শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সিয়ামের মাস রমযান এবং আমাদের করণীয়

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : গত ২৮ মে রোববার থেকে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সবকটি দেশে পবিত্র রমযান মাস শুরু হয়েছে। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে একদিন আগে রমযানের চাঁদ দেখা যাওয়ায় সেদেশের মুসলমানরা গত ২৭ মে শনিবার থেকেই রোযা শুরু করেছেন। আমরা স্বাগত জানাই সিয়াম সাধনার এ পবিত্র মাসকে। রোযা বা সিয়াম পালন হচ্ছে রমযানের চাঁদ দেখবার পরদিন থেকে সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ২৯ অথবা ৩০ দিন পানাহার বন্ধ রাখা। রোযার নিয়তে ভোররাতের খাবারগ্রহণকে সাহরি এবং সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে পানি বা কোনও হালাল খাবার খেয়ে রোযাভঙ্গ করাকে ইফতার বলা হয়। ভোররাত থেকে সূর্যাস্ত অবধি না খেয়ে থাকবার নামই কি সিয়াম বা রোযা? নিশ্চয় না। এর তাৎপর্য ব্যাপক ও বিস্তৃত।
আল্লাহ বলেন, 'ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আমানু কুতিবা আলাইকুমুস সিয়ামু কামা কুতিবা আলাল্লাজিনা মিন কাবলিকুম লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন।' -সূরা বাকারা : ১৮৩ নং আয়াত। অর্থাৎ হে ঈমানদার বান্দারা শোনো, রোযা তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে; যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল; যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো। এর মানে তাকওয়া অর্জনকারি হতে হবে মুসলমানদের। মুত্তাকি হলেন সেই ব্যক্তি যিনি আল্লাহকে ভয় করেন। অন্যের কল্যাণ করেন। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখেন। সর্বদা ন্যায়ের পথে থাকেন। কারুর কোনও ক্ষতি করেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং তা প্রতিরোধে সচেষ্ট থাকেন। সমাজের মানুষকে ভালোবাসেন। প্রয়োজনে সহায়তা করেন। এমন মানুষই মুত্তাকি। এমন মানুষ কোনও সমাজে বেশিরভাগ হতে পারলে সে সমাজের চিত্রটা কীরূপ হতে পারতো; ভেবে দেখেছি কেউ?
যারা প্রকৃত সায়েম বা রোযাদার তাঁরা রোযা পালনে কোনওরূপ কষ্টানুভব করেন না। বরং আনন্দের সঙ্গেই পবিত্র মাসটি উদযাপন করেন। সারাদিন সিয়াম পালন করে চোখে-মুখে কিছুটা মলিনতা লক্ষ্য করা গেলেও অন্তর থাকে সংযমের অনাবিল আনন্দানুভূতি ও আত্মতৃপ্তিতে উদ্বেল। সারাদিনের সিয়াম সাধনা, নিয়মিত সালাত আদায়, সাহরি-ইফতারগ্রহণ, তারাবিতে অংশ নেয়ার মধ্যে যে কী পরমানন্দ ও নৈকট্যানুভব তা একজন বেভুল বেরোযাদারের কল্পনাতীত বটে। এরপর সংযমসাধনার এ পবিত্র মাসেই সামর্থবান মুসলমানরা সাধারণত জাকাত আদায় করে থাকেন। রোযাশেষে ঈদের আগে আগে প্রদান করেন দুস্তদের হক সদকায়ে ফিতর। অভাবী মানুষ যাতে ঈদের উৎসবে অংশ নিতে পারেন তার জন্যই এই ফিতরা প্রদানের অনন্য ব্যবস্থা। উল্লেখ্য, এমন চমৎকার ব্যবস্থা অন্যকোনও সমাজে দেখা যায় না। তবে যে মুসলনমান সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও সিয়াম পালন করে না সে হতভাগ্য বৈকি।
পবিত্র রমযানকে মুমিন মুসলমানদের প্রশিক্ষণের মাসও বলা হয়। এ মাসে তাঁরা সিয়াম পালনের সঙ্গে সঙ্গে বেশি বেশি ইবাদত-বন্দিগিতে মনোযোগী হন। কুরআন তিলাওয়াত এবং জাকাত-ফিতরা আদায়সহ দান-খয়রাতও করেন। ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাহরি ও সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতারগ্রহণ, এরপর তারাবিতে অংশ নেয়া সবই যেন মাসব্যাপী এক ট্রেনিং সেশনে থাকবার মতো ব্যাপার। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতেও মাসব্যাপী দীর্ঘক্ষণ অভুক্ত থেকে ইফতারের কিছুক্ষণ পরই তারাবির মতো দীর্ঘ সালাতে অংশ নেয়াতে রোযাদার বা সায়েমের দেহ-মন ঝালাই এবং নতুন করে কর্মক্ষম হয়। শরীরের জড়তা ও শৈথিল্য হয় দূরীভূত। ইবাদত-বন্দিগিতেও নতুন গতির সঞ্চার ঘটে। তাই রোযায় যেমন পারত্রিক কল্যাণ রয়েছে, তেমনই পার্থিব উপকারিতাও অনেক। এমন সুযোগ কে হাতছাড়া করে? মহান আল্লাহ যেন আমাদের কল্যাণময় সিয়াম পালনের তাওফিক দান করেন। আমিন!
রমযান মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা অন্য মাসের চেয়ে অধিক। কারণ এ মাসে সমগ্র মানবজাতির হিদায়াত আল কুরআন নাযিল হয়েছে। অন্য আসমানি কিতাবসমূহও রমযানেই নাযিল হয় বলে গবেষণায় জানা গেছে। এমনকি কুরআন শরিফেও রমযান ব্যতীত অন্য মাসের নাম উল্লিখিত হয়নি। তাই বোঝা যায় যে, কুরআন নাযিলের মাসটি অতীব জরুরি। পবিত্র রমযানে নাযিল বা অবতীর্ণ হওয়া কিতাব শুধু মুসলমানদের জন্য নয়। এটি সমগ্র মানবজাতির জন্য। বলা যায় এটি সর্বজনীন কিতাব। এ জন্যই কুরআনের দীন বা জীবনশৈলীকে বলা হয় পূর্ণাঙ্গ জীবনাদর্শ।
কুরআন নাযিলের এ মহিমান্বিত বরকতময় মাসে নিষ্ঠাবান মুসলমানরা সিয়াম পালন করেন। তারাবি সম্পন্ন করেন। যাকাতও দেন সামর্থবানরা। কিন্তু সমাজে অনেকরকম অনাচার, অবিচার চালু আছে, সেসব নিরসনে কেউ প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করেন না। একশ্রেণির মুসলমান আছেন, সিয়াম পালন করেন, আবার দোকানে বসে ওজনে কম দেন। ১০০ টাকার মালে ২০ টাকা লাভ করলে যথেষ্ট। কিন্তু তিনি লাভ করেন ১০০ টাকা। মানে ১০০ টাকার জিনিস তিনি ২০০ টাকায় বিক্রি করেন। মিথ্যা কথা বলে গ্রাহককে ঠকান। মালে ভেজান দেন। দুই নম্বরি করেন। এতে কি তার সিয়াম হয়? সিয়ামের যে দাবি তা পূরণ হয়? নিশ্চয়ই না।
প্রকৃত সিয়াম মানুষকে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করে যদি সে সিয়াম আন্তরিক হয়ে থাকে। আর যদি তা নামকা ওয়াস্তে বা লোকদেখানো হয় তাহলে সে সিয়াম বা রোযায় কোনও ফায়দা নেই। অবশ্য অনেক ইবাদত রয়েছে যেগুলো মানুষ দেখলে বোঝে। যেমন সালাত আদায়, দান-খয়রাত, হজ্জ সম্পন্ন করা। সব ইবাদত আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের জন্য হলেও উল্লিখিতগুলো লোকে দেখেন এবং মনে করেন যে, হ্যাঁ এ লোক একজন আবেদ। মসজিদে যান, দান-সাদকা করেন। কিন্তু সিয়াম এমন ইবাদত যা আল্লাহ ছাড়া অন্যরা তেমন টের পান না, কেউ সিয়াম বা রোযা পালন করছেন কি না। এটাই হচ্ছে অন্য ইবাদত ও সিয়ামের মধ্যে ফারাক। মানবজাতির হেদায়েতের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ কিতাব বা বিধানের জন্যই রমযানের গুরুত্ব ও মহিমা অধিকতর। এর যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করা সকল মুসলমানের একান্ত করণীয়। যারা তা না করে উল্টো এর অমর্যাদা করেন তাদের মতো দুর্ভাগ্য মানুষ আর নেই।
সিয়াম পালন মানে ভোররাত থেকে সূর্যাস্ত অবধি পানাহার ও স্বামী-স্ত্রীর সান্নিধ্য থেকে বিরত থাকবার নাম নয়। সায়েম বা রোজাদারের দায়িত্ব অনেক। একজন প্রকৃত সায়েম রাব্বুল আলামিনের হুকুমে দিনের বেলা পানাহার ও স্ত্রীসান্নিধ্য তথা দৈহিক মিলন থেকে দূরে থাকবার সঙ্গে সঙ্গে সকল প্রকার অশ্লীলতা, অপকর্ম, মিথ্যাচার, অবৈধ লেনদেন, চোগলখোরি, বাটপারি, মুনাফাখোরি, ষড়যন্ত্র থেকে বিরত থাকতে না পারলে সিয়াম পালনের সার্থকতা নেই।
কুরআন নাযিলের মাসে অনেক মুসলমানই সিয়াম পালন করেন। অথচ কুরআন শিখতে চান না। চেষ্টা করেন না। অথচ বিদেশে থাকা ছেলে অথবা স্বামীর চিঠি আসলে তা যতক্ষণ পড়া না হয় ততক্ষণ কারুর চোখে ঘুম আসে না। এই কুরআন মহান আল্লাহ পাঠিয়েছেন তাঁর বান্দাদের কাছে এর মধ্যে যা আছে তা অনুসরণ করে জীবনযাপনের জন্য।
যারা সিয়াম পালন করেন আবার মিথ্যা বলেন, ওজনে কম দেন, মুখ খারাপ করেন বা অন্যকে গালমন্দ করেন তাঁদের সিয়াম দুর্বল হয়। মকরু বা ত্রুটিপূর্ণ হয়। একজন মুসলমান অন্যের অকল্যাণ করা দূরে থাক তার চিন্তাও করতে পারেন না। অথচ আমাদের সমাজে সিয়াম পালন করা হয়, সালাত আদায় করা হয়, একটু পরপরই সুন্দর সুন্দর দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, মাদরাসাও অনেক। আলেম-ওলামাও অসংখ্য। কিন্তু ইসলামের প্রতিফলন নেই। হিংসা, বিদ্বেষ, ঝগড়া, মারামারি, কাটাকাটি বেড়েই চলেছে। কেন? কুরআন মানলে, সিয়াম পালন করলে এমনতো হবার কথা নয়।
মানুষের হেদায়াত ও সার্বিক কল্যাণের জন্য কুরআন নাযিল হয়েছে। মানুষের পক্ষে কী করলে ভালো আর কী না করলে ভালো এসবইতো রয়েছে কুরআনে। মানুষ কেন সৃষ্টি হয়েছে, কার ইবাদত করতে হবে, হালাল ও হারাম চিনিয়ে দেয়া হয়েছে মানুষকে। অর্থাৎ কুরআনের সবকথা মানুষকে নিয়ে। তাহলে মানুষ এই কুরআন শিখবে না কেন? জিনজাতির জন্যও এই কুরআন। তবে তাঁরা এর অমর্যাদা করে বলে আমরা জানি না। কুরআন অবমাননা করবার দুঃসাহস দেখায় হতভাগ্য মানুষ। অথচ এর প্রতিটা অক্ষরে অক্ষরেই রয়েছে মানবজাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধির অমিয় বাণী।
সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র রমযান। মহিমাময় বরকত, রহমত ও নাজাতের মাস এটি। এক দুর্বল হাদিসের সূত্র ধরে রমযানকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন কেউ কেউ। দেশের একজন বিশিষ্ট আলেম সেদিন এক টিভি চ্যানেলে বললেন এ বিভক্তি ঠিক নয়। রমযানের উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ সারা মাসব্যাপী বিরাজমান।
এ মাসে খোদাভীতি অর্জনের সাথে কুরআন নাযিলের এই মাসকে কুরআন শিক্ষার মাস হিসেবেও গণ্য করা যেতে পারে। কুরআন শিখতে পারি আমরা সব বয়স ও শ্রেণির মানুষ। এ মাসে কোনও আলেম বা ইমামের কাছে একটু একটু করে শিখলেও এর অনেকখানি শিক্ষা হয়ে যেতে পারে। এজন্য ব্যক্তিগত চেষ্টা ও উদ্যোগ থাকলেই যথেষ্ট। কুরআনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যাতে সুদৃঢ় এবং আরও নিবিড় হয় সে দিকে নজর দিতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ