শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

নামায : এক অনন্য প্রশিক্ষণের নাম

তাহনিয়া তরিক : নামায ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। মহান আল্লাহর সাথে বান্দার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম (Media)। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিক্ষণে মহান স্রষ্টাকে স্মরণের এক জীবন্ত প্রক্রিয়া। দুনিয়াতে প্রতিনিয়ত মহান প্রভুর দাসত্বে আবদ্ধ থাকার এক অনন্য প্রশিক্ষণ নামায এমন একটা ইবাদত যা মুমিনের ঈমানের প্রথম পরিচায়ক, যার মাধ্যমে বান্দা তার রবের সবচাইতে নিকটবর্তী হতে পারে। এই ইবাদতের হিসাব সর্বপ্রথম হাশরের ময়দানে গ্রহণ করা হবে এবং এ ইবাদতকে পরিত্যাগকারী কাফির হিসেবে পরিগণিত হবে। প্রিয় রাসূল (সা.) বলেছেন-“হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলকে (সা.) বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন বান্দার আমলের মধ্যে সর্বপ্রথম তার নামাযের হিসাব নেয়া হবে। তার নামায যদি যথাযথ প্রমাণিত হয় তবে সে সাফল্য লাভ করবে। আর যদি নামাযের হিসাব খারাপ হয় তবে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।” (তিরমিযী)
তিনি (সা.) নামাযকে ঈমানের মূল পরিচায়ক হিসেবে ঘোষণা করেছেন এভাবে- “ইচ্ছাকৃতভাবে যে ব্যক্তি নামায তরক করে সে কাফির।” অর্থাৎ নামায ত্যাগকারীর মুসলমান থাকার কোন অবকাশই নেই।
সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বুঝা যায়, নামায যার আরবি প্রতিশব্দ হল সালাত একটি মহা মূল্যবান ইবাদতের নাম। মহান আল্লাহ সুনির্দিষ্ট সময়ে সুনির্ধারিত নিয়মে সমাজকে বান্দার উপর ফরয করেছেন। কিন্তু কেন তিনি এই মর্যাদাবান তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদতকে বান্দার জন্য অত্যাবশ্যক করলেন? আর কেনই বা রাসূল (সা.) নামাযকে মুসলমান ও কাফিরের মধ্যে পার্থক্যকারী হিসেবে ঘোষণা দিলেন?
দৈনন্দিন পাঁচবার ওঠা-বসার মধ্যে কি এমন তাৎপর্য ও হিকমত লুকানো রয়েছে?
প্রকৃতপক্ষে নামায হল একটি প্রশিক্ষণের নাম। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা যারিয়াতের ৫৬ নং আয়াতে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য ঘোষণা করেছেন- “আমি মানুষ এবং জ্বিনকে আমার ইবাদত ব্যতীত অন্য কোন কিছুর জন্য সৃষ্টি করি নাই।” (সূরা যারিয়াত: ৫৬)
ইবাদত অর্থ আনুগত্য, দাসত্ব, মেনে নেওয়া, অধীনতা স্বীকার করা। দৈনন্দিন জীবনের প্রত্যেকটি পদক্ষেপে আল্লাহ তা’আলার বিধানের আনুগত্য করাই হল ইবাদতের আসল অর্থ। বান্দা তার আইন মেনে নিবে, তাঁর দাসত্বে নিজেকে আবদ্ধ রাখবে, তাঁর অধীনতা স্বীকার করে জীবন-যাপন করবে এটাই আল্লাহ চান। এটাই বান্দার সৃষ্টির উদ্দেশ্য। তাই জীবনের এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ করতে বান্দার কঠোর পরিশ্রম দরকার। দরকার নিরবচ্ছিন্ন সাধনা, নিয়মিত অধ্যবসায়, নিয়মনিষ্ঠ দৈনন্দিন জীবন। দরকার একটি অনুগত অন্তর, বিনম্র হৃদয়। সূক্ষ্ম দায়িত্ববোধ, পবিত্র নৈতিকতা, বিশুদ্ধ ঈমান এবং মজবুত প্রচেষ্টা। বিস্ময়করভাবে লক্ষণীয় যে, একমাত্র নামাযই উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো মানুষের মধ্যে তৈরী করতে পারে। নামাযের মাধ্যমেই আমাদের মহান রব আমাদেরকে তাঁর আনুগত্যপরায়ণ বান্দা হবার প্রশিক্ষণ দিতে চেয়েছেন। একটু বিশ্লেষণ করলেই আমরা বুঝতে পারবো নামায কিভাবে আমাদের প্রশিক্ষণ দিতে পারে এবং নামাযের বাহ্যিক প্রভাবে আমাদের জীবন কতটুকু সৌন্দর্যম-িত হতে পারে?
১. নামায আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্বের প্রশিক্ষণ দেয় : দৈনন্দিন কর্মমুখর জীবনে শত ব্যস্ততার মাঝেও পাঁচবার ধ্বনিত হওয়া আজান বান্দাকে মনে করিয়ে দেয়- ‘আমি আমার রবের দাস’ যত কাজই থাকুক না কেন, আমার রবের ডাকে সাড়া দিতে হবে। আর নামাযের মধ্যে প্রত্যেকটি আরকান-আহকাম যেমন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) এর নির্ধারিত নিয়ম মেনে সম্পাদন করতে হয়, তেমনি জীবনের বাকী সমস্ত ক্ষেত্রেও আল্লাহর হুকুমের বাইরে যাওয়া যাবেনা। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (সা.) এর আইনের আনুগত্য করা ছাড়া অন্য কারো আইন বিধানের আনুগত্য করা যাবে না। এভাবেই নামাযের মাধ্যমে ব্যক্তি আল্লাহর দাসত্বের স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর অনুগত হতে শিখে।
২. নামায কর্তব্যপরায়ণ ও দায়িত্ববান হবার চাবিকাঠি : জীবনের প্রতি ধাপে, প্রত্যেক সোপানে আল্লাহ প্রদত্ত হুকুম-আহকাম পালন করার জন্য যে কর্তব্যবোধ ও দায়িত্বনিষ্ঠা প্রয়োজন, কেবলমাত্র নামাযই তা মানুষের অন্তরে বপণ করতে পারে। সেনাবাহিনীর একজন সৈনিকের মত আজান কানে যাওয়া মাত্র মুমিনকে সচেতন হয়ে যেতে হয়। আজানের আওয়াজ কর্ণকুহরে প্রবেশ করা মাত্র মুসলমানের আর বসে থাকবার কোন অবকাশ নেই। নির্দিষ্ট নিয়মে পবিত্রতা অর্জন করে তাকে ছুটে যেতে হয় নামায সম্পাদনে। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন- “আযানের শব্দ শুনবার পরও যারা ঘরে বসে থাকে, আমার ইচ্ছা হয় তাদের গৃহে আগুন লাগিয়ে দেই।”
আবার নামাযে দাঁড়াবার পরও তা অত্যন্ত দায়িত্বানুভূতি সহকারে নিষ্ঠার সাথে পড়তে হয়। কেননা অবহেলা ভরে নামায পড়লে তাকে মহান আল্লাহ মুনাফিকের নামায বলেছেন- “আর তারা যখন নামাযের জন্য দাঁড়ায়, দাঁড়ায় সম্পূর্ণ অলসতা ও অবহেলা সহকারে।” (মুনাফিকদের কথা বলা হয়েছে, সূরা নিসা: ১৪২)
এভাবে নামাযই একজন মুমিনকে কর্মমুখর জীবন-বিধান, দ্বীন ইসলাম পরিপালনের জন্য কর্তব্যপরায়ণ ও দায়িত্ববান করে গড়ে তুলে।
৩. নামাযই আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয় : ব্যস্ততাময় জীবনে নামাযই প্রতিনিয়ত মহান প্রভুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মহান আল্লাহ নিজেই বলেছেন- “আমার স্মরণের জন্যই নামায কায়েম কর।” (সূরা ত্বহা: ১৪)
৪. নামায কঠোরভাবে নিয়মানুবর্তী করে তুলে : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন- “নিশ্চয়ই নামায এমন একটি ফরয যা নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করবার জন্য মুমিনদেরকে হুকুম করা হয়েছে।” (সূরা নিসা: ১০৩)
তাই নির্দিষ্ট সময়ে নামায আদায় করা ব্যক্তিকে নিখুঁত সময়জ্ঞান শিক্ষা দেয়। মুমিন জীবন হয় ঘড়ির কাঁটায় মাপা। নামাযের প্রভাবেই মুমিন সময়ানুবর্তী হয়ে থাকে উঠে।
৫. নামায বান্দাকে নিয়মনিষ্ঠ বানায় : কুরআন ও সুন্নাহ নামায আদায়ের জন্য যে সমস্ত নিয়ম-কানুন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন বান্দার তার বাইরে যাবার উপায় নেই। নিয়মের অনুসরণ করেই ব্যক্তিকে নামায আদায় করতে হয়। নামাযের প্রভাবেই একজন মুমিন নিয়মনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। যা তাকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করে।
৬. নামায অন্যায়-অশ্লীলতা ও অপরাধমুক্ত জীবন গঠনে সহায়ক : আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন- “(হে নবী!) আপনি নামায কায়েম করুন। নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।” (সূরা আনকাবুত: ৪৫)
সত্যিকারভাবে নামায আদায়কারী ব্যক্তি যে নামাযের মধ্যে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী প্রত্যেকটি কাজ সম্পাদন করছে, সে নামায শেষ হলেও আল্লাহর হুকুম মেনে যাবতীয় অন্যায়-অশ্লীলতা থেকে বিমুক্ত থাকবে এটাই নামাযের শিক্ষা। আর নামাযের মাধ্যমে মহান আল্লাহ বান্দার অতীত অপরাধও মোচন করে দেন-
“আর নামায কায়েম কর, দিনের দুই প্রান্তে এক, রাতের কিছু অংশ পার করার পর। নিশ্চয়ই ভাল কাজ মন্দ কাজকে দূরীভূত করে।” (সূরা হুদ- ১১৪)
৭. নামায আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে : নামায মূলত বান্দাকে আল্লাহকে ভয় করতে শিখায়। অজু না করে, ঠিক মতো সূরা-ক্বিরাত পাঠ না করে নামায আদায় করলে কারো তা বুঝবার উপায় নেই। কিন্তু একমাত্র আল্লাহকে ভয় করেই বান্দা সমস্ত লোকচক্ষুর আড়ালেও তাঁর হুকুম লংঘন করতে ভয় পায়। তাই আল্লাহভীতি জীবনের সকল ক্ষেত্রে মেনে আসলেই ব্যক্তি যাবতীয় অন্যায় থেকে বিরত থাকতে পারে। এতে একটি অনাচারমুক্ত সমাজ গঠন সহজ হয়।
৮. নামায বান্দাকে বিনয়ী বানায় : নামাযে বিনীত, বিনম্র হবার মাধ্যমে একজন নামাযী ব্যক্তি তার  ব্যক্তি জীবনে বিনয়ী হবার প্রশিক্ষণ পায় যা তার চরিত্রকে সুরভিত করে।
মহান আল্লাহর বাণী- “ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই নামায খুব কঠিন কাজ। কিন্তু বিনয়ী অনুগত লোকদের জন্য তা কঠিন নয়।” (সূরা বাকারা: ৪৫)
৯. নামায সংঘবদ্ধ জীবনের প্রতিচ্ছবি : পুরুষদেরকে জামায়াতের সাথে নামায আদায় করতে হয়। যার মাধ্যমে মুমিনের সংঘবদ্ধতার অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়। জামাতে নামায আদায়ের মাধ্যমে সমাজের সবার সুখ-দুখের খোঁজ নেয়া যায়। সম্মিলিতভাবে আল্লাহর বিধান জানা এবং মানার ব্যবস্থা হয়। জামাতে নামায মুমীনদেরকে মজবুত দেয়ালের মত ঐক্যবদ্ধ করে গড়ে তুলে- যারা সমস্ত আল্লাহদ্রোহীতার মোকাবিলায় আওয়াজ তুলতে পারে।
১০. নামায পবিত্র জীবন-যাপনে অভ্যস্ত করে : সূরা মায়েদার ৬ নং আয়াতের আলোকে অজু-গোসল সম্পাদন করে পাক-পবিত্র হওয়া নামায আদায় করার পূর্বশর্ত। নামাযের জন্যই বান্দা পবিত্র হয় যা আর অন্য কোন কারণে হওয়া এতটা জরুরী নয়। তাই নামাযই মানুষকে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন জিন্দেগী যাপনে সহায়তা করে। পরিষ্কার থাকার অভ্যাস গড়ে তুলে।
শেষ কথা : বান্দা মহান আল্লাহ নির্ধারিত, রাসূল (সা.) নির্দেশিত বিধি-বিধান অনুযায়ী সুষ্ঠুভাবে নামায আদায় করবে, আন্তরিকতার সাথে নামাযকে প্রাণশক্তি সম্পন্ন করে তুলবে, তখন অবশ্যই তার নামায হয়ে উঠবে তার জন্য অনন্য প্রশিক্ষণের মজবুত কেন্দ্র, জীবন্ত ও সৌন্দর্যম-িত। যথাযথভাবে নামায আদায়ের বাহ্যিক প্রভাবে সুসজ্জিত হয়ে উঠবে প্রতিটি ব্যক্তি ও সমাজ। সমাজের সৌন্দর্য হেসে উঠবে চতুর্দিকে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ