বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বেনাপোলে সোনা পাচারের রমরমা ব্যবসা

# কাস্টমস বিজিবি গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি
খুলনা অফিস : গত পাঁচ মাসে এ সীমান্ত থেকে ১৬ কেজি ২শ’ গ্রাম সোনা উদ্ধার করেছে বিজিবি এবং কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে রীতিমত উদ্বিগ্ন কাস্টমস, বিজিবি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, ভারতে সোনার দাম বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক চোরাচালানীরা বেনাপোলের সীমান্তপথে সোনা পাচার করছে। এছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার দূরত্ব বেনাপোল সীমান্ত থেকে মাত্র ৮৪ কিলোমিটার এবং যাতায়াত ব্যবস্থা সুবিধাজনক হওয়ায় স্বর্ণ চোরাচালানীরা এ রুটকে নিরাপদ মনে করছে।
সূত্র জানায়, ১৯৮০ থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত ১০ বছর যশোর ও বেনাপোলে ছিল সোনা পাচারের রমরমা ব্যবসা। পাচারের কৌশল ছিল সড়ক পথে হাতে হাতে সীমান্তের চোরা পথ দিয়ে। এ সময় যশোরে সোনার বার ছিনতাই ও পুলিশ কর্তৃক আত্মসাতের ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পাচারের এ ব্যবসায় ভাটা পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় ভারতে সোনা পাচার। কিন্তু এর ২৭ বছর পর ফের শুরু হয়েছে ভারতে সোনা পাচার। আন্তর্জাতিক রাঘব বোয়ালরা বর্তমানে ভারতে সোনা পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে বেনাপোল চেকপোস্টসহ বিভিন্ন সীমান্ত। চলতি বছরের শুরু থেকেই এ রুট দিয়ে কাড়ি কাড়ি সোনা পাচার হচ্ছে। যদিও এসব পাচারকারীদের সাথে পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরের টাকার চুক্তি রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। আর এ খবর প্রকাশ পাওয়ায় এখন ধরা পড়ছে কেজি কেজি সোনা।
সীমান্তের একটি সূত্র জানায়, গত ৫ মাসে প্রায় সাড়ে ১৬ কেজি সোনা আটক হলেও প্রতিদিন পাসপোর্ট যাত্রী এবং চোরাচালানীদের মাধ্যমে কেজি কেজি সোনা ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। আর পাচারকৃত এ সোনা চারবার হাত বদল হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অদৃশ্য সহযোগিতায় ঢাকা থেকে ৪ বার হাত বদল হয়ে সোনা পাচার হয় ভারতে। সূত্র জানায়, প্রথমত ঢাকা থেকে ট্রেন অথবা বাসে একটি গ্রুপ সোনা নিয়ে সোজা বেনাপোলে আসে। এরপর পরিবহন কাউন্টার অথবা তাদের নির্ধারিত স্থানে সোনার চালানটি বদল হয় স্থানীয় এজেন্টদের হাতে। স্থানীয় এজেন্টের বহনকারীরা সোনার চালানটি নিয়ে চলে যায় গাতিপাড়া, দৌলতপুর বা পুটখালী সীমান্তের কোন বাড়িতে। সেখান থেকে হাত বদল হয় শুধুমাত্র সীমান্ত পার করে ভারতীয় এজেন্টর হাতে পৌঁছানোর জন্য। আর এর সাথে জড়িত রয়েছে পুলিশ প্রশাসনসহ উঁচু মার্গের জনপ্রতিনিধিরা। এছাড়া, ঢাকার আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালানীরা তাদের এজেন্টদের সরাসরি ব্যবহার করে পাসপোর্টে বৈধ প্রক্রিয়ায় সোনা গোপনে লুকিয়ে রেখে ভারতে পাচার করছে। এ কাজের এখন প্রধান নিরাপদ রুট বেনাপোল চেকপোস্ট ও বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা। গত পাঁচ মাসে এ সীমান্ত থেকে ১৪৬ পিস স্বর্ণের বার বা ১৬ কেজি ২শ’ গ্রাম ওজনের সোনাসহ ১০ পাচারকারীকে গ্রেফতার করেছে বিজিবি এবং কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ।
বিজিবি ও কাস্টমস বিভাগের তথ্য জানা যায়, গত ১২ ফেব্রুয়ারি বেনাপোলের দৌলতপুর বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা বড়আঁচড়া গ্রামের বজলুর রহমানকে ১৪ পিস সোনার বারসহ গ্রেফতার করে। ৪ মার্চ একই ক্যাম্পের সদস্যরা গাতিপাড়া গ্রামের টিটু বিশ্বাসকে ২০ পিস সোনার বারসহ গ্রেফতার করে। বেনাপোল বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা ১ এপ্রিল শামীম হোসেন এবং হোসেন আলীকে ১৫ পিস সোনার বারসহ গ্রেফতার করে, ২৭ মে দৌলতপুর ক্যাম্পের বিজিবি সদস্যরা ২ কেজি ৩শ’ গ্রাম ওজনের ২০টি সোনার বারসহ বড়আঁচড়া গ্রামের মনিরুজ্জামানকে গ্রেফতার করে, পুটখালী ক্যাম্পের বিজিবি সদস্যরা ৩০ মে মনির হোসেনকে ১০ পিস সোনার বারসহ গ্রেফতার করে, এ বছরের ৫ জুন পুটখালী বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা বাবুল হোসেনকে ১০টি সোনার বারসহ গ্রেফতার করে।
এদিকে, পাসপোর্ট যাত্রীদের মাধ্যমে সোনা পাচারের সময় ১১ জুলাই নারায়ণগঞ্জের আবু সালামকে বেনাপোলের বিপরীতে ভারতের হরিদাসপুর আইসিপি’র কাস্টমস সদস্যরা ২০ পিস সোনার বারসহ আটক করে। যার ওজন ২ কেজি ৩শ’ গ্রাম। বাংলাদেশী পাসপোর্ট যাত্রী ভারতে সোনাসহ গ্রেফতারের পর বেনাপোল চেকপোস্ট কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। বর্হিগমন চেক পয়েন্টের স্ক্যানিং মেশিনটি দ্রুত মেরামত করে চালু করা হয়। আর পরদিন ১২ জুলাই বেনাপোল কাস্টমস হাউসের শুল্ক গোয়েন্দারা চেকপোস্ট এলাকা থেকে ভারতগামী পাসপোর্ট যাত্রী পারভেজকে ৭ পিস সোনার বারসহ গ্রেফতার করে। গত ১৪ জুলাই পাসপোর্ট যাত্রী জালাল আহমেদ সেলিমকে ৫ পিস সোনার বিস্কুটসহ চেকপোস্ট থেকে শুল্ক গোয়েন্দারা গ্রেফতার করে। ১৫ জুলাই ২ কেজি ৭শ’ ৫০ গ্রাম ওজনের ১১ পিস সোনার বারসহ পাসপোর্ট যাত্রী ঢাকার ওয়ারি এলাকার রুখসানা বেগমকে শুল্ক গোয়েন্দারা গ্রেফতার করে। তার মাজায় বাঁধা ও ভ্যানেটি ব্যাগে সোনার এ বারগুলি ছিল। সর্বশেষ ১৭ জুলাই মুন্সিগঞ্জ এলাকার টুঙ্গিবাড়ি গ্রামের সেলিম হাওলাদারকে ৫ পিস সোনার বারসহ গ্রেফতার করে। সোয়া কেজি ওজনের এ সোনা তিনি জুতার সোলের মধ্যে লুকিয়ে ভারতে পাচার করছিলো।
সূত্রটি আরও জানায়, সোনা পাচারকারী চক্রে বর্তমানে মহিলা সদস্যরা যোগ দিয়েছে। তারা নতুন নতুন কৌশলে রাতে ও দিনে বেনাপোল বাজার থেকে সোনা নিয়ে সীমান্তে পৌঁছে দিচ্ছে। এছাড়া মহিলা পাসপোর্ট যাত্রীরা ঢাকা থেকে সোনা নিয়ে বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছে ও পৌঁছে দিচ্ছে নির্দিষ্ট স্থানে। মূলত. এরা হচ্ছে লাইনম্যান, আর ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকছে সোনা পাচারকারীদলের গডফাদাররা।
এদিকে, বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকার সোনা ভারতে পাচার হলেও এ বিষয়ে পুলিশ প্রশাসনের কোন মাথা ব্যথা নেই। এ বিষয়ে নেই তাদের কোন বিশেষ পদক্ষেপ ও নজরদারি। এ ব্যাপারে বেনাপোল পোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অপূর্ব হাসান বলেন, এ বিষয়ে তাদের কোন বিশেষ নির্দেশনা আসেনি। তারপরও তারা বেনাপোল চেকপোস্ট এলাকায় পুলিশী নজরদারি বৃদ্ধি করেছে।
এ বিষয়ে বেনাপোল কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের উপ-পরিচালক আব্দুস সাদিক বলেন, বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট ভারতে সোনা পাচার করছে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে তাদেরকে গ্রেফতার করা যাচ্ছিল না। পরে চেকপোস্টে আধুনিক স্কানিং মেশিনটি চালু করার পর গত সাত দিনে ৬ জন পাসপোর্ট যাত্রীকে বিপুল পরিমাণ সোনাসহ গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। কাস্টমস্ গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা এ বিষয়ে সর্তক অবস্থানে রয়েছে বলে তিনি জানান।
সোনা পাচারের বিষয়ে কথা হয় ৪৯ বিজিবি’র কমান্ডিং অফিসার লে. কর্ণেল আরিফুল হকের সাথে। তিনি বলেন, বেনাপোল সীমান্তের চোরাচালান ঘাটগুলো বর্তমানে সীলগালা করে দেয়া হয়েছে। এ কারণে  পাচারকারীরা রুট বদলে পাসপোর্ট ব্যবহার করে চেকপোস্ট দিয়ে সোনা পাচার করছে। তবে বিজিবি’র সদস্যরা চেকপোস্ট এলাকাসহ নোম্যান্সল্যান্ডে সন্দেহ ভাজনদের গতিবিধির উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছে।
এ ব্যাপারে বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার শওকাত হোসেন বলেন, বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ভারতে যাতায়াতকারীদের সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়েছে। এসব যাত্রীদের ল্যাগেজ স্কানিং করা হয়। তবে সব যাত্রীদের দেহ তল্লাশী করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে সন্দেহজনক যাত্রীদের ওপর নজরদারীতে ও প্রয়োজনে তাদের দেহ তল্লাশী করা হয়। কেজি কেজি সোনা উদ্ধার ঘটনার পর চেকপোস্টে কাস্টমস গোয়েন্দা শাখার নজরদারি ও তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ