শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

পুষ্পনিধি

আব্দুস সালাম : এক দরিদ্র মৌয়াল তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে এক গ্রামে বাস করতো। মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে তা বাজারে বিক্রি করে মৌয়াল তার জীবিকানির্বাহ করতো। তার স্ত্রী গ্রামে বিভিন্ন জনের বাড়িতে কাজ করতো। তবুও মৌয়ালের সংসারে বেশ টানাটানি ছিল। একবেলা খাবার জোগাড় হলে অন্যবেলা না খেয়ে থাকতে হতো। এতে মৌয়ালের একটু কষ্ট হলেও আল্লাহর কাছে সবসময় শুকরিয়া আদায় করতো। সে মনে মনে বলতো- আল্লাহ আমাদেরকে অনেকের চেয়ে অনেক ভালো রেখেছেন।
একদিন মৌয়াল মধু সংগ্রহ করে বন থেকে বাসার উদ্দেশ্যে ফিরছিল। ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। এমনসময় পথিমধ্যে একটা অদ্ভুদ শব্দ কানে ভেসে আসে। কে যেন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। মৌয়াল শব্দটি শুনে থমকে দাঁড়ায়। শব্দটির উৎস খুঁজতে চারদিকে তাকাল। সে দেখল একটু দূরে গাছের নিচে একটা পাখি পড়ে আছে। পাখিটির গায়ের রং নীল আর ঠোঁট ও পায়ের রং লাল। সে পাখা ঝাঁপটানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু উড়তে পারছিল না। পাখিটির কাতরানির শব্দ শুনে তার প্রতি মৌয়ালের মায়া হলো। সে ধীরে ধীরে পাখিটির দিকে এগিয়ে গেল। সে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কী হয়েছে?
: আমার ডানায় একটা গাছের আঠা লেগে দেহের সঙ্গে আটকে গেছে। আমি উড়তে পারছি না। ডানা থেকে আঠাটা ছাড়িয়ে দিলে উড়তে পারবো। বাসায় আমার ছোট বাচ্চারা না খেয়ে আছে। আমাকে খুব তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। নইলে তারা না খেয়ে মারা যাবে।
: তোমার নাম কী?
: নীলপঙ্খী।
: তোমার বাড়ি কোথায়?
: অচনপুর। সে অনেক দূরের পথ।
মৌয়াল পাখিটির ডানা থেকে খুব যতœসহকারে আঠাগুলো ছাড়িয়ে দিল। তার সেবা-যতেœ পাখিটি ওড়বার ক্ষমতা ফিরে পেল। সে মৌয়ালের প্রতি খুব খুশি হলো। বাসায় ফিরে যাওয়ার সময় সে মৌয়ালকে বলল, তুমি আমার অনেক উপকার করেছ। আমাকে প্রাণে বাঁচাতে সাহায্য করেছ। তাই তোমাকে আমি একটা উপহার দিতে চাই। সে মুখ থেকে একটি সুন্দর লাল রঙের বীজ বের করে এক পা দিয়ে ধরে বললো, এটি পুষ্পনিধির বীজ। এটি তোমার বাড়ির আঙ্গিনায় রোপণ করবে। একসপ্তাহ পর দেখবে, বীজ থেকে চারা গজিয়েছে। চারাটি দ্রুত বড় হবে। একমাসের মধ্যে পুষ্পনিধি ফুটবে। পুষ্পনিধি সুগন্ধি ফুল। ফুলটি যতবার ফুটবে ততবার তার বুকের মধ্যে মনি, মুক্তা, হীরা, পান্না ও স্বর্ণের মতো মহা মূল্যবান দ্রব্যাদি পাওয়া যাবে। তুমি ওগুলো বিক্রি করলে অনেক টাকা পাবে। তা দিয়ে তোমাদের অভাব দুর হবে। তবে সাবধান! কেউ যেন ঘুর্ণক্ষরেও পুষ্পনিধির কথা জানতে না পারে। জানতে পারলে তোমার ক্ষতি হবে। গাছে আর ফুল ফুটবে না। তোমার সঙ্গে আর কোনদিন হয়তো দেখা হবে না। বিদায় বন্ধু। ভালো থেকো। এ কথা বলে নীলপঙ্খী উড়ে গেল। মৌয়াল খুব খুশি হয়ে বাড়িতে বীজটি নিয়ে গেল। খুব গোপনে বাড়ির আঙ্গিনায় সেটি রোপণ করল। একসপ্তাহ পর সত্যি সত্যিই পুষ্পনিধির চারা গজাল। পরের সপ্তাহে গাছটি আরও একটু বড় হল। এভাবে গাছটি আস্তে আস্তে বড় হতে থাকল। ঠিক একমাস পরেই পুষ্পনিধি ফুল ফুটল। আশেপাশে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়ল। মৌয়াল একদিন পর পুষ্পনিধির মাঝে সুন্দর একটি পাথর লক্ষ্য করলো। পাথরটি হাতে নিয়ে দেখে এটি মূল্যবান হীরার টুকরা। হীরার টুকরাটি পেয়ে মৌয়াল মহা খুশি! একদিন সে শহরে গেল হীরাটি বিক্রি করতে। হীরা বিক্রি করে সে অনেক টাকা পেল। সেই টাকাগুলো দেখে তার স্ত্রীও ভীষণ খুশি হলো। স্ত্রীর কৌতূহল মেটাতে মৌয়াল বলল- শোন, আল্লাহ অনেকদিন পর আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন। আমরা খুব দ্রুত ধনী হতে যাচ্ছি। শুধু এই গ্রামেই নয় আমরা সারাদেশের মধ্যে একজন নামকরা ধনীলোক হব। দেশের লোক আমাদের একনামে চিনবে। তারপর সে স্ত্রীকে পুষ্পনিধির কথাটি জানিয়ে দিল। সে আরও বলে, তবে সাবধান ! কেউ যেন না জানতে না পারে। জানলে কিন্তু পুষ্পনিধি গাছে আর ফুল ফুটবে না।
বেশ কয়েকমাস হয়ে গেল। মৌয়াল পুষ্পনিধির বুক থেকে কোনবার স্বর্ণের টুকরা, কোনবার মণি-মুক্তা, কোনবার পান্না-চুনি পেল। সেগুলো বিক্রি করে সে অনেক টাকা পেল। তাদের সংসারে সুখের বাতাস বইতে শুরু করল। তার স্ত্রী তো খুশিতে আটখানা। গোপন তথ্যটা ফাঁস করে দেওয়ার জন্য তার পেটটা যেন ফেটে যাচ্ছিল। মৌয়ালদের আর্থিক অবস্থা যে দিন দিন উন্নতির দিকে যাচ্ছে তা তাদের খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ ও চরাফেরা দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল। মৌয়ালের স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ করতে যাওয়া বন্ধ করে দিল। গ্রামের লোকজনরা একপর্যায়ে কানাঘুষা করতে থাকল। গ্রামের এক বৃদ্ধ মহিলা মৌয়ালের স্ত্রীকে বলল: কী ব্যাপার, এত টাকা-পয়সা কোথা থেকে পাচ্ছ? তোমার স্বামী কি মধু সংগ্রহের পরিবর্তে চুরি-ডাকাতি করতে শুরু করলো নাকি? এই কথা শুনে তো মৌয়ালের স্ত্রী তার প্রতি ভীষণ রেগে গেল। তার স্বামী যে চুরি-ডাকাতি করছে না তা প্রমাণ করতেই পুষ্পনিধির তথ্যটি তার কাছে ফাঁস করে দিল। বৃদ্ধ মহিলা তথ্যটি জানতে পারায় সে আরও দুই একজনের সঙ্গে আলাপ করল। এভাবে এক কান দু’কান করতে করতে পুরো গ্রামবাসীর কানে গোপন তথ্যটি পৌঁছে গেল। শুধু তা-ই নয়। পাশের গ্রামে একজন দুর্র্ষধ দস্যু সর্দার বাস করতো। তার কানেও পুষ্পনিধির কথাটি পৌঁছে গেল। দস্যুটি আর দেরি না করে মৌয়ালের বাড়ি থেকে পুষ্পনিধি গাছটি উপড়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল।
গ্রামবাসীরা যখন মৌয়ালের কাছে পুষ্পনিধির কথা জানতে চাইতো তখন সে কৌশলে এড়িয়ে যেত। কোন কোন সময় মিথ্যা কথা বলে পার পেয়ে যেত। কিন্তু সে যখন জানতে পারলো যে, তার স্ত্রী কোন এক বৃদ্ধ মহিলাকে পুষ্পনিধির কথা ফাঁস করে দিয়েছে তখন সে তার স্ত্রীর প্রতি ভীষণ রেগে গেল। মৌয়াল স্ত্রীকে বলল, তুমি আমার সর্বনাশ করেছ। আমাদের বাঁচতে হলে এই গ্রাম ছেড়ে এখনই পালাতে হবে। নইলে আর রক্ষা নেই। পুষ্পনিধির কথা পাশের গ্রামের দস্যু সর্দারের কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তখন তার স্ত্রী ভুল বুঝতে পেরে মনে মনে খুব অনুতপ্ত হলো। অবশেষে তারা গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকল। ঠিক ওইদিন রাতে দস্যু সর্দার তার দলবল নিয়ে মৌয়ালের বাড়ি আক্রমণ করলো। দস্যু সর্দার সহযোগীদের বলল : তোরা পুষ্পনিধি গাছটি তোলার ব্যবস্থা কর। আমি মৌয়ালের নিকট যে টাকাগুলো রয়েছে তা ছিনিয়ে আনি। দস্যু সর্দার মৌয়ালের নিকট থেকে জোরপূর্বক এতদিনের সঞ্চিত টাকা-পয়সা লুট করে নিল। রাত থাকতে থাকতেই পুষ্পনিধি গাছটি নিয়ে দস্যু সর্দার মৌয়ালের বাড়ি ত্যাগ করলো। এতে মৌয়াল ও তার স্ত্রী বুক চাপড়ে কাঁন্নাকাটি করতে থাকলো। পুষ্পনিধি গাছটি হারিয়ে তারা পাগলের মতো বিলাপ করতে থাকল। ফলে তারা আবার সেই আগের মতো গরিব হয়ে গেল। আবার দুখের দিন শুরু হলো।
সদ্যু সর্দার তার নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় পুষ্পনিধি গাছটি লাগিয়ে দিল।পুষ্পনিধি নিয়ে সে মনে মনে অনেক স্বপ্ন দেখল। সে ভাবলো- পুষ্পনিধির মনি-মুক্তা হাতে পেলে আমি অনেক বড়লোক হয়ে যাব। পুষ্পনিধি কখন ফুটবে সে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। তার যেন আর তর সইছে না। সপ্তাহখানিক অপেক্ষা করার পর সে দেখল, গাছটিতে পুষ্পনিধি ফুটেছে। সে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। দ্রুত পুষ্পনিধি গাছের নিকটে গিয়ে সে লক্ষ করল যে, পুষ্পনিধির বুকে কালো চকচকে একটা পাথর দেখা যাচ্ছে। সে হাত দিয়ে যেই পাথরটি তুলতে গেল আর অমনি সেটি ভয়ংকর একটি সর্পে পরিণত হয়ে দস্যু সর্দারের কপালে ছোবল মারল। আর এতে সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হলো। পরেরদিন দেখা গেল পুষ্পনিধি গাছটিও শুকিয়ে মারা গিয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ