শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

প্রতি বছর ভিসা ফি বাবদ পাচার ২শ কোটি টাকা ॥ চিকিৎসা বাবদ ৯০ হাজার কোটি

গাযী খলিলুর রহমান, টঙ্গী সংবাদদাতা : দিন দিন বাংলাদেশের চিকিৎসা খাত ভারতের দখলে চলে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। দেশীয় চিকিৎসকদের রুগীর প্রতি উদাসীনতা ও চিকিৎসা সেবাকে নিজের মতো করে ব্যবহার করার কারণ রুগীদের ভারতমুখি হয়ে উঠার অন্যতম কারণ বলে জানা গেছে। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ভারতে ভিসা ফি বাবদ পাচার হচ্ছে প্রায় ২শ কোটি টাকা এবং চিকিৎসা বাবদ প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। অনুসন্ধানে জানা গেছে বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন তিনটি রুটে ( বিমান, রেল ও বাস) প্রায় ৮ হাজার লোক ভারতে চিকিৎসা ও ভ্রমণে যায়। আর এজন্য ভিসা আবেদন বাবদ জনপ্রতি ৬শ টাকা করে জমা দিতে হয়। এতে প্রায় প্রতিদিন ঢাকার তিনটি ভিসা কেন্দ্র (গুলশান, শ্যামলী ও উত্তরা) সহ প্রায় বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলাগুলোর ভিসা কেন্দ্রের সহযোগিতায় ৪৮ লাখ টাকা পাচার হচ্ছে, এতে মাসে পাচার হচ্ছে ১৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা, বছরে প্রায় ২শ কোটি টাকা। আর বিভিন্ন অযুহাতে যাদের ভিসা আবেদন বাতিল করা হচ্ছে তাদের জমা ৬শ টাকা গচ্ছা যাচ্ছে। হিসাব না থাকলেও তাদের সংখ্যাও কম নয়। 

জানা গেছে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্তরাই ভারতে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ক্যান্সারে আক্রান্তদের বেশি দেখা যাচ্ছে। ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রতি রুগী ন্যুনতম ৩ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হচ্ছে। সে হিসেবে ন্যূনতম চিকিৎসা ব্যয় হচ্ছে প্রতিদিন ২শ ৪০ কোটি টাকা, মাসে ৭ হাজার ২শ কোটি টাকা আর বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকা। যাদের চিকিৎসা খরচ বেশি হচ্ছে সেই হিসেব করলে টাকার পরিমাণ কোথায় দাঁড়াবে? তবে দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছেই। কেন ভারতমুখি হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণ? খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশীয় চিকিৎসকদের প্রতি আস্থাহীনতাই এর জন্য দায়ী। কারণ এদেশীয় চিকিৎসকগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রুগীদের নিয়ে গোঁজামিলের আশ্রয় নেয়ার এবং সেবার পরিবর্তে ব্যবসা করছে বলে রুগীদের অভিযোগ। বাস্তবে রুগীদের অভিযোগের সত্যতার প্রমাণও পাওয়া গেছে। 

গাজীপুর ধান গবেষণার কর্মকর্তা মোঃ হুমায়ুন আহমেদ (৬৫) মোমেনশাহী জেলার শাহ ইয়াসিন (৬০), মিরপুর ঢাকার নূরজাহান (৫২) নারায়ণগঞ্জের শিশু নয়ন (৭) ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কলিকাতা টাটা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে বাংলাদেশী চিকিৎসকদের অমানুষিকতা। তারা বাংলাদেশে অনেকদিন চিকিৎসা নিয়ে কোনো ভালো ফলাফল না পেয়ে ভারতে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারা একেকজন প্রায় ৮/৯ মাস যাবত ভারতে এসেছেন এবং চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। আরো অনেকদিন চিকিৎসা নিতে হবে বলে জানা গেছে। হুমায়ন আহমেদ জানান, বাংলাদেশের চিকিৎসক তাকে তিন মাস বাঁচবেন বলে জানিয়েছিল। কিন্তু ভারতে গিয়ে তিনি এখন সুস্থ। শাহ ইয়াসিনের অভিযোগও একই। টঙ্গী সফিউদ্দিন সরকার একাডেমী এন্ড কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল জাফর আহমেদের ক্যান্সার হয়েছে। বাংলাদেশী চিকিৎসক জানিয়েছেন তাকে ক্যান্সারের থেরাপিও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ভারতে গিয়ে দেখা গেল তার পুরো চিকিৎসা ভুল। তার কোনো ক্যান্সার নেই। ভারতের চিকিৎসক তাকে ক্যান্সারের এন্ট্রি থেরাপি দিতে হয়েছে। টঙ্গী থানা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি সাংবাদিক গাযী খলিলুর রহমানের মেধাবী কন্যা নাফিয়া নুফরাত পাপড়ির অর্থো সার্কোমা হয়েছে বাংলাদেশী চিকিৎসক বলেছিলেন কিন্তু ভারতের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পাওয়া গেল পাপড়ির বোন সিস্ট হয়েছে। বাংলাদেশের রিপোর্ট রিভিউ করতে ভারতীয় চিকিৎসকদের ৩২ দিন লেগেছে। এভাবে হাজারো অভিযোগ বাংলাদেশী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে। আর একারণে ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশী রুগীরা। 

ভারতের যেসকল হাসপাতালে বাংলাদেশী রুগীরা চিকিৎসা নিচ্ছে সেগুলোর মধ্যে মোম্বাই টাটা, কলকাতা টাটা, বেলারু সি এম সি, বেঙ্গালুরু এপোলো, কলকাতা এপোলো ও হাওড়া নারায়ানা অন্যতম। চিকিৎসা নিতে আসা এবং চিকিৎসা নেয়া বাংলাদেশী রুগীরা জানায়, মোম্বাই টাটা ও হাওড়া নারায়ানা হাসপাতালের চিকিৎসা সব চেয়ে ভালো। স্বরেজমিনে দেখা গেছে, ভারতীয় হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ বেশি হওয়ায় ভারতের বাসিন্দারা এসকল নামী দামী হাসপাতালে তেমন একটা চিকিৎসা নেয় না। এসকল হাসপাতালের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ রুগী বাংলাদেশী। বাংলাদেশী রুগীরা ভাল চিকিৎসা সেবা পেলেও নানা হয়রানির শিকারও হতে হচ্ছে। থাকা ও খাওয়ার সমস্যাই বেশি। যারা নতুন যাচ্ছে, তাদের সমস্যা একটু বেশি। তবে যারা কলকাতায় যায়, তাদের সমস্যা কিছুটা কম। 

ভাষা ও সামাজিকতায় বাংলাদেশ-কলকাতার অবস্থান প্রায় কাছাকাছি। তাই তাল মিলিয়ে চলা যায়। তবে বাংলাদেশী যে সকল মা-বোনেরা বোরখা ও হিজাব পরিধান করে চলাচল করেন, তাদের বেলায় কিছুটা সমস্যা হয়। কারণ তাদেরকে বাংলা পল্লী (হিন্দু এলাকায়) বাসা ভাড়া দিতে চায় না। মুসলিম পল্লীতে অবশ্য তেমন সমস্যা হয় না। তবে নতুন রুগীদের যাওয়ার আগে খোঁজ খবর নিয়ে যাওয়া উত্তম। বাসা ভাড়া নিতে হলে দর কষাকষি করে নিতে হবে। ওদের কাছে কোনো নীতির বালাই নেই। সুযোগ বুঝে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ফন্দি করে বেশির ভাগ ভারতীয় বাড়ি মালিকরা। এছাড়া চিকিৎসা নিতে যাওয়া রুগীর চিকিৎসা খরচ নেয়ার ব্যপারে সরকারের পক্ষ থেকে সঠিক দিক নির্দেশনা না থাকায় রুগীদের চরম ভোগান্তি হয়। অনেকে অবৈধভাবে চিকিৎসা খরচ নিতে গিয়ে দালালের খপ্পরে পরে সর্বশান্ত হতে হয়। অনেকে হুন্ডির মাধ্যমে চিকিৎসা খরচ পরিশোধ করায় সরকারও কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। 

সরকারের নজরে রাখা প্রয়োজন, একজন জটিল ক্যান্সারের রুগী দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর মাত্র ২শ ডলার দিয়ে কিভাবে ভারতে থাকে, খায় ও চিকিৎসা ব্যয় বহন করে!! সরকারের উচিৎ একজন রুগীর থাকা-খাওয়া ও চিকিৎসা বাবদ কত টাকা লাগবে, সেভাবে রুগীকে হয়রানি না করে ট্যাক্স ফ্রি খরচ বহনে সুযোগ দেয়া। নানা জটিলতার কারণে অনেক রুগীরা বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে চাচ্ছেন না। বাংলাদেশী রুগীরা যাতে আর বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিতে না হয়, সেজন্য এদেশের চিকিৎসক ও হাসপাতালগুলোকে মানসম্মতভাবে গঠন করার জন্য, অথবা বিদেশে গিয়ে যদি চিকিৎসা নিতেই হয় তাহলে বাংলাদেশী রুগীরা যাতে হয়রানির শিকার না হয়ে সঠিক ও যথাযথভাবে চিকিৎসা নিতে পারে, সেজন্য সরকারের নিকট দেশের লাখ লাখ রুগীরা বিনীত অনুরোধ জানিয়েছেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ