতারের পর আদালতের মাধ্যমে নাঈম আশরাফকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। রিমান্ডে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ধর্ষণে জড়িত থাকার বিষয়টি ছাড়াও আরও গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য দিয়েছে নাঈম। পরিকল্পিতভাবেই দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে জ্ঞিাসাবাদে জানিয়েছে সে। এছাড়া এই ধর্ষণ-পরিকল্পনার সঙ্গে আরও কারা জড়িত ছিল, তাদেরও নাম-পরিচয় বিস্তারিত জানিয়েছে।’

ওই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘মামলার বাদীর বান্ধবীর পোশাকে পাওয়া ডিএনএ-এর সঙ্গে আসামি নাঈম আশরাফের ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হবে। এজন্য নাঈম আশরাফের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডির ফরেনসিক পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। সব আলামত ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পরই এ মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হবে।’ নাঈম আশরাফ সম্পর্কে আরও অনেক তথ্য আছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) জনসংযোগ বিভাগের উপ-কমিশনার মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘নাঈম আশরাফ জিজ্ঞাসাবাদের প্রথমদিকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। তবে এখন সে মুখ খুলতে শুরু করেছে। এরইমধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে।’

এদিকে ধর্ষণের ঘটনাস্থল ও ধর্ষণের সহযোগী হিসাবে রেইনট্রি হোটেলের মালিকের ছেলেকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছেন তদন্তে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। কারণ, ধর্ষণের আগে দুই শিক্ষার্থীর বন্ধু শাহরিয়ারকে মারধরের ভিডিও ফুটেজ পেয়েছেন তারা। যা এজাহারেও উল্লেখ রয়েছে। তবে ধর্ষণের সময় মোবাইল ফোনে যে ভিডিও করা হয়েছিল, সেটা এখনও উদ্ধার করা যায়নি। সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষার পর সেই ভিডিও উদ্ধার করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তারা। তবে আসামিদের গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে ও আদালতে স্বীকারোক্তি ছাড়াও তাদের কাছ থেকে জব্দ করা আলামতের মাধ্যমে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। 

সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী ওরফে আজাদ পুলিশকে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে। তবে ধর্ষণের সঙ্গে তার জড়িত থাকার কোনও তথ্য পায়নি পুলিশ। ঘটনার মাত্র দুইদিন আগে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। ধর্ষণের পরই তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। 

গত ১১ মে রাতে সিলেট শহরের একটি বাড়ি থেকে সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফকে প্রথম গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা দু’জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে বর্তমানে কারাগারে। এরপর গাড়ি চালক বিল্লাল হোসেন ও দেহরক্ষী রহমত আলীকে রাজধানীর নবাবপুরের একটি হোটেল থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গত বুধবার ১৭ মে রাতে মুন্সীগঞ্জ থেকে নাঈম আশরাফকে গ্রেফতার করে পুলিশ। 

সাফাত, সাদমানের মোবাইল ফোন সিআইডিতে

সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফের কাছ থেকে জব্দ করা পাঁচটি মোবাইল ফোন ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কাছে পাঠানোর অনুমতি দিয়েছে আদালত। গতকাল রোববার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের পরিদর্শক ইসমত আরা এমির আবেদনে ঢাকার মহানগর হাকিম দেলোয়ার হোসেন এ আদেশ দেন। 

সংশ্লিষ্ট আদালত পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা উপপরিদর্শক আব্দুল মান্নান বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় আলামত হিসেবে ওই দুইজনের কাছ থেকে জব্দ করা পাঁচটি মোবাইল সেট ও একটি পাওয়ার ব্যাংক পরীক্ষার জন্য সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোর অনুমতি দিয়েছেন বিচারক। 

ধর্ষণের সময় সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলীকে দিয়ে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে। 

এবার নাঈম আশরাফের ডিএনএ পরীক্ষা

মামলার অন্যতম আসামি নাঈম আশরাফের ডিএনএ পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। গতকাল রোববার ঢাকা মহানগর হাকিম দেলোয়ার হোসেন সিআইডি’র ফরেনসিক বিভাগকে এ আদেশ দেন। 

ধর্ষণের ভিডিও ধারণের কথা স্বীকার করেনি বিল্লাল

ধর্ষণের ভিডিও ধারণের কথা অস্বীকার করে গেছেন মামলার আসামি সাফাত আহমেদের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন। গতকাল রোববার ঢাকা মহানগর হাকিম মাহমুদুল হাসানের আদালতের খাস কামরায় প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপী দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ধর্ষণের ভিডিও ধারণের কথা অস্বীকার করে সে। আদালত সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। 

আদালতে বিল্লাল হোসেন জানায়, ‘গাড়ি চালানো অবস্থায় যা শুনেছি, তাতে কাছে মনে হয়েছে ধর্ষণের শিকার তরুণীদের সঙ্গে বিভিন্ন কৌশলে আপস করতে বাধ্য করার চেষ্টা করা হয়েছে। কখনও ভয় দেখানো হয়েছে, কখনও টাকার প্রলোভন দিয়ে চুপ থাকতে বলা হয়েছে।’ ধর্ষণের দৃশ্য ভিডিও করতে বললেও লজ্জায় সে করেনি উল্লেখ করে বিল্লাল বলে, ‘ভিডিও ধারণ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু আমি ধারণ করিনি। তবে ইয়াবা সেবনের ভিডিও ধারণ করেছি।’

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ