শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বন্যার্তদের আগামী তিন মাসে খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে -প্রধানমন্ত্রী

দিনাজপুর : গতকাল রোববার দিনাজপুরের বিরল উপজেলার তেঘরা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠ প্রাঙ্গণে বানভাসি ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

সংগ্রাম ডেস্ক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল রোববার দিনাজপুর ও কুড়িগ্রামে ত্রাণসামগ্রী বিতরণপূর্ব সমাবেশে বলেছেন, বন্যায় যাদের ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করে দেয়া হবে। সকল স্থানের বন্যার্তদের আগামী ৩ মাস খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে। কৃষকদের সার, বীজ ও চারা সরকার সরবরাহ করবে। আমাদের সংবাদদাতাদের প্রেরিত খবর :
আমাদের দিনাজপুর সংবাদাদতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বন্যায় যাদের ঘর-বাড়ী নষ্ট হয়েছে তাদেরকে ঘর-বাড়ী তৈরী করে দেয়া হবে। যাদের ঘর-বাড়ী নেই তাদেরকে খাস জমিতে ঘর-বাড়ী বানিয়ে দেয়া হবে। বাংলাদেশের কোনো মানুষ আর গৃহহারা থাকবে না। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ স্বাভাবিক ব্যাপার। এগুলো আমাদের সরকার এবং আমরা জানি। বন্যায় কি কি ক্ষতি হতে পারে, তাও আমরা জানি। সে জন্য আমরা বন্যার আবহাওয়া পূর্বাভাস শুনেই ১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল কেনার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। যাতে খাদ্যের কোনো অভাব না হয়। নগদ টাকা ব্যবস্থা করেছি। আমরা জানি বন্যায় কৃষকদের ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কৃষক যাতে কষ্টে না পড়ে সে জন্য আমরা ফসলের বীজ ও বীজতলা দেবো। ফসল রোপনে যা অর্থ লাগে তাও দেবো। কৃষকের যাতে কোনো কষ্ট না হয় সে জন্যই এ সকল ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। মানুষের কল্যাণ সাধনই তো আমার রাজনীতি। সে জন্যই বন্যার সাথে সাথে সরকারের সকল প্রতিষ্ঠান, সেনাবাহিনী, দলীয় নেতাকর্মীসহ সকলেই ত্রাণ বিতরণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। খাদ্যের কোনো সংকট হবে না। প্রয়োজনে হেলিকপ্টারে খাদ্য পাঠানো হবে। শুধু তাই না বীজতলাও পাঠানো হবে। বন্যার ব্যাপারে সরকার সব সময় সজাগ ও সতর্ক। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সেলও গঠন করা হয়েছে। বন্যার সার্বিক অবস্থা সার্বক্ষণিক মনিটরিং হচ্ছে। যেখানে যা প্রয়োজন পাঠানো হচ্ছে।
গতকাল রোববার দিনাজপুর শহরের জিলা স্কুল প্রাঙ্গণ ও বিরল উপজেলার তেঘরা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ প্রাঙ্গণে পৃথক দু’টি সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমের প্রাক্কালে অনুষ্ঠিত সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার এমপি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.এইচ মাহমুদ আলী এমপি, কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জাল হোসেন চৌধুরী মায়া, পানি সম্পদ মন্ত্রী ব্যারিষ্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল (অবঃ) নজরুল ইসলাম, জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম প্রমুখ।
সমাবেশগুলোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো বলেন, উত্তরবঙ্গে হাহাকার ছিল, মঙ্গা লেগেই থাকতো। আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর উত্তরবঙ্গের মঙ্গা দুর করে। উত্তরবঙ্গে যেন মঙ্গা না থাকে আমরা তার ব্যবস্থা করি। ২০০১ সালে বিএনপি জোট সরকার ক্ষমতায় আসলে উত্তরবঙ্গে আবারো মঙ্গা দেখা দেয়। ২০০৮ সালে নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এসে আবারো আমরা উত্তরবঙ্গ থেকে মঙ্গা দুর করি। গত আট বছরে কোনো মঙ্গা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী আবেগ আপ্লুত কন্ঠে বলেন, আমি বাবা, মা, ভাই-বোন সব হারিয়েছি। আমার আর হারাবার কিছু নেই। আমার বাবা দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। আমি দেশের মানুষের জন্য আমার জীবন উৎসর্গ করেছি। প্রয়োজনে আপনাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আমিও জীবন দেব।
তিনি বলেন, এখানে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার প্রাক্কালে তাদের নামানো হয়। আজ আমি তাদের সঙ্গে কথা বলবো ত্রাণ কোথায় কিভাবে কতটুকু বিলি হচ্ছে তা জানবো। মোট কথা ত্রাণেরও হিসাব আমরা নেবো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারিভাবে আমরা যা ত্রাণ দিচ্ছি, তা তো দিচ্ছিই। পাশাপাশি সমাজের বিত্তশালীদেরও ত্রাণ প্রদানে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সরকার সব সময় জনগণের কল্যাণে কাজ করে। এই সরকার বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধবা ভাতা, শিক্ষাবৃত্তিসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজ করেছে। বর্তমানে সারাদেশে ১ কোটি ৭৩ লাখ ছাত্র-ছাত্রী বৃত্তি পাচ্ছে। সারাদেশে বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, বন্যায় যেসব স্কুল-কলেজ নষ্ট হয়েছে, সেসব সরকারের পক্ষ থেকে ঠিক করে দেয়া হবে। যেসব ছাত্র-ছাত্রীর বই বন্যায় নষ্ট হয়েছে তাদের আবারও বিনামূল্যে বই দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, দেশে ৮ হাজার পোষ্ট অফিসকে ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। যাতে এর সুফলও মানুষ পেতে পারে। পোষ্ট অফিসে টাকা সঞ্চয় করা যায়। গ্রামের মানুষ যেন সে সঞ্চয়টুকু করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, খুব শীঘ্রই ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি শুরু হবে। আর অতি দরিদ্র মানুষের জন্য ভিজিডি’র মাধ্যমে চাল বিতরণ করা হবে। মোট কথা মানুষের জন্য যা যা করা দরকার সব আমরা করবো। বন্যা পরবর্তী কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব যাতে না হয় সে জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
৫ স্তরের নিরাপত্তায় জন দুর্ভোগ
প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশকে কেন্দ্র করে নেয়া হয় ৫ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কঠোর এ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অতিষ্ঠ দিনাজপুরের মানুষ। গতকাল প্রায় সারাদিন এই ধকল সহ্য করতে হয়েছে। মানুষকে রাস্তায় বের হতে দেয়া হয়নি। গাড়ীঘোড়া, দোকানপাট বন্ধ ছিল। ফলে অফিসগামী মানুষ পড়ে চরম বিপাকে। এ ব্যাপারে এলাকাবাসী বলেন, প্রধানমন্ত্রী আসবেন ভালো কিন্তু তার নিরাপত্তার নামে প্রশাসনের এই কঠোরতা নিতান্তই অন্যায়। এভাবে জন দুর্ভোগ সৃষ্টির কোনো মানেই হয় না।
অঘোষিত হরতাল : গতকাল প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষ্যে দিনাজপুর বড় ময়দান থেকে তেঘরা হাই স্কুল মাঠ পর্যন্ত প্রায় ৪ কিঃমিঃ রাস্তার দু’ধারে সকল দোকানপাট বন্ধ ছিল। এই সড়কে কোনো যানবাহন চলাচল করতে দেয়া হয়নি। রাস্তার দু’ধারে পুলিশ প্রহরা পথচারীদের হাটতেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সব মিলে পরিবেশটি যেন হরতালে রূপ নেয়। দীর্ঘদিন থেকে হরতাল মুক্ত দিনাজপুরবাসী গতকাল অঘোষিত হরতালের স্বাদ নিলো।
ত্রাণের প্যাকেটে যা ছিল
দিনাজপুরে বন্যাদুর্গত মানুষের মাঝে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ত্রাণের প্যাকেট বিতরণ করেছেন তার মধ্যে ছিল- হাফ কেজি লবণ, হাফ লিটার সোয়াবিন তেল, ১ কেজি ডাল ও ১০ কেজি চাল। বিরল উপজেলার তেঘরা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রায় ৫ হাজার প্যাকেট  ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। প্রত্যেক প্যাকেটেই এমন দ্রব্য ছিল বলে ত্রাণ পাওয়া মানুষেরা জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী হামাক কি দিলি?
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ত্রাণ বিতরণ সমাবেশ শেষে প্রচ- ভিড় ঠেলে বের হওয়া সময় একজন মহিলা বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছিলেন। প্রচন্ড রোদে দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত ওই মহিলা বলছেন- ‘প্রধানমন্ত্রী হামাক কি দিলি? মুই তো কিছুই বুঝিনু না। তামান খালি দিবি দিবি কহিলি, কিন্তু দিবে কখন ওইটা ফের কে কহিবে?’ মহিলাকে ডেকে কথা বলা হলে জানা গেল তার নাম খতেজা বেগম। এসেছেন বহলা গ্রাম থেকে। বন্যায় তার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তিনি সভায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে এমন আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন।
আমাদের কুড়িগ্রাম সংবাদদাতা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কুড়িগ্রামসহ সকল স্থানের বন্যার্তদেরকে ৩ মাস খাদ্য সহায়তা দেয়া হবে। কৃষকদের সার, বীজ, চারা সরকার সরবরাহ করবে। যে স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা মেরামত করা হবে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করে কৃষকরা যাতে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে সেজন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের পূনর্বাসন করা হবে। আওয়ামীলীগ সরকার উন্নয়নের সরকার। ক্ষতিগ্রস্ত সেতু কালভার্ট দ্রুত মেরামত করা হবে। মেরামত কাজে যেন অনিয়ম না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী এনজিওদের উদেশ্যে বলেন, কিস্তির টাকার জন্য যেন কোনো চাপ সৃষ্টি করা না হয়। তিনি কুড়িগ্রামের বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন শেষে জেলার রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের পাঙ্গারাণী লক্ষ্মীপ্রিয়া স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরন পুর্ব সমাবেশে এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, আমার কোনো ভয় নেই। আমি ভয় পাইনা। আমি বাবা হারিয়েছি, মাকে হারিয়েছি। প্রয়োজনে আমার জীবন দিয়ে হলেও আপনাদের জন্য কাজ করে যাব। আমি ভয় করি না। বক্তব্য শেষে বন্যাদুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরন করেন তিনি। এসময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন তার সফর সঙ্গি এবং জেলা ও উপজেলা আওয়ামীলীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ।
এবারের ভয়াবহ দ্বিতীয় দফা বন্যায় দেশের উত্তারাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কুড়িগ্রাম জেলা। বন্যায় জেলার ৯ উপজেলায় ৭২টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬২টি ইউনিয়নের ৮২০ গ্রামের প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে রোপা আমনসহ ৫০ হাজার হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল। বন্যায় ঘর-বাড়ি তলিয়ে থাকায় পানিবন্দি মানুষজন খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে ভুগছে। বন্যাদুর্গত এসব এলাকা পরিদর্শন ও ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের ত্রাণ সহায়তা দিতে কুড়িগ্রামের রাজারহাটে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্রাণ বিতরন করেন। বন্যায় জেলার ক্ষতিগ্রস্থ বানভাসী মানুষের মাঝে ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি এসব মানুষের কৃষি ও পুণর্বাসনে বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা করবেন প্রধানমন্ত্রী এমনটাই প্রত্যাশা ছিল কুড়িগ্রাম জেলার সর্বস্থরের মানুষের। নাগেশ্বরী উপজেলায় সেনাবহীনির উপস্তিতে ত্রাণ সহায়তা দেয়ায় সেখানে কোনো ত্রাণের কোনো অনিয়ম হয়নি। জেলার রৌমারী উপজেলায় ত্রাণ বিতরনের অনিয়মের খবর পাওয়া গেছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ