শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ট্রাম্পের জিএসপি সুবিধার তালিকায় নেই বাংলাদেশ

এইচ এম আকতার : তৈরি পোশাক খাতে রানা প্লাজার ক্ষত এখনও শুকায়নি। এই ঘটনায় ওবামা প্রসাশনের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা (জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স) বা জিএসপি বাতিলের সিদ্ধান্ত ট্রাম্প প্রশাসনও বহাল রেখেছে। নতুন জিএসপির তালিকায় নেই বাংলাদেশের নাম। সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ না থাকার অভিযোগে ২০১৩ সালে ওবামা প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধায় স্থগিত করে। এতে করে প্রতিকূলতার মুখে পড়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। জিএসপি ফিরে পেতে সরকার সরকার নানাভাবে লবিং করলেও তাতে সুফল পায়নি বাংলাদেশ।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বার্ষিক পর্যালোচনা শেষে জিএসপি সুবিধা প্রাপ্ত দেশগুলোর নাম ও পণ্যের নামের তালিকা নতুন করে প্রকাশ করে। যেখানে নেই বাংলাদেশের নাম। অন্যদিকে সুবিধা পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, একুয়েডর, তুরস্ক, পাপুয়া নিউগিনি, পাকিস্তান, মিসর ও কাজাখস্থান। 

নতুন জিএসপি কার্যক্রমের আওতায় ১ জুলাই থেকে সুবিধা পাচ্ছে দেশগুলো। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের কর্ম পরিবেশের দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের সুবিধাটি স্থগিত করা হয়েছিল।

সুবিধা পাওয়া পণ্যের তালিকায় তৈরি পোশাক না থাকায় দীর্ঘ মেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব এখনও অব্যাহত রয়েছে। এ প্রভাব আরও কত বছর থাকবে তা বলা যাচ্ছে না। এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের শ্রমমান নিয়ে বিশ্বজুড়ে ভাবমূর্তির সংকট তৈরি করছে, যাতে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ ব্যাহত হচ্ছে। তবে এসব সমস্যা অনেকাংশই কেটে উঠেছে বাংলাদেশ। কিন্তু তার পরেও এ সিদ্ধান্ত এখনও বহাল রয়েছে।

ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) প্রভাবিত না করায় সংকটের হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশ। কারণ, বাংলাদেশ ইইউর দেশগুলোতে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে জিএসপি সুবিধা এখনও অব্যাহত রয়েছে। গত বছর বাংলাদেশ দুই হাজার কোটি ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। আর পোশাক রপ্তানির বড় অংশটাই যায় ইউরোপের দেশগুলোতে।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের অবাধ বাজার-সুবিধা স্থগিত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে লবিং করলেও কোন সুফল পায়নি বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিজিএমইএ) এ সিদ্ধান্তকে মার্কিন প্রশাসনের ‘বাড়াবাড়ি রকমের প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে অভিহিত করেছে। 

বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন,রানা প্লাজার ঘটনার পরে একার্ডের পক্ষ থেকে নানা সংস্কার করা হয়েছে। কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন চালু করা হয়েছে। ঝুকিপূর্ন ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন আর জিএসপি না দেয়ার কোন কারন নেই।

তবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন,কর্মপরিবেশ নয় এটি রাজনৈতিক কারনেই বাতিল করা হয়েছে। আমরা তাদের দেয়া সব শর্ত পূরন করলেও কোন লাভ নেই। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া এটি বহাল হবে না। তবে ট্রাম্প প্রশাসনও এটি বহাল রেখেছে এটি অভাক লাগছে।

শুধু তৈরি পোশাকই নয় যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপির আওতায় রয়েছে সিরামিকও। গত অর্থবছরে জিএসপির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে প্রায় ৩৩০ কোটি টাকার সিরামিক রপ্তানি করা হয়েছে। মোট রপ্তানির ২৫ শতাংশ গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কখনো যুক্তরাষ্ট্রে সরাসরি, কখনো আবার ইউরোপের ক্রেতাদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সিরামিকের পণ্য রপ্তানি করে। যুক্তরাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশ সিরামিক রপ্তানি করা হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে লিবে, মেসি, ক্রেইট অ্যান্ড ব্যারেল, ব্লুমিংডেইলস, জেসিপেনি, লেনক্স, মার্থা স্টুয়ার্ট হোম ও পুসা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিরামিক ওয়্যার ম্যানুফেকচারিং এসোসিয়েশনের মহাসচিব রিজভী উল কবির বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ, কারখানার শ্রমমান নিয়ে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, তা সিরামিক কারখানাগুলোর জন্য প্রযোজ্য নয়। বরং আমাদের ক্রেতারা বাংলাদেশের কারখানার কর্মপরিবেশের প্রশংসা করে থাকেন। কাজেই বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই মার্কিন ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা আমাদের আশ^াস দিলেও তার কোন সুফল দেখছিনা। ওবামা প্রশাসন জিএসপি সুবিধা বাতিল করলেও ট্রাম্প প্রশাসনও এটি বহাল রেখেছে। তাদের এ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত দুংখজনক।

বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি ফজলুল হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিত হওয়াটা আমাদের জন্য যুগপৎভাবে দুঃখজনক ঘটনা বড় ধরনের ধাক্কা। এ ধাক্কা আমরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সরকারের পক্ষে থেকে নানাভাবে লবিং করা হচ্ছে। তারা আমাদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আশ^াসও দিয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনও এটি বহাল রেখে প্রমান করেছে জিএসপি বাতিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।এর ফলে বাংলাদেশের জন্য নানাবিধ চাপ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিযোগীরাও পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে। 

বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাশের দেশ কানাডা মার্কিন নীতি ও সিদ্ধান্তের কারণে প্রভাবিত হয়েছে। কারণ, কানাডার বাজারে আমাদের তৈরি পোশাক শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রভাব ফেলতে পারিনি। সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি স্থগিতকে কেন্দ্র করে আতঙ্কিত পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তা আমরা কাটিয়ে উঠেছি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যথাযথ সময়ে যথোপযুক্ত মনোযোগ, দক্ষতা ও মেধা দিয়ে শ্রমমান নিয়ে মার্কিন আপত্তির বিষয়গুলোকে মোকাবিলা করা হয়নি। একারনেই তারা আমাদের পণ্যের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছিল। কিন্তু আমরা এ অবস্থা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছি। ট্রাম্প প্রশাসন চাই তা প্রত্যাহার করতে পারতো। কিন্তু কি কারনে তা জিএসপি সুবিধা স্থগিত বহাল রাখলো তা আমার বুঝে আসে না। তবে সরকারের উচিৎ হবে ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করা। তা হলে এটি উঠে যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য-সুবিধা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ৭৪-এর বাণিজ্য আইন অনুযায়ী জিএসপি চালু হয়। ১৯৭৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এটি কার্যকর হয়। জিএসপির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচ হাজার পণ্য রপ্তানির সুযোগ পায় উন্নয়নশীল দেশগুলো। আর বাংলাদেশ এ সুবিধার আওতায় মূলত সিরামিক পণ্য, চশমা, তাঁবু, প্লাস্টিক ব্যাগ, উলের তৈরি পাপশ ও শতরঞ্জি যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে থাকে।

অন্যদিকে ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৪০ কোটি ডলার। জিএসপি সুবিধা বাতিলের কারনে বানিজ্য ঘাটতি দিন দিন বেড়েই চলছে।

শ্রমিকের স্বার্থ সুরক্ষা ও কর্মপরিবেশের নিরাপত্তাজনিত শর্ত পূরণে ব্যর্থতার কারণে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের জিএসপি প্রত্যাহারের দাবি জানায় আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার এন্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশনের (এএফএল-সিআইও)। পোশাক কারখানায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা, অবনতিশীল শ্রম পরিস্থিতি ও শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকাণ্ড (পাঁচ বছর পর যার সুরাহা হয়নি) নিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের উদ্বেগ বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের শেষ প্রান্তে এসে বাংলাদেশের শ্রমমান নিয়ে পর্যালোচনার প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চার হয়। শেষ পর্যন্ত ওবামা প্রশাসন এএফএল-সিআইওর পিটিশনটি এবার গ্রহণ করে। ২০১২ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের জিএসপি বাতিলের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। এএফএল-সিআইওর আবেদনের পর বাংলাদেশের শ্রমমান নিয়ে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে চার দফা শুনানি হয়েছে। আর এসব শুনানিতে বাংলাদেশের বক্তব্য শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রশাসনকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে গত ২৮ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক আদেশে বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিত করেন। 

বাংলাদেশ সরকার মনে করেছিল যুক্তরাষ্ট্রে নতুন কোন প্রশাসন এলই হয়তো এই স্থগিতাদেশ বাতিল হবে। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন এটি বহাল রেখে প্রমান করলো মার্কিন সরকার পরিবর্তন হলেই স্বার্থে ব্যাপারে পররাষ্ট্র নীতি পরিবর্তন হয়না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ