শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

জ্বালানি বিষয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনা পরিবেশ অর্থনীতি কোন দিকেই গ্রহণযোগ্য নয়

 

স্টাফ রিপোর্টার : জ্বালানি বিষয়ে সরকার যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তা পরিবেশ ও অর্থনৈতিক কোন দিকেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিষেশজ্ঞরা। গতকাল সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র উদ্যোগে সারাবিশ্বে উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে ‘বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের উত্তরণ প্রক্রিয়ার মূল্যায়ন’ শীর্ষক এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে। 

 এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক বদরুল ইমামের সভাপতিত্বে এতে মূল বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে সফররত ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিক্স এন্ড ফিনেন্সিয়াল এনালাইসিস (IEEFA, Sydney)র আন্তর্জাতিক জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ মি. টিম বাক্লি (Mr. Tim Buckley, Director, Energy Finance Studies, Australasia) ও মি. সাইমন নিকোলাস (Mr. Simon Nicholas, Energy Finance Analyst)। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট লেখক-বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ, স্থপতি মোবাশে^র হোসেন, তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, শরীফ জামিল প্রমুখ। অন্যদের মধ্যে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক এম এম আকাশ-সহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।

মূল বক্তব্যে টিম বাক্লি বলেন, গত দশকে জার্মানির নেতৃত্বের উপর নির্ভর করে, চীন এবং সম্প্রতি ভারত একসাথে একটি নিম্ন নির্গমন অর্থনীতি চালনা করার জন্য নতুন, স্বল্পব্যয়ী এবং সাশ্রয়ী প্রযুক্তি অর্জনের জন্য জ্বালানি খাতের রূপান্তরের বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। এই বিনিয়োগের প্রবণতাগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের শক্তিশালী সমর্থন এবং সুদৃঢ় অনৈতিক ভিত্তি দ্বারা প্রভাবিত হয় যা এখন বহুল আলোচিত এবং বাজার প্রতিযোগিতামূলক। পানি ও খাদ্য নিরাপত্তার সাথে জ্বালানি নিরাপত্তা সকল সরকার ও রাষ্ট্রের জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত বিষয়। একটি আমদানি নির্ভর, দূষণকারী তাপবিদ্যুৎ ব্যবস্থার চেয়ে একটি বৈচিত্রময়, অভ্যন্তরীণ এবং টেকসই জ্বালানি সরবরাহ অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক।

আইইইএফএ-এর জ্বালানি অর্থনীতি গবেষণার পরিচালক টিম বাক্লি বলেন, চীন বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে এবং উৎপাদনও প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। সৌর বিদ্যুৎ খরচ গত দুই বছরে ৫০% কমে গিয়েছে, এবং ব্যাটারি সিস্টেমের ২০% বার্ষিক খরচ হ্রাস পাওয়ায় ১২-২৪ মাস আগে অনুমোদিত কোন বিদ্যুৎ প্রকল্পের নকশা আজ অনুপোযোগী। ২০১৬ সনে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিশ্বব্যাপী প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে ১৬০ গিগাওয়াট-এ পৌঁছানোর পর, নবায়নযোগ্য জ্বালানী তাপবিদ্যুৎ জ্বালানীকে পছন্দের বিদ্যুৎ অবকাঠামোর বিনিয়োগ হিসেবে অতিক্রম করেছে। বিশ্বব্যাপী শীর্ষ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত ক্রমাগত মালিকানাহীন সম্পদ এবং জলবায়ু নীতির ঝুঁকিকে বিবেচনায় নিয়েছে; নরওয়ের এসডব্লিউএফ, ব্ল্যাকরক, এক্সাএসএ, সুইসরে, ডিউশব্যাংক ও ওয়েস্টপ্যাক এর সাম্প্রতিক পদক্ষেপের সমূহের সাক্ষী। তিনি জানান, মে ২০১৭ সালে সৌরশক্তি প্রথমবারের মতো ভারতের অভ্যন্তরীণ কয়লাশক্তি থেকে স্বল্পব্যয়ী হয়ে ওঠে। সৌরশক্তির শুল্ক ২.৪৪ রুপি/ইউনিট (০.০৩৮ ইউএসডি/ কিলো ওয়াট ঘণ্টা) এক মে আসে, যা গড় ৩.৩০ রুপি/কিলোওয়াট ঘণ্টা থেকে উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। ২০১৬/১৭ এর জন্য ভারতের সর্ববৃহৎ কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, এনটিপিসি লিমিটেড এই দামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন ভারতীয় সৌরশক্তির শুল্ক ফিনল্যান্ডের ফোর্টামের স্বীকৃতি প্রাপ্ত ৪.৩৪ রুপি/কিলোওয়াট ঘণ্টা থেকে ৪৪% নেমে আসলে দাড়ায় ২.৪৪ রুপি/কিলোওয়াট ঘণ্টা। মে ২০১৭, ভারতীয় বায়ু শক্তি শুল্ককে ২০-৩০% কমে ৩.৪৬ রুপি/কিলোওয়াট ঘণ্টাতে নেমে আসতে দেখা যায়। এই সাফল্য উপভোগের সুযোগ বাংলাদেশের কাছে স্পষ্ট।

সাইমন নিকোলাস- বাংলাদেশের জ্বালানি রূপান্তর বিষয়ে বলেন, বর্তমানে বিশ্বব্যাপি চলমান বিদ্যুৎখাত রূপান্তরের সুষ্ঠু সম্ভাবনা গ্রহনের সুযোগ বাংলাদেশের কাছে রয়েছে। চলতি দশকে অর্থনীতির উন্নয়ন এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন/গ্রিডসিস্টেম দ্বিগুন হওয়ায় বাংলাদেশের সুসংহত উন্নয়নের ভিত্তি পুনর্বিন্যস্ত করার সুযোগ রয়েছে। ২০১৬ সালের নভেম্বরে আইইইএফএ তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশর বিদ্যুৎ ব্যবস্থার জন্য একটি ভবিষ্যৎ পথ অনুকরণে সুপারিশ প্রকাশিত করেন, যা বিশ্বব্যপী দ্রুতবর্ধনশীল। প্রতিবেদনটির শিরোনামহলো: বাংলাদেশের বিদ্যুৎ রূপান্তর: একটিবৈচিত্র, নিরাপদ, সাশ্রয়ীপন্থা। আইইইএফএ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, যথাযথ নীতিমালা নির্ধারণ করে, গৃহস্থালী সৌরশক্তির সাথে প্রতিবেশী দেশ গুলো থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুৎ শক্তি, বাণিজ্যিকভাবে অধিক কার্যকরী। আমদানিকৃত বিদ্যুৎব্যবস্থা যা জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীল, তার একটি অগ্রাধিকারযোগ্য বিকল্প হলো গৃহস্থলী সৌরশক্তির সাথে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুৎশক্তি। আইইইএফএ-র শক্তি আর্থিক বিশ্লেষক সাইমন নিকোলাস বলেন, বাংলাদেশ একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ, তবে এটি গুরুত্বপূর্ণ যে এর বৈদ্যুতিক খাতে যেন একুশ শতকের উন্নয়ন দেখা যায়। বর্তমান বিংশ শতাব্দির উন্নয়ন পরিকল্পনা যা আমদানিকৃত কয়লা, এলএনজি এবং পারমানবিক শক্তির উপর নির্ভরশীলতা বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাপী পিছিয়ে ফেলবে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ব্যয় বহুগুণ উন্নয়নের আরেকটি পর্যায়ের প্রয়োজন হবে। আমদানিকৃত জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীল কোন ব্যবস্থা অর্থনৈতিক ঝুঁকি বৃদ্ধি করে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা হ্রাস করে, যা উন্নয়নশীল কোন দেশের জন্য অগ্রহণযোগ্য। আইইইএফএ- র বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনের মডেল বৈচিত্রপূর্ণ এবং ২০২৫ সাল পর্যন্ত নিরাপদ যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পক্ষে সহায়ক। সারা বিশ্বে সৌরশক্তি থেকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ অর্থ ও দক্ষতা, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন আনুপাতিক হারে উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি করবে যা প্রকৃতপক্ষে গৃহস্থালী এবং জ্বালানি আমাদানীর উপর নির্ভরশীল নয়। যদিও কিছু ভূমি ব্যবহারের স্পষ্ট সীমাবদ্ধতা, তবে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যিক ও শিল্প উভয় ক্ষেত্রেই ছোট আকারের সৌর পিভি অবকাঠামো নিমার্ণ এবংসেচ সৌর পাম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। 

নিকোলাস উল্লেখ করেছেন, সৌরশক্তির আরেকটির বড় সুবিধা হলো এটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নির্মাণ করা যায়। জীবাশ্ম জ্বালানি ও পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দীর্ঘস্থায়ী নির্মাণ কাজের মুখোমুখি হয়। অব্যাহত বিলম্বের মানে হচ্ছে যে, সৌরশক্তি বাংলাদেশের নিকটতর ভবিষ্যতের বর্ধিত বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের জন্য উপযুক্ত। দেশের দ্রুততর উন্নয়নের সাথে, ক্রমবর্ধমান খরচ কার্যকর নবায়ন যোগ্যশক্তি এবং শক্তি দক্ষতা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে বৈচিত্র্যময় ও সুরক্ষিত করে অনৈতিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, প্রযুক্তির অগ্রগতি বেড়ে যাচ্ছে, তাই নতুন যে প্রযুক্তি নিয়ে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে তা আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে। সনাতনী পদ্ধতি থেকে আমাদেরকে বেড়িয়ে আসতে হবে। রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সুন্দরবনের ক্ষতি করবে, যার বৈজ্ঞানিক সত্যতা রয়েছে। তাই কয়লা ভিত্তিক প্রকল্প থেকে সরে এসে সৌর জ¦ালানি উন্নয়নে পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানান। 

সৈয়দ আবুল মকসুদ, গণমুখী জ¦ালানি নীতি গ্রহণের আহবান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ প্রথাগতভাবে কৃষিভিত্তিক, যা থেকে গত কয়েক দশকে শিল্পভিত্তিক হতে যাচ্ছে। যার কারণে বিদ্যুৎ-জ¦ালানি নির্ভরতা বেড়েছে । বিদ্যুৎ আমরা চাই, তবে এজন্য পরিবেশ সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন একসাথে হতে হবে। তা না হলে ভারসাম্য রক্ষা হবে না। শুধু উন্নয়ন নয়, জনবান্ধব উন্নয়ন হতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিবেশ ও মানবতার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। একে ব্যবসা বান্ধব না ভেবে জনবান্ধব হিসেবে বিবেচনায় রাখতে হবে। বিদ্যুৎ এর দাম জনগণের সক্ষমতার মধ্যে রেখে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা মেনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তিনি, সঠিক তথ্য জনগণের নিকট তুলে ধরার জন্য সংবাদ মাধ্যমের প্রতি আহবান জানান।

স্থপতি মোবাশে^র হোসেন বলেন, বিশ্ব যেমন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। তেমনি আমাদের সম্ভাবনাগুলোকেও সঠিক পরিকল্পনায় নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নয়নের চিন্তায় আনতে হবে। সৌর জ¦ালানি উৎপাদনে আমাদের যে সম্ভাবনা রয়েছে তা কাজে লাগাতে হবে। কারণ সৌর জ¦ালানির দাম আগের তুলনায় অনেক কমে আসছে, অন্যদিকে এটি পরিবেশ বান্ধব।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, চীন-ভারত-জার্মানীসহ সারাবিশ্ব আজ সৌর জ¦ালানির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারত তাদের দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে এসে ২০২১ সালে ১ লক্ষ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অথচ তাদের দেশে যেটা বন্ধ করা হচ্ছে, সেটা আমাদের দেশে চাপিয়ে দিচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করে বিশ্ব যেখানে সামনের দিকে হাঁটছে, সেখানে বাংলাদেশ পিছনের দিকে হাঁটছে বলে মনে হচ্ছে, যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তার বিষয়। তিনি বলেন, জ্বাালানি বিষয়ে সরকার যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তা পরিবেশ ও অর্থনৈতিক কোন দিকেই গ্রহণযোগ্য নয়। কোন স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে হয়তো সরকার ভুল পথে এগুচ্ছে। বাংলাদেশে কম দামে পরিবেশবান্ধব সৌর জ¦ালানি গ্রহণের যে সুযোগ রয়েছে তা গ্রহণের আহবান জানান তিনি। 

শরীফ জামিল বলেন, সরকার বর্তমানে যে বিদ্যুৎ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তা ২০১০ সালের পরিকল্পনা। বর্তমানে সারাবিশ্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব আজ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ পরিকল্পনা থেকে দ্রুত সরে আসছে। অথচ আমাদের দেশ পুরানো পদ্ধতি নির্ভরতা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, কয়লায় যে তেজস্ক্রিয়তা রয়েছে তা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকী। তাই সনাতনী পদ্ধতি থেকে সরে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে পরিবেশ ও জনবান্ধব পরিকল্পনা গ্রহণের আহবান জানান তিনি। পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো জনগণের নিকট প্রচারের জন্য তিনি সংবাদ মাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানান।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ