শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

জলাবদ্ধ রাজধানী

গত রোববার রাত থেকে সোমবার সন্ধ্যারও পর পর্যন্ত দু’দিনের বৃষ্টি ও বৃষ্টির পানি রাজধানী মহানগরীকে অচল ও স্থবির করে ফেলেছিল। মওসুমী বায়ুর প্রভাবে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে বৃষ্টি হয়েছে সারা দেশেই। রাজধানীতে তাই বলে অঝোর ধারায় বর্ষণ হয়নি, হাল্কা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হয়েছে- যার মোট পরিমাণ ১৩৩ মিলিলিটার বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। কিন্তু মাত্র এটুকু বৃষ্টিতেই রাজধানী ঢাকা পানিতে ডুবে গিয়েছিল। দৈনিক সংগ্রামসহ বিভিন্ন  গণমাধ্যমের সচিত্র রিপোর্টে জানানো হয়েছে, এমন কোনো এলাকার কথা বলা যাবে না, যেখানে দুই থেকে তিন-চার ফুট পর্যন্ত পানি না জমেছিল। পানিতে ডুবে গিয়েছিল অলি-গলিও। কোনো এলাকার রাজপথেই স্বাভাবিকভাবে গাড়ি চলাচল করতে পারেনি। সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও প্রাইভেট কার তো বটেই, যাত্রীবাহী বাসও অচল হয়ে পড়েছে যেখানে-সেখানে। মানুষের পক্ষে হেঁটে যাওয়াও সম্ভব হয়নি। কারণ পানি ছিল অবিশ্বাস্য রকমের নোংরা ও বিষাক্ত। ফলে যারা যে কাজেই বাইরে বেরিয়েছিলেন তাদের প্রত্যেককে বিপদে পড়তে হয়েছিল। কোথাও কোথাও মানুষকে একই জায়গায় দু’তিন ঘণ্টা পর্যন্ত আটকে থাকতে হয়েছে। আধ ঘণ্টার পথ অনেকে পাড়ি দিয়েছেন চার-পাঁচ ঘণ্টায়। বহু মানুষকে রাস্তায় পানি দিয়ে কোনোভাবে ইফতার করতে হয়েছে, তারা গভীর রাতের আগে বাড়িতে ফিরতে পারেননি। অ্যাম্বুলেস চলাচল করতে পারেনি বলে গুরুতর অসুস্থদেরও হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হয়নি।
অর্থাৎ সব মিলিয়েই এ দু’দিন রাজধানীর অবস্থা হয়েছিল অত্যন্ত শোচনীয়। বলা যায়, বৃষ্টির পানিজটে পুরো ঢাকা মহানগরীই আসলে অচল হয়ে পড়েছিল। ভয়াবহ এই পানিজটের কারণ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই গবেষণা ও মতামত প্রকাশের পালা শুরু হয়েছে। ওয়াসা এবং দুই সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তো উঠেছেই, প্রাধান্যে এসেছে অন্য কিছু কারণও। এসবের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেলের কথা বলেছেন সকলেই। এগুলোর কারণে মালিবাগ, মৌচাক ও মগবাজার থেকে মিরপুরের বিভিন্ন এলাকার নাগরিকরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু কোনোটিরই কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেলের পাশাপাশি এসেছে অপরিকল্পিত নগরায়নের কথা। শত শত পুকুর ও খাল ভরাট করে বহুতল ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ, ভবনের আশপাশে মাটির নিচে প্রাকৃতিক নিয়মে পানি নেমে যাওয়ার মতো যথেষ্ট জায়গা না রাখা, পলিথিনসহ নানা ধরনের আবর্জনা জমে গিয়ে ড্রেনগুলো সংকুচিত হয়ে পড়ার মতো অনেক কারণ নিয়েই সাধারণ মানুষের মধ্যে জোর অলোচনা চলছে। বিশেষজ্ঞরাও নতুন পর্যায়ে এগিয়ে এসেছেন তাদের অভিমত এবং সরকারের করণীয় সম্পর্কে জানাতে। 
রাজধানী জলাবদ্ধতায় স্থবির হয়ে পড়ার বিষয়টিকে আমরা যথেষ্ট আশংকাজনক মনে করি। ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যার এই দেশে মাত্র মাত্র দু’দিনের বৃষ্টিতেই পুরো রাজধানী নোংরা পানিতে তলিয়ে যাবে, অচল ও স্থবির হয়ে পড়বে এবং মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তির শেষ থাকবে না- এমন অবস্থা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এমন অবস্থা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু বাস্তবে সেটাই ঘটেছে। একই কারণে পানিজটের বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে জানানো এবং সমাধানের পথ খোঁজা দরকার। খাল ও পুকুর দখলের পাশাপাশি ভরাট করে ভবন ও স্থাপনা নির্মাণকে দায়ী করে দেয়া বিভিন্ন মহলের বক্তব্যকে আমরাও প্রধান একটি কারণ বলে মনে করি। খাল ও পুকুর দখলের এই অভিযানকে অবশ্যই প্রতিহত করতে হবে। এ ব্যাপারে শুধু ব্যক্তি বা বিভিন্ন গোষ্ঠীকে দায়ী করে লাভ নেই। কারণ, সরকারের পক্ষ থেকেও ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ কম নেয়া হয়নি। একটি উদাহরণ হিসেবে পুরনো ঢাকার ধোলাই খালের কথা উল্লেখ করা যায়। শত বছর ধরে বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে মিশে থাকা এ খালটিকে বক্স কালভার্ট নির্মাণের নামে প্রকৃতপক্ষে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। পানি প্রবাহিত হওয়ার জন্য কালভার্টের ভেতরে অন্তত ১৫ থেকে ২০ ফুট জায়গা ফাঁকা থাকার কথা থাকলেও অব্যবস্থাপনার কারণে ময়লা-আবর্জনা জমতে জমতে তিন-চার ফুট জায়গাও এখন ফাঁকা নেই। ফলে এর ভেতর দিয়ে পানিও যেতে পারে না। অথচ আগে এই ধোলাই খাল দিয়েই বৃষ্টির বেশিরভাগ পানি বুড়িগঙ্গা নদীতে গিয়ে পড়তো।
রাজধানীর স্যুয়ারেজ বা পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার দিকেও লক্ষ্য করা দরকার। পলিথিনসহ নানা আবর্জনায় ড্রেনগুলো আটকে যাওয়ার কথা সরকারের অবশ্যই জানা রয়েছে। কিন্তু আবর্জনা সরিয়ে ফেলার জন্য ওয়াসা বা দুই সিটি করপোরেশনের কারো পক্ষ থেকেই ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানা যায়নি। এরকম আরো কিছু কারণ থাকলেও আমরা মনে করি, সেগুলোর উল্লেখের পরিবর্তে পানিজটের বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে দেখা দরকার। লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে আর কোনো খাল বা পুকুর দখল ও ভরাট করা না হয়। বাধাহীন পানি প্রবাহের জন্য ধোলাই খালের বক্স কালভার্টের পাশাপাশি রাজধানীর কোনো ড্রেনেই আবর্জনা জমতে দেয়া যাবে না। এগুলোকে নিয়মিতভাবে পরিষ্কার করতে হবে। ওয়াসা, তিতাস এবং দুই সিটি করপোরেশনসহ রাস্তা খোঁড়াখঁড়ির দায়িত্বে নিয়োজিত সকল সংস্থার কাজে সমন্বয় করাটাও জরুরি হয়ে পড়েছে। ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজও অবিলম্বে শেষ করা দরকার। সব মিলিয়ে আমরা চাই, রাজধানীতে আর কখনো যাতে গত দু’দিনের স্থবিরতা ও দুর্ভোগের পুনরাবৃত্তি না ঘটতে পারে। বিষয়টি বেশি গরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, জ্যৈষ্ঠের শেষে আষাঢ় মাস শুরু হচ্ছে। সামনে রয়েছে শ্রাবণ মাস। সুতরাং বৃষ্টি যেমন প্রচুর হতে পারে তেমনি এখনই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেয়া হলে রাজধানী আবারও যে কোনো সময় স্থবির হয়ে পড়তে পারে। বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটার আগেই সরকার তথা ওয়াসা এবং দুই সিটি করপোরেশনের দ্রুত তৎপর হয়ে উঠা উচিত।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ