নড়াইলের ইউপি চেয়ারম্যান নাহিদ মোল্লা খুলনায় ঘুমন্ত অবস্থায় গুলীতে নিহত
খুলনা অফিস : সন্ত্রাসীদের গুলীতে নড়াইল জেলার হামিদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যার সদ্য আওয়ামী লীগে যোগদানকারী নেতা নাহিদ হোসেন মোল্লা (৫০) নিহত হয়েছে। শুক্রবার ভোরে খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার গাজিরহাটের নিজ বাড়ির দোতলায় ঘুমন্ত অবস্থায় জানালা দিয়ে সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলীতে গুলীবিদ্ধ হয়। পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে বিচার না হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একের পর এক ইউপি চেয়ারম্যান খুনের ঘটনা ঘটছে। স্বাধীনতা পরবতী সময়ে খুলনা বিভাগে অন্তত ৭৭জন ইউপি চেয়ারম্যান খুন হয়েছে। একের পর এক জনপ্রতিনিধি খুন হলেও কোনটির কোন কুল কিনারা করতে পারেনি আইন কৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে করে জনপ্রতিনিধিরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকেই গানম্যান নিয়ে চলছেন। একের পর এক চেয়ারম্যান খুন হলেও কোনটির বিচার পায়নি পরিবার। যে কারণে খুনিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, স্থানীয় কোন্দল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক ইউপি চেয়ারম্যান খুন হচ্ছে বলে অপরাধ বিশ্লেষকরা জানান।খুলনার দিঘলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান জানান, ‘নাহিদ মোল্লা হামিদপুরের মৃত আব্দুল হামিদের ছেলে। সিলিমপুরে তার বাড়ি রয়েছে। হামিদপুর সংলগ্ন গাজিরহাটেও তিনি একটি বাড়ি করেছেন। এই বাড়িতে তিনি মাঝে মধ্যে এসে থাকতেন। বৃহস্পতিবার রাতে তিনি এই বাড়ির দোতলায় ছিলেন। শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে সন্ত্রাসীরা জানালা দিয়ে তাকে গুলী করে। এরপর লোকজন গুলীবিদ্ধ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে জরুরি বিভাগ থেকে কর্তব্যরত চিকিৎসক নাহিদ মোল্লাকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহতের লাশ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।
নিহত ইউপি চেয়ারম্যান নাহিদ হোসেন মোল্লার পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, নাহিদ হোসেন মোল্লা বাড়ির দোতলায় জানালা খুলে ঘুমিয়ে ছিলেন। শুক্রবার ভোর ৪টার দিকে সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলী তার পিঠ দিয়ে ঢুকে পেট দিয়ে বের হয়ে যায়। নাহিদ মোল্লা বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বছর খানেক আগে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
নিহতের স্ত্রী পলি খানম বলেন, রাতে দিঘলিয়া ইউনিয়নের গাজীরহাট বাগান বাড়ির দোতলার জানালা খুলে আমরা ঘুমিয়েছিলাম। ভোরে গুলীর শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। দেখি গুলীবিদ্ধ অবস্থায় ছটফট করছেন নাহিদ মোল্লা। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
তার ছোট মেয়ে নদী খানম জানান, দুর্বৃত্তরা দুই তলায় উঠে জানালা দিয়ে গুলী ছুঁড়ে পালিয়ে যায়। এ সময় তার বাবা একাই ওই বিছানায় ঘুমিয়ে ছিলেন। তার মাসহ পরিবারের সদস্যরা অন্য কক্ষে ঘুমিয়েছিলেন। তার পিঠসহ শরীরের একাধিক স্থানে গুলীর চিহ্ন রয়েছে।
নাহিদ হোসেনের খালাতো বোন শাহনাজ বেগম বলেন, সকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে হাসপাতালে গিয়ে ভাইয়ের লাশ দেখতে পাই।
এলাকাবাসী জানান, ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে নাহিদ হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নাহিদ মোল্লা বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের এক বছর আগে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছিলেন। স্থানীয়রা ধারনা করছেন, এলাকায় প্রভাব বিস্তার ও রাজনৈতিক বিরোধের জের ধরে ইউপি চেয়ারম্যান নাহিদ মোল্লাকে হত্যা করা হয়েছে।
নড়াইলের কালিয়া থানার ওসি মো. সমশের আলী বলেন, কালিয়া ও খুলনার দিঘলিয়া ইউনিয়ন সীমান্তবর্তী গাজীরহাট এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছে। ধারণা করা হচ্ছে, বাড়ির কার্নিশ বেয়ে উঠে সন্ত্রাসীরা জানালা দিয়ে চেয়ারম্যানকে গুলী করে পালিয়েছে। ওসি জানান, নাহিদ মোল্লার কোমরে গুলী লেগেছে। নড়াইল এবং দিঘলিয়া থানার পুলিশ এলাকা ঘিরে রেখেছে। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। এ ঘটনায় মামলাও হয়নি।
এদিকে স্বাধীনতা পরবতী সময়ে খুলনা বিভাগে অন্তত ৭৭ জন ইউপি চেয়ারম্যান খুন হয়েছেন। সর্বশেষ এই তালিকায় যোগ হয়েছেন নড়াইল জেলার হামিদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যার সদ্য আওয়ামী লীগে যোগদানকারী নেতা নাহিদ হোসেন মোল্লা।
এর আগে ২৫ মে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৯টার দিকে সরদার আলাউদ্দিন মিঠু তার অফিসে বসে কয়েকজন দলীয় নেতাকর্মীকে নিয়ে মিটিং করছিলেন। কিছুক্ষণ পর মোটরসাইকেল যোগে গোয়েন্দা পুলিশের পোশাক ও হেলমেট পরিহিত সশস্ত্র ৩/৪ ব্যক্তি নিরাপত্তা প্রহরীকে ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে। কক্ষেও গেটে থাকা লাইসেন্সকৃত শর্টগানধারী তার দেহরক্ষী নওশের আলী (৫০) কে গুলী করে দ্রুত কক্ষে ঢুকে মিঠুর মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলী করলে ঘটনাস্থলেই সে মারা যায়। এসময় তাদের এলোপাতাড়ি গুলীতে মিঠুর শ্বশুর ও উপজেলা বিএনপি নেতা সৈয়দ ফজলুল আলম সেলিম (৫৬) ও তার অপর দেহরক্ষী সিরাজ মোড়ল (৫১) জখম হন। তাদের মধ্যে গুরুতর অবস্থায় নওশের আলীকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং বাকিদের ফুলতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। নওশের আলী মধ্যরাতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট যশোর শহরের ধর্মতলা এলাকা থেকে নিখোঁজ হন চৌগাছার পাশাপোল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম। এরপর ৩১ আগস্ট শহরের ষষ্টীতলাপাড়ার একটি পুকুর থেকে অজ্ঞাত অবস্থায় লাশ উদ্ধার হয়। এরপর পরিচয় সনাক্ত না হওয়া ২ সেপ্টেম্বর বেওয়ারিশ হিসেবে ঘোপ কবরস্থানে দাফন করা হয়। গত ৩ সেপ্টেম্বর কোতয়ালী থানায় গিয়ে লাশের ছবি দেখে পরিচয় সনাক্ত করা হয়। একজন চেয়ারম্যানের লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করায় চেয়ারম্যানরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। এছাড়া এ অঞ্চলে ৭৫জন ইউপি চেয়ারম্যান খুন হন। এরমধ্যে সরদার আলাউদ্দিন মিঠু বড় ভাই দামোদর ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আবু সাঈদ বাদলকে ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট প্রকাশ্যে হত্যা করেছিল। এর আগে ১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট দুপুরে ফুলতলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে প্রকাশ্যে হত্যা করেছিল তাদের পিতা ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আবুল কাশেমকে। এছাড়া হত্যাকান্ডের শিকার ইউপি চেয়ারম্যানরা হলেন-আবুল কাশেম, মোশারেফ হোসেন, জিল্লুর রহমান মিন্টু, আবদুল খালেক, ইমামুল হাসান টুটুল, আশরাফ হোসেন আশা, ওয়াজেদ আলী, জামিল মাস্টার, কাওছার আলী, আনছার মল্লিক, শেখ শফিউদ্দিন, আব্দুল মাজেদ শেখ, আব্দুল জলিল, নূরুদ্দিন, আব্দুল করিম, খুলনায় চান মিয়া শিকদার, আব্দুল মজিদ, কবিরুল ইসলাম, অতুল সাহা, শেখ সিরাজুল ইসলাম, এন্তাজ আলি, রুহুল আমিন, গোলাম ফারুক, আবুল হোসেন, মোস্তফা মো. হাবিব, শেখ জাহান আলী, আবু গাজী, হাবিবুর রহমান, আব্দুল গফুর, ইমরান গাজী, ইউসুফ মোল্লা, আমীর আজম খান, রবীন্দ্রনাথ মন্ডল, বাগেরহাটের পার্থ প্রতীম পিন্টু, আক্তার হোসেন তরফদার, আতিয়ার রহমান, আব্দুর রশিদ খাঁ, খান সাদেকুল ইসলাম সাদু খাঁ, আতর আলী, হাবিবুর রহমান, মেহেরপুরের বাহারুল ইসলাম মিলকি ও ফারুক হোসেন ভূঁইয়া, সাতক্ষীরার গহর আলী ও মিজানুর রহমান, চুয়াডাঙ্গায় মেহের আলী, ইবনে সাঈদ কচি, বাকবুল ইসলাম বাবুল ও জামিল হোসেন বাচ্চু, নড়াইলে আব্দুল মান্নান ও সিরাজুল ইসলাম, ঝিনাইদহে রফিকুল ইসলাম, কুষ্টিয়ায় আব্দুল আজিজ, আলী আকবর, খয়বর মন্ডল, আমু হোসেন, হেলাল উদ্দিন, মাহমুদ হোসেন সাচ্চু।