বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ভারতের শত-সহস্র বাঁধ বাংলাদেশে বন্যার প্রধান কারণ

 

সরদার আবদুর রহমান : বাংলাদেশমুখি ভারত-নেপালের অভিন্ন নদীসমূহের উপর শত-সহস্র বাঁধ শুষ্ক মওসুমে যেমন বাংলাদেশে মরুময় পরিস্থিতি তৈরি করে, তেমনই ভয়াবহ বন্যারও প্রধান কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষত ভারত তার নিজেদের নগদ লাভের আশায় নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ ধ্বংস করে দুই দেশের জন্যে দীর্ঘস্থায়ী সংকটের সৃষ্টি করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক নিয়মে নদীর বাড়তি পানিপ্রবাহ স্বাভাবিকভাবে সমুদ্রে গিয়ে পড়তো। মধ্যপথে অসংখ্য, নদী-নালা, খাল-বিল ও জলাশয় এসব পানির বিপুল অংশ ধারণ করে সারা বছরের চাহিদা পূরণ করতো। কিন্তু ভারত ও নেপালে বহু সংখ্যক নদীকেন্দ্রিক প্রকল্প করে বড় বড় আধারে পানি আটকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এই পানি এমনিতেই এসব আধারকে টুইটুম্বর করে রাখে। এর সঙ্গে বর্ষা মওসুমের বিপুল পরিমাণ পানি যুক্ত হয়ে উপচে পড়ে এবং তা দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। এরই পরিণতিতে ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশে বন্যা সৃষ্টি করছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। 

এদিকে সাম্প্রতিক বন্যায় পানির বিপুল চাপ সামাল দিতে না পেরে ভারত ইতোমধ্যে ফারাক্কা ও গজলডোবার গেটগুলো খুলে দিয়েছে। ফলে আটকে থাকা বাড়তি পানি প্রবল বেগে বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। যা ভরাট হওয়া নদী-খালসহ এখানকার দুর্বল পানি অবকাঠামোর উপর চাপ সৃষ্টি করছে। একারণে বিভিন্ন স্থানে বাঁধ-বেড়ি বাঁধগুলো ভেঙে গিয়ে জনপদ ও ফসলি জমি গ্রাস করছে। এই সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে। 

পানি আটকে রাখে ড্যাম ও প্রকল্প 

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ভারতে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, মহানন্দা, বরাক প্রভৃতি বাংলাদেশমুখি নদীসমূহের উপর নির্মিত অসংখ্য ড্যাম ও প্রকল্পের জন্য সারা বছর পানি আটকে রাখা হয়। বিশেষত কয়েক হাজার বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বৃহদাকার আধার (রিজার্ভার) তৈরি করে সেগুলোকে পরিপূর্ণ করে রাখা হয়। সেই পানির সঙ্গে বর্ষা মওসুমের বিপুল ধারা যুক্ত হয়ে ধেয়ে আসে জনপদে। এসব পানিই বর্তমান ভারত ও নেপালে বন্যার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে ভারতে শুকনো সময়ে পানি আটকে রাখার ফলে বাংলাদেশের নদীগুলো ভরাট হয়ে গেছে। অসংখ্য ছোট নদী প্রকৃতি থেকেই হারিয়ে গেছে। খাল-বিলগুলোর পানি ধরে রাখার মতো অবস্থাও আর নেই। এর ফলে এই মওসুমের বাড়তি পানি ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। অস্বাভাবিক বৃষ্টি ও বরফগলা পানির বিপুল ধারা যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। কিন্তু এখানকার জলাশয়গুলো ভারত-নেপালের প্রকল্পের প্রতিক্রিয়ায় ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এই ধারণ ক্ষমতা ২৫ ভাগে নেমে গেছে। পদ্মা নদীরই তলদেশ গত কয়েক বছরে ১৮ ফুট মতো ভরাট হয়ে গেছে। অসংখ্য চর স্থায়ী হয়ে গেছে। এসব চরে এখন প্রায় সারা বছর বিভিন্ন ফসলের আবাদ হয়।

অভিন্ন নদীসমূহে ভারতের বাঁধ-ব্যারেজ প্রকল্প 

ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ ও তা চালুর পর থেকে বিষয়টি আন্তর্জাতিক আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। হালে আলোচনায় এসেছে ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনা, তিস্তা, মহানন্দা ও বরাক নদী। এমনকি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবহমান অভিন্ন ৫৪টি নদীর প্রসঙ্গও উঠে আসছে। বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য ভয়ঙ্কর সংবাদ হলো, এই অভিন্ন নদীসমূহের প্রায় প্রতিটিতে এবং এর উপনদীগুলোতেও ভারত অসংখ্য প্রকল্প নির্মাণ করেছে এবং আরো প্রকল্পের জন্য মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করে চলেছে। এর মধ্যে যেমন আছে বৃহদাকার ব্যারেজ, ড্যাম, সেচ ক্যানেল, আছে বিদ্যুৎ প্রকল্পও। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে যেমন অভিন্ন নদীসমূহের পানি উজানে একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে, তেমনই পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের নদী তথা পানিসম্পদের মালিকানা ও অধিকার থেকে এদেশের জনসাধারণ বঞ্চিত হচ্ছে। যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ এবং মানবাধিকারেরও চরম লঙ্ঘন। ভারতের নদীকেন্দ্রিক কর্মপরিকল্পনার লক্ষ্য প্রধানত তিনটি। ১. কৃষি জমিতে সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, ২. জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ৩. বন্যা নিয়ন্ত্রণ। এছাড়াও এসব প্রকল্পের ফলে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন, পানীয় স্বাদু পানি সরবরাহ প্রকল্প স্থাপন এবং পর্যটন ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হবার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো হয়। নদীসমূহ বিভিন্ন উৎস থেকে পানির প্রবাহ লাভ করে থাকে। ১. মূল উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রবাহ, ২. বৃষ্টির পানি, ৩. উপনদীর প্রবাহ ৪. ঝর্ণাধারার পানি এবং লোকালয় থেকে নালা-নর্দমা দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি। ভারতের প্রকল্পগুলোর জন্য মূলত প্রথম তিনটি উৎসকে বেছে নেয়া হয়েছে। বিস্তীর্ণ ভারতজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদীগুলোর বিপুল জলরাশিকে ব্যবহার করে নিজেদের সমৃদ্ধির সোপান গড়ে তুলতে চায় তারা। তাদের গৃহিত কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে, নদীর পানি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরের জন্য খাল বা ক্যানাল খনন, এক নদীর সঙ্গে অপর নদীর সংযোগ সাধন, নদীর উচ্চতম স্থানে ড্যাম তৈরি ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন, ব্যারাজ ও ব্রিজ নির্মাণ, নদীর এক বেসিন হতে অন্য বেসিনে পানি স্থানান্তর। ভারত ইতোমধ্যে দৃশ্যমান নদ-নদীগুলোর ওপর ৩ হাজার ৬০০টি বাঁধ বেঁধেছে। আরো ১ হাজার বাঁধের নির্মাণ কাজ চলছে পুরোদমে। গত অর্ধশতাব্দীতে ভারতে বন্যা-খরায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত- এ ব্যাপারে পরিসংখ্যান নেই। ভারত প্রায় সবক’টি উৎসকেই বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। এভাবে এসব উৎসের শতকরা ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। নেপাল থেকে উৎসারিত নদীগুলোতেও ভারত নিজ এলাকায় বাঁধ নির্মাণ করেছে। গঙ্গার উজান থেকে ভাটির দিকে বাম পাশে অবস্থিত এসব নদী সারা বছর গঙ্গাকে নাব্য রাখতে অনেক সহায়ক হয়। গঙ্গার অন্যতম উপনদী গোমতি, রামগঙ্গা, কর্ণালী, ঘাগরা, ধাউলিগঙ্গা প্রভৃতিতে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মূল গঙ্গার প্রবাহ।

ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা পরিস্থিতি

ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে বাংলাদেশ ৬৭ শতাংশ প্রবাহ পেয়ে থাকে। বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার উপনদী ও শাখা-প্রশাখার মধ্যে রয়েছে, তিস্তা, ধরলা, করতোয়া, আত্রাই, হুরাসাগর, সুবর্নসিঁড়ি, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী, দুধকুমার, ধরিয়া, ঘাঘট, কংস, সুতলা প্রভৃতি। এসব নদীর অববাহিকা হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বিস্তৃত অববাহিকা। তথ্যে প্রকাশ, গঙ্গার পর ভারত ব্রহ্মপুত্রেরও পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর ফলে তিস্তা, তোরসা, রায়ঢাক, জলঢাকা, মহানন্দা প্রভৃতি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব নদীই বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে প্রবাহিত নদীগুলোর পানির প্রধান উৎস। অন্যদিকে মেঘনা নদী মূলত সুরমা-কুশিয়ারাসহ বিভিন্ন পাহাড়ি নদী এবং এর স্রোতের সঙ্গে মিলিত অন্যান্য জলধারার প্রভাবে স্ফীত থাকে। এই নদী বিভিন্ন স্থানে পদ্মা ও যমুনার প্রবাহও পেয়ে থাকে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-বরাক বেসিনে ভারতের বহুসংখ্যক বৃহৎ-ক্ষুদ্র অবকাঠামো নির্মাণের পরিণতিতে মেঘনারও প্রবাহ স্বাভাবিকভাবেই সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। 

তিস্তা-মহানন্দায় নানান প্রকল্প

শুধু গাজলডোবায় বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোই শেষ নয়, উজানে ‘তিস্তা-মহানন্দা ক্যানেল’ নামের প্রকল্পের মাধ্যমে ২৫ কিলোমিটার খাল কেটে তিস্তার পানি মহানন্দায় সরিয়ে নিচ্ছে ভারত। আর মহানন্দায় একটি ব্যারেজ প্রকল্পের সাহায্যে এই বাড়তি পানি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশের বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচের বিস্তার ঘটানো হচ্ছে। এছাড়াও ভারত তিস্তার উপরে বহু সংখ্যক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব প্রকল্পের জন্য বিশাল বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করা হচ্ছে। এর ফলে তিস্তার পানি ভারতের অভ্যন্তরেই থেকে যায়। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিঙে তিস্তার দুই উপনদী রামমাম ও লোধামা নদীতে ১২.৭৫ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দু’টি বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে। দার্জিলিং থেকে ৭৭ কি.মি দূরে অবস্থিত এই প্রকল্প ১৯৯৫-৯৬ সালে নির্মাণ করা হয়। তিস্তার আরেক উপনদী রঙ্গিত নদীর উপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ২০০০ সালে নির্মাণ করে ভারত। শিলিগুড়ি থেকে ১৩০ কি.মি দূরে অবস্থিত এই প্রকল্পের জন্য ৪৭ মিটার উঁচু বাঁধ ও একটি রিজার্ভার নির্মাণ করা হয়েছে। এই প্রকল্প থেকে ৩৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে। ভারত তিস্তা ক্যানেল পাওয়ার হাউজ নামে তিন স্তরে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। শিলিগুড়ির কাছে তৈরি ক্যানেল মহানন্দা ব্যারেজে মিলিত হয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন তিস্তার পানি মহানন্দায় নেয়া যাচ্ছে আবার এই ক্যানেলে উপর পাওয়ার হাউজও নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলো মহানন্দা ব্যারেজ থেকে ৫ কি.মি, ২১ কি.মি ও ৩১ কি.মি পর পর তৈরি করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশে তিস্তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। 

বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া সীমান্তের বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টের পশ্চিম-উত্তর কোণে মহানন্দা নদীর ওপর বিশাল এক বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। ১৯৭৯-৮০ সালে ‘ফুলবাড়ি ব্যারেজ’ নামে খ্যাত এই বাঁধটি তৈরি করে তারা। এই ব্যারেজের মাধ্যমে তিনটি ইউনিটে সাড়ে ২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ৬৭৫ বর্গকিলোমিটার এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এই সঙ্গে প্রতিবছর শুষ্ক মওসুমে ফিডার ক্যানেলের সাহায্যে পানি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের সেচ কাজ করছে। বিপরীতে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকার ভুগর্ভস্থ পানি নিচে নেমে যাওয়ার কারণে সেচ কাজ বিঘিœত হচ্ছে। বাঁধের মাধ্যমে পানি আটকে রাখায় শুষ্ক মওসুমে জেলার নদ-নদীগুলোকে মরা নদীতে পরিণত করছে। 

বরাক ভ্যালিতে ৩০ প্রকল্প 

ভারত আন্তর্জাতিক নদী বরাক ও তার উপনদীগুলোতে টিপাইমুখসহ ৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ছোট-বড় এসব প্রকল্প-বাঁধের মাধ্যমে তারা প্রায় ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এলাকায় সেচ ব্যবস্থারও সম্প্রসারণ ঘটানো হবে। এসব বাঁধের কারণে বরাক নদীতে কার্যত ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পাবে। অন্যদিকে ভাটির দেশ বাংলাদেশ হবে বরাকের পানি থেকে বঞ্চিত। ফলে সুরমা-কুশিয়ারা নদী পানিশুন্য হয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট ও সন্নিহিত অঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। ভারতের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে ভারত প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ও সেচের সুবিধা পেলেও বাংলাদেশ হবে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১০০ কিলোমিটার উজানে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এই বাঁধ নির্মাণে ভারতের মনিপুরের নাগরিকরাও প্রবল আপত্তি জানিয়ে আসছে। মনিপুর রাজ্যের টিপাইমুখে ভারতের বৃহত্তর প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ ছাড়াও বরাক ও তার শাখা ও উপনদীগুলোকে কেন্দ্র করে আরো ২৯টি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাঁচাই কাজ চলছে। 

ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা

বাংলাদেশে একটি বড় বন্যার আশঙ্কা ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। জানা গেছে, এবার উজানের ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও তিস্তা অববাহিকায় পানির উচ্চতা ৭৫ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ১৯ আগস্টের মধ্যে ওই পানি বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। এর ফলে সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্যা হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। তাদের মতে, এই বন্যা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ১৯৮৮ সালের বন্যাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে। জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউএনআরসিও ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের যৌথ গবেষণাকেন্দ্র বৈশ্বিক বন্যা পরিস্থিতিবিষয়ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ১০ আগস্ট সংস্থাটির পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, ভারত, চীন, ভুটান ও নেপালের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার অঞ্চলগুলোতে গত শুক্রবার থেকে পানি বাড়ছে এবং ১৯ আগস্ট পর্যন্ত এই পানি ভাটির দিকে প্রবাহিত হতে পারে। ২০০ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার উজানে বন্যার মাত্রা সবচেয়ে ভয়াবহ হতে পারে। একটি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী ১০ দিনের মধ্যে হিমালয়ের দক্ষিণাঞ্চলে ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এতে ব্রহ্মপুত্রের ভারত ও বাংলাদেশ অংশে পানি বাড়বে। 

গজলডোবার সব গেট খোলা

প্রবল বর্ষণে ভারতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় তিস্তার গজলডোবা বাঁধের সব কটি গেট খুলে দিয়েছে দেশটি। এতে ভারত থেকে ধেয়ে আসছে বন্যার পানি। হঠাৎ করে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। পাউবো সূত্র জানায়, ভারত ১৯৯৮ সালে তিস্তা ব্যারাজের ৬০ কিলোমিটার উজানে গজলডোবা বাঁধটি নির্মাণ করে। উজানে বন্যা হলে এ বাঁধের ৫৪টি গেটের সবক’টি খুলে দেয় ভারত। এতে বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে বন্যা দেখা দেয়। আবার শুষ্ক মওসুমে গজলডোবার উজানে তিস্তা-মহানন্দা খালের মাধ্যমে ২ হাজার ৯১৮ কিলোমিটার বাঁধে পানি প্রবেশ করে। তা দিয়ে ভারতের উত্তরাঞ্চলের জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, কুচবিহার ও মালদহ জেলার ২ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হয়। অপরদিকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলজুড়ে শুরু হয় পানির হাহাকার।

বিবিসি বাংলার এক খবরে বলা হয়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র-বরাক নদীর উপত্যকায় প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে ব্যাপক বন্যা দেখা দিয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর এই পানি ভাটিতে নেমে আসার পর বাংলাদেশের উত্তর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে প্রবল বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে আরেক খবরে জানা যায়, ব্রহ্মপুত্রে বন্যার কারণে আসাম, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড ও মনিপুরে বিপর্যয় ঘটেছে। আসামের অনেক বন্য জীবজন্তুও এ বন্যার কারণে প্রাণ হারিয়েছে বলে সেখানকার বনমন্ত্রী জানিয়েছেন। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের কাজিরাঙা অভয়ারণ্য থেকে অনেক বন্য জীবজন্তু পালিয়ে গেছে।

এ দিকে সর্বসাম্প্রতিক খবরে জানা গেছে, ভারত গত মঙ্গলবার রাতে ফারাক্কা ব্যারেজের কয়েকটি গেট খুলে দিয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের পদ্মায়ও বন্যার আশঙ্কা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর আগে গত বছর আগস্টের শেষ সপ্তাহে বিহারের বন্যা সামাল দিতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ফারাক্কা বাঁধের সবগুলো গেট খুলে দেয়া হয়। ভারতের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে ফারাক্কা বাঁধের গেটগুলো খুলে পানি ছেড়ে দিলে বিহার রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষতি সম্পর্কে কোন কথা বলা হয়নি। 

এ বিষয়ে নদী গবেষক ও অনুসন্ধানী লেখক হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, এটা খুবই স্বাভাবিক যে উজানে পানির প্রবাহ আটকে রাখলে ভাটিতে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যায়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি তার ব্যতিক্রম নয়। সমুদ্রগামী নদীর মুখ উঁচু হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মওসুমের বাড়তি পানি উজানের দিকে জনপদে ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক বন্যার প্রধান কারণ আমাদের নদী-নালা ও খাল-বিলগুলোর পানি ধরে রাখার সামর্থ্য খুবই সীমিত হয়ে পড়েছে। সে কারণেও অস্বাভাবিক বন্যা হচ্ছে। নদীবিষয়ক গ্রন্থলেখক মাহবুব সিদ্দিকী উজানের দেশের প্রতি কেবল নিজেদের স্বার্থে শুষ্ক মওসুমে পানি আটকে রাখার নীতি পরিহার করার আহ্বান জানান।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ