বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

প্রভাবশালীদের কারণে নিয়ন্ত্রণহীন গণপরিবহণ

ইবরাহীম খলিল : রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কারণে গণপরিবহন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে হাতে নেয়া কোন পরিকল্পনাই আলোর মুখ দেখেনি। এর প্রমাণ, কিছু দিন আগে সিটিং সার্ভিস বন্ধ করেও সরকার আবার স্থগিত করেছে। আর এসব কাজে বিশেষজ্ঞদের মতামত না নিয়ে কাজ করায় সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। একই কারণে পরিবহন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ গাড়ির লাইসেন্স দিচ্ছে অনেকটা লাগামহীনভাবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীতে এখন অসংখ্য বাস মালিক। প্রায় দুই হাজার। আবার তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। নামে-বেনামে কেউ কেউ বিভিন্ন বাহিনীর সাবেক, বর্তমান সদস্যও। এ অবস্থায় সব বাস মালিককে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা সম্ভব না। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রায় এক বছর আগে এমন পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু এখনও শুরু করতে পারেননি।

তারা বলছেন, পূর্বাপর না ভেবেই বাস মালিকদের একের পর এক রুট পারমিট দিয়ে দেয়ায় রাজধানীর গণ পরিবহনে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। অপ্রয়োজনীয়ভাবে অসংখ্য রুটের সঙ্গে তৈরি হয়েছে অসংখ্য বাস কোম্পানি ও মালিক। ফলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে পরিবহন খাত। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লোক বেশি, আয়তন কম, রাস্তাও ছোট। কিন্তু রুট পারমিটের কোনো কমতি নেই এই নগরে। যথাযথ সমীক্ষা ছাড়াই রুট পারমিট দিয়ে দেয়ায় ঢাকার রাস্তায় তৈরি হয়েছে রুটের জট। দেখা যায়, রাজধানীতে মোটাদাগে উত্তর-দক্ষিণমুখী বড় রাস্তা ৪টি। এগুলো উত্তরা, মিরপুর, গাবতলী থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে ঢাকার দক্ষিণে। এছাড়া পশ্চিম থেকে পূর্বমুখী রাস্তা আছে অন্তত: ২টি। তবে হাতে গোনা এই কয়টি বড় রুটে হিজিবিজি করে সৃষ্টি করা হয়েছে কমপক্ষে ১৭০টি রুট। এসব রুটে নগরীতে যানজট, যাত্রী ভোগান্তি, বিশৃঙ্খলা আর গণপরিবহনে নিয়ন্ত্রণহীনতার পেছনে রুটের এই অযৌক্তিক বিন্যাস দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। 

এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, সব কোম্পানির গাড়ি কেন মতিঝিল, গুলিস্তান আসবে। এটি সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক বিন্যাস। আরেক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এস এম সালেহউদ্দিন বলেন, এক মালিকের যদি ১০টি গাড়ি থাকে সেই সব গাড়ি লিজ দিয়েছে ১০ জন চালককে। আর ঐ ১০ জন চালকই কিন্তু অপারেটরের মালিক।

তারা বলছেন, রুট কমিয়ে নির্দিষ্ট রুট ভিত্তিক আলাদা বাস কোম্পানি করা প্রয়োজন, যেখানে অন্য রুটের বাস আসতে পারবে না। তাদের মতে, শাখা বা সংযোগ সড়ক থেকেও কোনো বাস না ঢুকে শুধু যাত্রী নামিয়ে দেবে মূল সড়কগুলোতে। যদিও বি আরটিএ এখন বলছে, বাসের রুট পুনর্বিন্যাসসহ পুরো ব্যবস্থাটিকেই ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন তারা।

এবিষয়ে কোন গবেষণা নেই উল্লেখ করে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখাতের সমস্যা সমাধান নিয়ে অনেক আগেই সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা আটকে আছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজে বা আত্মীয়স্বজনের নামে দু-একটা বাস কিনে প্রথমে একটি কোম্পানি খোলেন। এরপর বিভিন্ন ব্যক্তির বাস ওই কোম্পানির অধীনে চালানোর জন্য নিয়ে আসেন। বিনিময়ে কোম্পানির উদ্যোক্তারা প্রতিটি বাস থেকে চাঁদা আদায় করেন। এটাকে তারা নাম দিয়েছেন জিপি গেট পাস। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সন্তুষ্ট করা এবং কোম্পানির খরচের নামে এই জিপি আদায় করা হয়। এ বাণিজ্য ধরে রাখার জন্য যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, সেই দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত পরিবহন মালিক ও শ্রমিক নেতারা এ খাতের নিয়ন্ত্রণ করেন।

জানা গেছে, পরিবহন ব্যবসায় সরকারের দায়িত্বে থাকায় অনেকে এখন পরিবহন ব্যবসায় নিজের নাম রাখছেন না। পরিবারের কাউকে দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে নিচ্ছেন তারা। এদের মধ্যে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী থেকে শুরু করে রয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও তাদের পরিবার।

পরিবহন নেতারা জানান, সড়ক ও নৌ এ দু’খাতে ধর্মঘট ডেকে জিম্মি করা হয়। রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন হলেও নিয়ন্ত্রকরা ব্যবসার স্বার্থে এক হয়ে যান। স্থলপথে বাস আর নৌপথে লঞ্চ উভয় খাতই তাদের নিয়ন্ত্রণে। এ দুই খাতে ব্যবসা করতে নাম লেখাতে হয় প্রভাবশালীদের খাতায়-ছায়ায়। আবার এমনও আছে দল পাল্টিয়ে ফেলছেন কেবল ব্যবসা টেকাতে।

কনক পরিবহন ও সার্বিক পরিবহন হলো নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাহজাহান খানের পারিবারিক ব্যবসা। স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির নেতা মশিউর রহমান রাঙ্গার মালিকানাধীন বাস চলাচল করে ঢাকার বাইরে রংপুরে। ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের ভাই মমতাজুল ইসলামের বাস চলে ঢাকা-ময়মনসিংহ গন্তব্যে শামীম এন্টারপ্রাইজ নামে। পিরোজপুরের সংসদ সদস্য আবদুল আউয়ালের ভাই মশিউর রহমানের বাস চলাচল করে ওই জেলার বিভিন্ন পথে। পরিবহন ব্যবসায় আছেন আরেক স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ। বিহঙ্গ পরিবহনের ব্যবসায় যুক্ত তিনি। মিরপুরের সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের শাহিদা তারেখ দীপ্তি। তিনি প্রজাপতি পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত। সূচনা-বিআরএফ পরিবহনে রয়েছেন সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শাহজাহান মিয়ার ছেলে আরিফুজ্জামান রনির বাস। একই গন্তব্যে চলাচলকারী দ্বীপ বাংলা পরিবহনেও আরিফুজ্জামানের বাস চলত। এমপি নূরে আলম চৌধুরীর চাচাতো ভাই মনির চৌধুরীর বাস চলে সূচনা-বিআরএফ পরিবহনে।

সরকারি দলের এমপি হাবিবুর রহমান হাবিব ও মিজানুর রহমান সড়ক পরিবহন সমিতির সহসভাপতি। মশিউর রহমান রাঙ্গা প্রতিমন্ত্রী হওয়ার আগে ছিলেন রংপুরে পরিবহন মালিকদের সভাপতি। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর হয়ে যান সারা দেশের পরিবহন মালিকদের নেতা। হাবিবুর রহমান হাবিব ও মিজানুর রহমানও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সভায় পরিবহন মালিক শ্রমিকদের পক্ষেই ভূমিকা রাখেন।

এর আগে বিএনপি সরকারের সময়ে তৎকালীন মন্ত্রী ও বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাস পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তার মালিকানাধীন বাস ছিল ঢাকা পরিবহন ও ঢাকা-কিশোরগঞ্জ গন্তব্যের শৌখিন পরিবহনে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে মির্জা আব্বাসের মতোই প্রভাবশালী ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল। বর্তমানে দাপটে আছেন সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি।

এদিকে রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থায় নতুন করে ৪ হাজার বাস নামানোর যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক যে প্রস্তাব দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন নিয়ে বিলম্ব হচ্ছে রাজনৈতিক কারণে বলেও মত দিয়েছেন কয়েকজন পরিবহন মালিক। কিছু দিন আগে মেয়র আনিসুল হক বলেন, আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমরা একমত হয়েছি। আশা করি আগামী মাসে আমরা পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবো।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ