বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

হজ্জ সর্বোত্তম ইবাদত

লুৎফুন্নেসা বেগম : হযরত ইবরাহীম (আ:) সাড়ে চার বছর পূর্বে আল্লাহর নির্দেশে সে সার্বজনীন আহ্বান জানিয়েছিলেন বিশ্বের মুসলমানদের একত্রিত হবার অর্থাৎ হজ্জ করবার জন্য তা’ এখনও চলছে এবং চলবে আখিরাতের পূর্ব পর্যন্ত। আল্লাহর আহ্বানকারী ডেকে বলেছিলেন আল্লাহর বান্দাগণ আল্লাহমর ঘরের দিকে আসো, পৃথিবীর প্রতি কোন থেকে ছুটে আস। পায়ে হেটে আস, কিংবা যানবাহনে চড়ে আস। এর জবাব স্বরূপ আজ পর্যন্ত হারাম শরীফের প্রতিটি মুসাফির বলে উঠেছে “লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। আমি এসেছি “হে আল্লাহম, আমি হাজির হয়েছি। কেউ তোমার শরিক নেই, আমি কেবল তোমারই আহ্বানক্রমে এসেছি, সব প্রশংসা তারিফ তোমারই দান, কোন কিছুতেই তোমার কোন শরিক নেই।” এই দোওয়া পড়তে পড়তে সে ভাবাবেগের সৃষ্টি হয় তা’ একমাত্র আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে, তখনতাকে স্মরণ ভিন্ন আর কিছুর অস্তিত্ব থাকে না।
‘হজ্জ’ অর্থ খিয়ারতের সংকল্প করা। কা’বা শরীফ জিয়ারতের উদ্দেশ্যেই মুসলমানগণ চারিদিক থেকে নির্দিষ্ট জায়গায় চলে আসেন তাই এর নামে হজ্জ। হজ্জ ইসলামের পঞ্চম ভিত্তি মানুষ যখন কা’বা শরীফে এসে একত্রিত হয় এবং কা’বা শরীফ চোখে দেখে তখন তাদের জন্য তা একান্তই কল্যাণকর। এতে যে কল্যাণ রয়েছে তা’ এখানে এসেই অনুধাবন করা যায়, ইমাম আবু হানিফা (রা:) হজ্জ করার পূর্ব পর্যস্ত বুঝতে পারেননি যে, ইসলামী ইবাদতের মধ্যে কোনটি সর্বোত্তম। কিন্তু হজ্জ করে তার অন্তর্নিহিত কল্যাণ প্রত্যক্ষ করলেন তখন স্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলেন, হজ্জই সর্বোত্তম ইবাদত।
পবিত্র কা’বা কালো কাপড়ে বেষ্টিত পবিত্র এই ঘর খানির মর্যাদা কুরআনে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা কুরাইশের ৩ নম্বর আয়াতে এবং সূরা বাকারার ১২৫ নং আয়াতে পবিত্র কা’বাকে তার নিজের ঘর অর্থাৎ’ ‘আমার ঘর’ হিসেবে আল্লাহ্ উল্লেখ করেছেন। তাই মুসলমান মাত্রই এই ঘরে হাজিরা দেওয়ার কামনা-বাসনা তাদের অন্তরে লালিত হয়। কিন্তু এই লালিত স্বপ্ন কারোর পূরণ হয় কারোর হয় না। একটা মাস ইবাদতের স্বপ্নপুরীর একান্ত কাছাকাছি থেকে আল্লাহ্ ও রাসূল (সা:)-এর প্রেমে নিমগ্ন হয়ে নিজেকে উজাড় করে দেবার যে প্রাপ্তি তা জীবনের বিশাল অর্জন, চাওয়ার অতুলনীয় পাওয়ার পূরণ।
আল্লাহ্ কুরআন পাকে বলেছেন, “আল্লাহ্র ঘর পর্যন্ত পৌঁছানোর যার সামর্থ্য আছে, হজ্জ করা তার উপর আল্লাহ্র একটি অনিবার্য নির্দিষ্ট হক। এতদ্বসত্ত্বেও যে তা অমান্য করে সে কাফের এবং আল্লাহ্ দুনিয়া জাহানের মুখাপেক্ষী নন, আল- ইমরান ৯৫ নং আয়াত।
নবী করিম (সা:) বলেছেন সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি হজ্জ না করে তবে এ অবস্থায় তার মৃত্যু ইহুদী ও নাসারার মৃত্যুর সমান বিবেচিত হবে।” কি কঠিন হুকুম! সুতরাং আমাদের জীবনের শুরু থেকে হজ্জ করার প্রবল কামনা-বাসনা থাকতে হবে। আল্লাহ্ পাক আমাদের নিজেদের গোনাহ মাফের অনেক তরীকা বাতলে দিয়েছেন হজ্জ তার মধ্যে অন্যতম ইবাদত যা করলে মানুষ শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যায়। সুবহানাল্লাহ্।
মুসলিম জাহানের পিতা হযরত ইবরাহীম (আ:) আল্লাহ্র নির্দেশে কা’বাঘর পুনঃনির্মাণ করে তার দরবারে দোয়া করলেন। আল্লাহ্ তা’আলা সেই দোয়া কবুল করে বললেন, “হে ইবরাহীম! তুমি মানুষের মাঝে হজ্জের ঘোষণা দাও। তারা দূর-দূরান্তের আনাচে-কানাচে থেকে তোমার কাছে আসবে হেঁটে, আসবে সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রের পিঠে সওয়ার হয়ে। সূরা হজ্জ ২৭ নং আয়াত) অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা তাকে হজ্জের ঘোষণা দিতে বলবেন। তিনি বললেন, “আমার আওয়াজ কি করে পৌঁছবে? আল্লাহ্ তা’আলা বললেন “তুমি ঘোষণা দাও। তোমার ঘোষণা ও আওয়াজ বিশ্বমানবতার কানে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আমার। তিনি বললেন, “হে রব; ঘোষণায় কি বলবো? আল্লাহ্ তা’আলা বললেন, বলো হে মানবম-লী। তোমাদের উপর হজ্জ ফরজ করা হয়েছে। ইবরাহীম (আ:) ঘোষণা দিলে আসমান ও জমিনের সবাই সে ঘোষণা শুনতে পায়।’ “বায়হাকী, মুসান্নাফে আবি শাররা)।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে হযরত ইবরাহীম (আ:) কুরাইস পাহাড়ে উঠে নিজের দুই কানে আত্তুল দিয়ে সুউচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, “হে মানব সম্প্রদায়। আল্লাহ তোমাদের উপর হজ্জ ফরজ করেছেন, তোমরা তোমাদের প্রভুর আহ্বানে সাড়া দাও।” তখন নারীর গর্ভে যারা ছিল সবাই “লাব্বায়েক’ বলে সাড়াদিল। মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, “অতএব, এ পর্যন্ত সে সমস্ত লোক হজ্জ করেছে সে অবশ্যই সেই আওয়াজ শুনেছিল এবং লাব্বাইক বলে সাড়া দিয়েছিল। এ আহ্বান শুনে সাড়া দেয়নি এমন কোন ব্যক্তি কিয়ামত পর্যন্ত হজ্জ করতে পারবে না। সে একবার সাড়া দিয়েছে, আর সে দুই বা ততধিকবার সাড়া দিয়েছিল সে সেই অনুযায়ী ততবার হজ্জ করার সৌভাগ্য অর্জন করবে।’ (তাকসিরে কবীর, ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী)।
মানুষের ইবাদতের জন্য সর্বপ্রথম যেঘর নির্দিষ্ট করা হয়েছিল তা’ মক্কার পবিত্র কা’বাঘর তাতে সন্দেহ নেই। এই ঘর অত্যন্ত পবিত্র, বরকত পূর্ণ ও সারা দুনিয়ার হেদায়াতের কেন্দ্রস্থল। হযরত ইবরাহিম (আ:) দোয়া করেছিলেন “হে আমার খোদা এ শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার নগর বানিয়ে দাও এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে মানে তাদেরকে সবধরনের ফলের রেযেক দান কর। উত্তরে খোদা বললেন, যারা মানবে না, কয়েকদিনের এই জৈব জীবনের সামগ্রী তাকেও আমি দেব। সূরা: বাকারা ১২৬ নং আয়াত।
হজ্জ মুসলিম জাহানের এক মহা সম্মেলন। সমগ্র মুসলিম জাহানের প্রতিটি দেশ থেকে বিভিন্ন ভাষার লাখ লাখ মানুষ একই পোষাকে একই নিয়মে হজ্জ পালন করে সাম্য মৈত্রীর যে পরাকাষ্ঠা প্রমাণ করে যার তুলনা আর ২য়টি নেই। হজ্জ ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি দৃঢ় করে। অন্তরে আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ব স্মরণ হয়। পরকালের ভীতি, জাগরিত হয়। গুনাহ্ মাফ হয় ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। মানুষের মধ্যে ঐক্যের ও ভাতৃত্ব বোধ সৃষ্টি করে। সামাজিক সাম্য সৃষ্টি করে। হজ্জ দেশ ও আন্তর্জাতিকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব ফেলে, ফলে মুসলিম বিশ্বের সমৃদ্ধিও বৃদ্ধি পায়।
* হজ্জের শিক্ষা, হজ্জ ফরজ হওয়ার সাথে সাথে তা আদায় করা উচিত।
* হজ্জ আদায় করতে বিলম্ব করা উচিত নয়।
* সময় মত হজ্জ আদায় না করলে গুনাহগার হবে।
সুতরাং আসুন বোনেরা এই মহা মূল্যবান ফরজ ইবাদত জীবনে একবার পালন করে নিজেদেরকে আত্মিক পবিত্রতায় সুষমামন্ডিত করি। আমীন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ