বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মাত্র ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ১৩ কোটি টাকা নিয়ে গেলো ভারতীয় কোম্পানি ‘হাঙ্গামা’

 

স্টাফ রিপোর্টার : হাঙ্গামা মাত্র ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ থেকে দুই বছরে প্রায় ১৩ কোটি টাকা লভ্যাংশ নিয়ে গেছে ভারতীয় কোম্পানি হাঙ্গামা। এই টাকা কোম্পানিটির মূলধনের প্রায় ৩২০ গুণ। বিষয়টিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘অস্বাভাবিক ব্যবসায়িক কর্মকা-’ হিসেবে দেখছে। এই বিষয়ে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসি) চেয়ারম্যানকে ‘হাঙ্গামা (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেডের অনিবাসী শেয়ার হোল্ডারদের অনুকূলে মাত্রাতিরিক্ত লভ্যাংশ প্রেরণ প্রসঙ্গে’ কয়েকটি বিষয়ে অভিমত চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দুই বার চিঠি দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিটিআরসির সচিব মো. সরওয়ার আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে জানতে চেয়ে বিটিআরসিতে চিঠি দিয়েছে। এ বিষয়ে অপারেটরদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পর তদন্ত করে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বাংলাটিব্রিউন এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, হাঙ্গামা’র বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযোগ, ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ২০১৫ সালে ৬ কোটি ৭৪ লাখ ৮১ হাজার ২৫০ এবং ২০১৪ সালে ৬ কোটি ৭ লাখ ৩৩ হাজার ১২৫ টাকা লভ্যাংশ বাবদ ভারতে পাঠানো হয়েছে। এই টাকা ওই কোম্পানির মূলধনের প্রায় ৩২০ গুণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাঙ্গামার কর্মী-সংখ্যা মাত্র ১ জন। এছাড়া স্থায়ী কোনও স্থাপনা নেই। স্থায়ী স্থাপনাবিহীন ‘স্বল্প মূলধনী’ এ প্রতিষ্ঠানটি তাদের ১ জন মাত্র কর্মী দিয়ে মূলধনের প্রায় ৩২০ গুণ লভ্যাংশ ভারতে পাঠানোর বিষয়টিকে ‘অস্বাভাবিক ব্যবসায়িক কর্মকা-’ বলে অভিহিত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিটিআরসিকে দেওয়া চিঠিতে ‘হাঙ্গামা’কে ‘শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন অখ্যাত একটি কোম্পানি’ হিসেবে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।   

প্রাপ্ত নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ‘হাঙ্গামা’ ভারতের হাঙ্গামা ডিজিটাল মিডিয়া এন্টারটেইনমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড ও নিরাজ রায় (পরিচালক)-এর শতভাগ মালিকানাধীন একটি কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি মোবাইলফোনের ওয়াপ, সিআরবিটি (কলার রিং ব্যাক টোন) আইভিআর (ইন্টারঅ্যাক্টিভ ভয়েস রিকগনিশন) এবং মিউজিক স্ট্রিমিং সেবা  দেয়।

‘হাঙ্গামা’র আর্থিক বিবরণী পর্যালোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ধরা পড়েছে, প্রতিষ্ঠানটির আয়ের সিংহভাগ (বেশির ভাগ অংশ) বিভিন্ন মোবাইলফোন অপারেটরগুলোর কাছে বিভিন্ন সেবা বিক্রির মাধ্যমে আসে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক (বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ বিভাগ-প্রফিট, ডিভিডেন্ড রেমিটেন্স শাখা) মো. আলী আকবর ফরাজী স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বিটিআরসির কাছে এই ধরনের সেবাদানের জন্য কোনও অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে কিনা, এজন্য শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন অখ্যাত একটি কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়ার আদৌ কোনও যৌক্তিকতা আছে কিনা এবং মোবাইলফোন অপারেটরদের এত উচ্চমূল্যে এসব সেবা (ওয়াপ, সিআরবিটি, আইভিআর ও মিউজিক স্ট্রিমিং সেবা) দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রয়োজন আছে কিনা, এ সব বিষয়ে অভিমত চাওয়া হয়েছে।

এছাড়া সম্প্রতি  বিটিআরসিতে শর্টকোড চেয়ে আবেদন করেছে হাঙ্গামা। শর্টকোডটি ই-এন্টারটেইনমেন্ট (মিউজিক, ওয়ালপেপার, অ্যানিমেশন, গেমস, ভিডিও) সার্ভিসের চাওয়া হয়েছে। শর্টকোড বরাদ্দ দিতে বিটিআরসির অনুকূলে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা (১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ) চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। শর্টকোড চেয়ে টাকা জমা দেওয়ার আবেদনপত্রে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে নিরাজ রায়ের স্বাক্ষর রয়েছে। স্বাক্ষরের নিচে ভারতের একটি ফোন নম্বর দেওয়া রয়েছে। প্যাডে প্রতিষ্ঠানটির গুলশানের ঠিকানা দেওয়া থাকলেও তাতে কোনও ফোন নম্বর বা ই-মেইল ঠিকানা নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের  চিঠি পাওয়ার পর বিটিআরসি বিষয়টি আমলে নিয়েছে। শর্টকোডের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে বলে জানা গেছে।

হাঙ্গামার  কার্যালয় গুলশানে। বৃহস্পতিবার দুপুরে গুলশান এক নম্বরের ১২৬ নম্বর রোডে অবস্থিত কার্যালয়ে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। সিঁড়ির কাছের দেয়ালে সাঁটানো প্লাস্টিকের সাইনবোর্ডে ‘হাঙ্গামা’র লোগো বসানো। নিচে ইংরেজিতে লেখা হাঙ্গামা (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেড। ভবনটির ৪র্থ তলায় সিআইএমএ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিং নামের একটি অফিসের সঙ্গে হাঙ্গামার অফিস শেয়ার করা। অফিসে ঢোকার মূল দরজা একটিই। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলে ডান পাশের দরজাওয়ালা কক্ষটি হাঙ্গামার। দরজার ওপরে সাদা কাগজে কালো হরফে লেখা হাঙ্গামা (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেড। দরজায় তালা ঝোলানো ছিল। সিআইএমএ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টিং প্রতিষ্ঠানের কর্মী আজিজুল ইসলাম জানান, ‘অফিস মাঝে মাঝে বন্ধ থাকে। তবে একজন কর্মী অফিসে বসেন।’ আজ (বৃহস্পতিবার) কেন অফিস বন্ধ জানতে চাইলে তিনি তা বলতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘একটি কক্ষেই হাঙ্গামার অফিস।’ তিনি ওই কক্ষটি দেখেছেন বলেও দাবি করেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ‘হাঙ্গামা’  বাংলাদেশে নিবন্ধিত (বাংলাদেশ অফিস অব দ্য রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে) একটি কোম্পানি। যার নিবন্ধন নম্বর সি-৮৬৪৮৪।

বিটিআরসিতে শর্টকোডের জন্য টাকা জমা দিয়ে নম্বর চেয়ে আবেদনের নিচে নিরাজ রায়ের দেওয়া ফোন নম্বরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফোন করা হলে অন্য প্রান্ত (ভারত) থেকে জানানো হয়, এটা হাঙ্গামার ভারতের মুম্বাই অফিসের নম্বর, কথা বলা হয় রিসিপশন থেকে। নিরাজ রায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে এই প্রতিবেদককে জানানো হয়, নিরাজ রায় অফিসে নেই। মোবাইল নম্বর চাইলেও দেওয়া হয়নি। পরে আবার ফোন করলে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে প্রিয়াংকা নামের একজনকে দেওয়া হয়, যিনি হাঙ্গামার মুম্বাই অপারেশন দেখেন বলে জানান। তিনি জানান, ‘হাঙ্গামার বাংলাদেশের অফিস চালু রয়েছে। ওই অফিস থেকেই বাংলাদেশের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।’ বৃহস্পতিবার গুলশানে অফিসে গিয়ে বন্ধ থাকার কথা তাকে জানালে, কেন অফিস বন্ধ তা তিনি জানাতে পারেননি। তিনি আরও জানান, ‘বাংলাদেশের মোবাইলফোন ব্যবহারকারীরা তাদের কাছ থেকে কনটেন্ট নিয়ে থাকে।’ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি কিছু জানাতে পারেননি। প্রিয়াংকা এই প্রতিবেদকের নম্বর নিয়ে জানান, ‘কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের আইন বিভাগের কর্মকর্তা ফোন করে বিস্তারিত জানাবেন।’ এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত হাঙ্গামা থেকে কোনও ফোন আসেনি। 

এদিকে দেশের একাধিক মোবাইলফোন অপারেটরের কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তাদের গ্রাহকরা বিভিন্ন কনটেন্ট প্রোভাইডারদের থেকে মোবাইলে গান, ওয়াল পেপার ডাউললোড করেন, রিংটোন বা ওয়েলকাম টিউন সেট (এজন্য মোবাইল গ্রাহকের ব্যালেন্স থেকে টাকা কেটে নেয়া হয়) করেন, তার জন্য ওই প্রতিষ্ঠান (হাঙ্গামার মতো অসংখ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে) সংশ্লিষ্ট অপারেটরের সঙ্গে চুক্তির শর্তানুযায়ী রাজস্ব ভাগাভাগি করে। হাঙ্গামাও  বিভিন্ন অপারেটরের কাছ থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব ভাগাভাগির বেশিরভাগ অর্থ থেকে লভ্যাংশ (প্রায় ১৩ কোটি) বাবদ ভারতে পাঠিয়েছে।

কনটেন্ট নিয়ে কাজ করেন, এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করলে ভবিষ্যতে তাদের সমস্যা হতে পারে ভেবে কেউই উদ্ধৃত হয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে তারা এজন্য ভ্যাস (ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস) গাইডলাইন না থাকাকে দায়ী করেন। তাদের ভাষ্য, ভ্যাস গাইডলাইন থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে সেবা দিতে হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে লাইসেন্স নিতে হতো। তাহলে জবাবদিহির একটা বিষয় থাকতো। অনুমোদন নেয়ার কোনও বাধ্যবাধকতা থাকলে যেকেউ যেনতেনভাবে ব্যবসা করে যেতে পারত না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই চিঠিতে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুমোদন না নেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে তা যুক্তিযুক্তও কিনা জানতে চাওয়া হয়েছে।

বিটিআরসির সচিব মো. সরওয়ার আলম বলেন,‘বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে জানতে চেয়ে বিটিআরসিতে চিঠি দিয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্পষ্ট জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির কোনও স্থায়ী স্থাপনা নেই এবং এর শুধু একজন কর্মী রয়েছে। আমরা সব মোবাইলফোন অপারেটরের কাছে এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চেয়েছি। অপারেটরদের থেকে তথ্য পাওয়ার পর তদন্তের ভিত্তিতে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ