বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

পরিবারের দুঃখ ঘোচাতে দৃষ্টি ফিরে পেতে চান সিদ্দিকুর

তোফাজ্জল হোসেন কামাল : অন্ধ মানবতার নিশানার শিকার হওয়া সিদ্দিকুর এখন দেশবিদেশের আলোচিত নাম। পাঁচদিন আগে পুলিশের টিয়ারশেলে দৃষ্টি হারাতে বসা এই সিদ্দিকুরের সেই ঘটনাও সময়ের আলোচিত। ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার ঢাকেরকান্দা গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া রাজধানীর তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমান। তার ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষ করে সব দুঃখ-দুর্দশা দূর করে পরিবারকে আলোর মুখ দেখাবেন। কিন্তু কে জানতো ঠিক সময়ে পরীক্ষা দিয়ে পাস করে বের হতে চাওয়াই সিদ্দিকুরের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে।

সেশনজট থেকে মুক্তি পেয়ে ঠিক সময়ে পাস করে পরিবারের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন সিদ্দিকুর। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাতটি কলেজের অন্য শিক্ষার্থীদের মতো তিনিও পরীক্ষার তারিখ ঘোষণার দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন। কিন্তু খুব কাছ থেকে পুলিশের ছোড়া টিয়ারশেল তার দৃষ্টি কেড়ে নেয়।

গতকাল সোমবার বিকালে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বারান্দায় সিদ্দিকুরের সঙ্গে আলাপ হলে জানান, বাঁ চোখের এক পাশ থেকে কিছুটা দেখতে পেলেও তার ডান চোখের অবস্থা আগের মতোই আছে। তিনি বলেন, ‘আমার অন্য কোনো চাওয়া নেই, শুধু একটাই চাওয়া- যেভাবেই হোক আমার দৃষ্টিশক্তি যাতে ফিরিয়ে দেয়া হয়, আমি যাতে কাজ করে আমার পরিবারের সবার দুঃখ-কষ্ট দূর করতে পারি।’

দৃষ্টিশক্তি হারানো এই শিক্ষার্থী আরো বলেন, ‘মাকে বলেছিলাম- আমাকে দুইটা বছর সময় দাও। আমি দেখি- লেখাপড়া শেষ করে তোমাদের জন্য কিছু করতে পারি কিনা। যখন তিন বছর বয়স, তখন বাবা মারা গেছেন। অনেক টানাপোড়েনের মধ্যদিয়ে দিন গেছে। আমি আমার দুই চোখের আলো ফিরে পেতে চাই, যাতে আমি কাজ করে নিজের জন্য, পরিবারের জন্য কিছু করতে পারি।’ তিনি বলেন, ‘আমার বড় ভাই এসএসসি পাস করে পড়ালেখা ছেড়ে দেন। তিনি শ্রমিকের কাজ করে আমাকে লেখাপড়া করিয়েছেন। এখন তিনি বিয়ে করেছেন, তার দুই সন্তান আছে। বড় ভাই রড-মিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন।’

সিদ্দিকুর বলেন, ‘বড় ভাই সামান্য যে টাকা পান প্রথমে এসেই সেটা আমার হাতে দেন। বলেন, ভাই তোর কতো টাকা লাগবো তুই রাখ, পরে আমি বাকিটা সংসারে খরচ করবো। তার ছেলেমেয়ের জন্য এবার ঈদে একটা সুতাও কিনেননি, কিন্তু আমার জন্য একটা টি-শার্ট কিনেছেন। তিনি এতোটাই ভালবাসেন আমাকে। আমি অন্ধ হয়ে গেলে কিভাবে এই বড় ভাইকে সাহায্য করবো! কিভাবে পরিবারের দায়িত্ব কাধে নেবো!

জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে মাত্র তিন বছর বয়সে সিদ্দিকুরের বাবা তহুর উদ্দিন মারা যান। এরপর বিধবা মা ছোলেমা খাতুন কিষাণির কাজ করে ছেলেদের লেখাপড়া করান। কিন্তু মাধ্যমিক পাস করার পর অভাবের সংসারের কথা ভেবে পড়ালেখা ছেড়ে দেন বড় ভাই নায়েব আলী। হাল ধরেন সংসারের। শ্রমিকের কাজ করে সংসারের পাশাপাশি সিদ্দিকুরের পড়ালেখার খরচ জোগাতে থাকেন।

সিদ্দিকুর স্থানীয় পশ্চিম ঢাকেরকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সপ্তম শ্রেণি পাস করে ময়মনসিংহ শহরের কৃষ্টপুর আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল ও আলিমে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করেন। এরপর রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হন ঢাকার তিতুমীর কলেজে। খিলক্ষেত্রে মেসে থেকে টিউশনি ও একটি দোকানে কাজ করে নিজের পড়াশোনার খরচ যোগাতেন সিদ্দিকুর।

গত শনিবার জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে সিদ্দিকুরের দুই চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়। গতকাল সোমবার সকালে সর্বশেষ অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে তার দুই চোখে আলো ফেলেন চিকিৎসকরা। কানের দিক থেকে বাঁ-চোখে আলো ফেললে সিদ্দিকুর সাড়া দিয়ে জানান তিনি দেখেছেন। কিন্তু ডান চোখে আলো দিলে তিনি কিছুই দেখেননি বলে জানান।

জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘সকালে সিদ্দিকুর যেহেতু জানিয়েছে যে সে বাঁ-চোখে আলো দেখতে পাচ্ছে, তাই আমরা মোটামোটি নিশ্চিত যে সে ওই চোখে দেখতে পাবে। তারপরও কিছু পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন আছে। তাকে ওষুধ দেয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে তার চোখের উন্নতি হবে আশা করা যায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘কর্নিয়ার ফোলা ভাবটা কমে গেলে পরিবারে সঙ্গে কথা বলে তার অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সিদ্দিকুরের দুই চোখই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ডান চোখটা পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ডান চোখ প্রায় অকেজো হয়ে গেছে।’

চেন্নাই নেয়া হচ্ছে সিদ্দিকুরকে

পুলিশের টিয়ার শেলের আঘাতে অন্ধ হতে চলা সিদ্দিকুর রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাই নেয়া হচ্ছে। সিদ্দিকুরের চিকিৎসার ব্যয়ভার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সরকার নিয়েছে বলেও গতকাল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

দুপুরে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে সিদ্দিকুরকে দেখার পর তাকে বিদেশ পাঠানোর ইঙ্গিত মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি আসে। এতে বলা হয়, “সিদ্দিকুর রহমান সিদ্দিককে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।”

নিম্নবিত্ত পরিবারের এই কলেজছাত্রের চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকারকে নিতে দাবি জানিয়ে আসছিলেন তার সহপাঠীরা। একই দাবি জানিয়ে গতকাল সকালে সংবাদ সম্মেলন করে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্র জোট। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, “সিদ্দিকের চোখ ভালো করতে সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।”

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সিদ্দিকের চিকিৎসার আর্থিক খরচ বহনসহ সার্বিক দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, তার চোখ ভালো করতে যা যা করণীয় চিকিৎসকরা যেন সেই পদক্ষেপগুলো নেন।”

দুপুরে হাসপাতালে সিদ্দিকুরকে দেখার পর ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “তার চিকিৎসার বিষয়টি নিয়ে কেবিনেটে আমরা আলোচনা করেছি। তার উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারি খরচে প্রয়োজনে দেশের বাইরে নেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। “সিদ্দিকুরের বিষয়টি নিয়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সাথে আলাপ করেছি। তার উন্নত চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।” 

সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর আগারগাঁওয়ে চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে যান ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, “সিদ্দিকুরের সঙ্গে আমারা দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছি, হাসপাতালের পরিচালকও আমার সাথে ছিলেন। সিদ্দিকুরের একটি চোখে আলো না ফিরলেও আরেকটি চোখে আলো ফেরানোর জন্য ডাক্তাররা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমরা আশা রাখছি, তার চোখের আলো ফিরবে।”

মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের আগে সিদ্দিকুরকে দেখতে হাসপাতালে যান ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া।

দায়ী পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা : আইজিপি

সিদ্দিককে আহত করার পেছনে যে পুলিশ দায়ী তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন বাহিনীটির প্রধান একেএম শহীদুল হক। গতকাল বিকালে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইজিপি এ কথা জানান। রাজধানীর পল্টনে কাবাডি স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় কাবাডি লিগের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।

পুলিশ প্রধান জানান, এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সেই দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে আইজিপি বলেন, ‘পুলিশ একটি বড় বাহিনী। এর মধ্যে অতি উৎসাহী কিছু পুলিশ সদস্য থাকতে পারে। যারা অতি উৎসাহী হয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে।’

 জখমের বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে : ডিএমপি কমিশনার

 সিদ্দিকুরের চোখের জখম পুলিশের টিয়ার শেলের কারণে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান হলেও বিষয়টি তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া।

দুই চোখ হারাতে বসা সিদ্দিকুরকে দেখতে গতকাল জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট হাসপাতালে যান পুলিশ কমিশনার। তিনি সেখানে সিদ্দিকুরকে দেখতে যাওয়া মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গেও কথা বলেন।

আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, “বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও সোস্যাল মিডিয়ায় আমরা দেখেছি, ওখানে বলা হচ্ছে এটা পুলিশের টিয়ার শেলের আঘাতে হয়েছে। আমি এই ক্ষেত্রে বলতে চাই। গ্যাস বল কিন্তু কখনও সরাসরি নিক্ষেপ করা যায় না। নিচুতে নিক্ষেপ করা যায় না। তাহলে শেলটা মাটিতে পড়ে যায় এবং বিস্ফোরণ হয় না, এটা মিনিমাম ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে উঁচুতে মারতে হয়, যাতে বাতাসে বিস্ফোরিত হয়ে গ্যাসটা ছড়িয়ে পড়ে। উপর থেকে শেলটা আস্তে করে নিচে পড়ে।”

পরীক্ষার সময়সূচির দাবিতে গত বৃহস্পতিবার শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন করে অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে লাটিপেটা ও কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। তখন সিদ্দিকুরের চোখে টিয়ার শেলের আঘাত লাগে বলে তার সহপাঠীরা জানান।

পুলিশ কমিশনার বলেন, “দেখা গেল তার চোখের নিচে, দুই সাইডেই আঘাত রয়েছে। গুতো জাতীয় কোনো জিনিসের। একই সাথে কীভাবে দুটি জায়গায় আঘাত লাগল? যদি একটা আঘাতে দুটো চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে নাকে কিংবা কপালে আঘাত লাগার কথা। কিন্তু তেমন কোনো আঘাত নেই। পরস্পরবিরোধী যেটা পাওয়া যাচ্ছে, এর জন্য ইতোমধ্যে আমাদের জয়েন্ট কমিশনারের (অপারেশন) নেতৃত্বে আর দুজন এসপিকে দিয়ে আমরা একটি তদন্ত কমিটি করেছি। কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। সিসি টিভির ফুটেজ, ভিডিও ফুটেজ সেগুলো শনাক্ত করা হয়েছে।”

আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, “আমরা এটা তদন্ত করে দেখছি, কী কারণে কীভাবে সে আঘাতপ্রাপ্ত হল। এখানে যদি পুলিশের কোনো গাফিলতি থাকে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে থাকে, অপেশাদার আচরণ হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই তাকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আশা হবে।”

এই কলেজছাত্রের জখম হওয়াকে ‘দুঃখজনক’ মন্তব্য করে পুলিশ কমিশনার বলেন, “বিষয়টি নিয়ে আমরা অত্যন্ত মর্মাহত। একজন মেধাবী ছাত্র যে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে, যে কারণেই হোক যার আঘাতেই হোক, অবশ্যই সে ব্যাপারে আমরা আন্তরিকভাবে মর্মাহত।”

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ